ডিসেম্বর ১৫, ২০২২, ০৩:১৩ এএম
সরকার কর্তৃক কারখানা ভবন ও হ্যাচারি প্ল্যান্টের বেশির ভাগ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ২০১৬ সাল থেকে উৎপাদন কার্যক্রম স্থবির ছিল। লভ্যাংশ দেয়াও বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন। এরপরও বিচ হ্যাচারি লিমিটেডের সম্পদ রয়ে গেছে আগের মতোই, এমনকি শেয়ারদরও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।
কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি বলছে— এর কারণ জানা নেই তাদের। এসব কারণ ও বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভাঁজ ফেলেছে বিনিয়োগকারীদের কপালে। প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে জানা গেছে, খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতে ২০০২ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়।
প্রতিষ্ঠানটির বাণিজ্যিক কার্যালয় ঢাকায় হলেও কক্সবাজারের টেকনাফ মহেশখালী পাড়ায় কারখানা ও প্ল্যান রয়েছে। তালিকাভুক্তির পর ধারাবাহিকভাবে ১০ শতাংশ বা তার উপরে লভ্যাংশ দিলেও ২০১৪ সালে এসে হোঁচট খায় কোম্পানিটি। সে সময় মাত্র ৫ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে ‘বি’ ক্যাটাগরিতে অবনমন হয়।
এরপর ২০১৬ সালে কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ রোড নির্মাণকালে নির্মাণাধীন রোড সংলগ্ন কারখানা ও প্ল্যান্ট ভেঙে ফেলে সরকার। কিছু অংশ আবার অধিগ্রহণ করা হয়। ফলে সে সময় থেকেই সামগ্রিক কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে আসে।
এদিকে ডিএসইর তথ্য মতে, কার্যক্রমে স্থবিরতার পর ২০১৯ সাল পর্যন্ত কোনো এজিএম করেনি বিচ হ্যাচারির। এ সময়ে বিনিয়োগকারীদের জন্য কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা হয়নি। ২০২০-২১ অর্থবছরে সীমিত পরিসরে কার্যক্রম শুরু করলে সে সময় বিনিয়োগকারীদের জন্য মাত্র ১ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে ‘জেড’ ক্যাটাগরি থেকে বেরিয়ে আসে।
সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরেও বিনিয়োগকারীদের জন্য ১.৫ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ। তবে কোম্পানির ২০২১-২২ অর্থবছরের এই আর্থিক প্রতিবেদন নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে অডিট প্রতিষ্ঠান ইসলাম কাজী শফিক অ্যান্ড কোং, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস। অডিট ফার্মটি জানায়, আন্তর্জাতিক হিসাব মানের (আইএএস) আয়কর সংক্রান্ত ১২ ক্রমিকের ৫৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি লাভ, ক্ষতি ও অন্যান্য বৃহৎ আয়ের বিবরণীতে ব্যয় বা আয়ের ওপর বিলম্বিত কর (ডেফার্ড ট্যাক্স) দেখায়নি।
আবার রিলেটেড পার্টির ব্যবস্থাপনায় থাকা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ সম্পর্কিত বিষয়ের ক্ষেত্রে চাহিদা অনুসারে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করেনি, যা আইএএস-২৪ এর ১৭ অনুচ্ছেদের ব্যত্যয়।
নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানটি আরো জানায়, আর্থিক প্রতিবেদনের ২.১২ নং টিকায় উল্লেখ রয়েছে— সরকার কর্তৃক মেরিন ড্রাইভ রোড নির্মাণের প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানটির কারখানা ভবনসহ কিছু সরঞ্জাম ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে এবং হ্যাচারি প্ল্যান্ট গঠনের কিছু জমিও অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
ফলে ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল থেকে কোম্পানির সামগ্রিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে আছে। কিন্তু সমাপ্ত আর্থিক বছরের প্রতিবেদনে শিডিউল অব প্রপার্টি, প্ল্যান্ট ও ইক্যুইপমেন্টের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ অডিট ফার্ম জানায়, প্রতিষ্ঠানটির উল্লিখিত সম্পদসহ মোট সম্পদ মূল্য ২২ কোটি ৫৭ লাখ ৪৯ হাজার ১৬১ টাকা দেখানো হয়েছে।
তারা (অডিট ফার্ম) বলছে, যেখানে সরকার মেরিন ড্রাইভ রোডের জন্য কারখানা ভবন ধ্বংস ও হ্যাচারির প্ল্যান্টের কিছু অংশ অধিগ্রহণ করেছে সেখানে কারখানার মোট সম্পদের পরিমাণ দেখিয়ে ২২ কোটি টাকারও বেশি। এখন আর্থিক প্রতিবেদনে কারখানা ভবন ও হ্যাচারি ইক্যুইপমেন্টের সঠিক মূল্যের বিষয়ে আমাদের সন্দেহ রয়েছে।
এই সম্পদ মূল্যের বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেও প্রতিষ্ঠান থেকে এ বিষয়ে উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ সরবরাহ করা হয়নি। সম্পদের এই বৈকল্যের বিষয়টি যাচাই করারও সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন তারা। এরপরও প্রতিষ্ঠানটি তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে এবং সমাপ্ত ৩০ জুন, ২০২২ অর্থবছরে নিট মুনাফা দেখিয়েছে।
আবার আর্থিক প্রতিবেদন তৈরির সময় পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি স্টেটমেন্ট অব ফিন্যান্সিয়াল পজিশনে ব্যবসায় পাওনা দেখিয়েছে ২৬ কোটি ৯৯ লাখ ৪৩ হাজার ৭৯৮ টাকা। অথচ নিরীক্ষায় দেখা গেছে, এই টাকা গত ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে এই হিসাব দেখিয়ে আসছে কোম্পানি।
ফলে নিরীক্ষকের মতে, কয়েক বছর যাবত কার্যক্রম বন্ধ থাকায় এই বকেয়া প্রাপ্তির সম্ভাবনা নিয়ে উচ্চ মাত্রায় অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি এই সন্দেহজনক ঋণ এবং ক্ষতির বিপরীতে আইএফআরএস-৯ অনুসারে প্রভিশন রাখা হয়নি। এসব কারণে আর্থিক প্রতিবেদনে মোট সম্পদ বেশি ও নিট লস কম হয়েছে বলে মনে করে অডিট ফার্ম।
এছাড়া শ্রম আইন অনুসারে, প্রতিষ্ঠানটি ডব্লিউপিপি ফান্ডে কোনো অর্থ প্রদান করেনি। প্রতিষ্ঠানটি এমন ফুলেফাঁপা আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করলেও আইন অনুসারে সরকারি কোষাগারে কর প্রদান করেনি বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে অডিট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২-১৩ হিসাব বছরের অ্যাসেসমেন্ট অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির কাছে বকেয়া ট্যাক্স বাবদ এক কোটি ৯৩ লাখ ৩৫ হাজার ৫৬১ টাকা পাওনা দাবি করে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে চিঠি দেয় আয়কর বিভাগ। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি এ বিষয়ে উল্লিখিত দাবি পূরণের জন্য পর্যাপ্ত সঞ্চিতি রাখেনি। এ ক্ষেত্রে প্রভিশন রাখলে প্রতিষ্ঠানটি নিট মুনাফার বদলে নিট ক্ষতিতে পড়ত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে বিষয়টি আপিল বিভাগে শুনানির প্রক্রিয়ায় আছে। এছাড়া ডিএসইর তথ্যানুসারে, মাত্র ৪১ কোটি ৪০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটির দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ আছে পাঁচ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।
এত সব অনিয়মের পরও প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার দর বাড়ছে হু হু করে। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছরের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়েও ১১ থেকে ১২ টাকা দরে শেয়ারটি বেচাকেনা হয়েছিল। কিন্তু ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে শেয়ারটি সর্বোচ্চ ৩৪ টাকা পর্যন্ত ওঠে। অবশ্য এরপর দাম কিছুটা পরে গেলেও নতুন বছরের শুরুতেই ফের ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে শেয়ারের মূল্য। চলতি বছরের জুলাই মাসে সর্বোচ্চ শেয়ার দর ওঠে ৪৬ টাকা ৭০ পয়সা।
অর্থাৎ এক বছরে শেয়ার দর ২৮৯ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পায়। অথচ প্রায় অর্ধ যুগ ধরে ব্যবসায়িক কার্যক্রমে ছিল শ্লথগতি। সমাপ্ত ৩০ জুন অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় বিনিয়োগকারীদের জন্য ১.৫০ শতাংশ লভ্যাংশের বিপরীতে শেয়ারপ্রতি আয় ২২ পয়সা এবং শেয়ারপ্রতি সম্পদ ৯ টাকা ৭২ পয়সায় দেখিয়েছে বলে জানিয়েছে ডিএসই সূত্র।
গত ৮ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটি লেনদেনের তালিকায় ছিল শীর্ষে। ফলে এমন অস্বাভাকি দর বৃদ্ধির পেছনে কারসাজি রয়েছে বলেই মনে করছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এতে যেমনিভাবে বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্তিতে ফেলে ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে তেমনিভাবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্বে উদাসিনতার প্রশ্নও তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা।
এসব বিষয়ে বিচ হ্যাচারি লিমিটেডের কোম্পানি সচিবে কাছে জানতে চাইলে তিনি দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, ‘অডিটে আপত্তি প্রতি বছরই দিচ্ছে তারা। আমাদের কিছু ব্যবসা আছে সেগুলো বন্ধ রয়েছে, আর কোম্পানির জমি বাবদ টাকাটা উঠানো হচ্ছে না বলেই দিয়েছে।’
অপরদিকে, অডিটর কাজী শফিকুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে বলেন, ‘যে সব বিষয়ে আমাদের সন্দেহ তৈরি হয়েছে তা অডিট রিপোর্টে উল্লেখ করেছি, এর বেশি কিছু করার এখতিয়ার আমাদের নেই। আমরা শুধু ওয়াচডগ, তবে বিনিয়োগকারীরা চাইলে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারে।’