ডিসেম্বর ২২, ২০২২, ০১:১৩ এএম
- ভয়ে সাক্ষ্য দিতে যান না অনেকে, বাড়ছে মামলাজট
- যথাযথ নিরাপত্তা ও যাতায়াত খরচও দেয়া হয় না
- আইন প্রণয়নে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও উপেক্ষিত
- আইন হলে সাক্ষীরা নির্ভয়ে আসবেন —মত আইনজ্ঞদের
আবদুল খালেক। বাড়ি বগুড়ার ধুনট উপজেলায়। মারধরের অভিযোগে করা এক মামলায় সাক্ষ্য ছিলেন তিনি। গত ২২ নভেম্বর বগুড়া আদালতে সশরীর হাজিরা দেয়ার দিন ধার্য ছিল। এদিন সকালে আবদুল খালেক আদালতের উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হন। তবে বাড়ির সামনে রাস্তায় পৌঁছালে মামলার এক নম্বর আসামি ফজলুল হকসহ অন্যরা খালেকের ওপর হামলা চালান।
এতে তিনি আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। উদ্ধার করে তাকে বগুড়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। সাক্ষ্য দিতে আদালতে যাওয়ার পথেই আসামিদের হামলায় প্রাণ হারান খালেক। সাক্ষীদের হত্যা, নির্যাতন, হুমকি-ধমকির ঘটনা অহরহই ঘটছে। ফৌজদারি স্পর্শকাতর মামলা থেকে শুরু করে মাদক মামলার সাক্ষীকেও প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হচ্ছে। ফলে সাক্ষীকে আদালতে হাজির করা যাচ্ছে না।
আর সাক্ষী না আসায় মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না। ঝুলে আছে যুগের পর যুগ। সমস্যার সমাধানে সাক্ষী সুরক্ষা আইন করা জরুরি বলে মত দিয়েছেন আইনজ্ঞরা। নিরাপত্তা নেই। সাক্ষ্য দিতে আদালতে যেতে হয় নিজের খরচায়। আসামিদের হুমকি ধমকি তো আছেই। সাক্ষীদের পদে পদে বাধা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন আসামিরা। কেউ কেউ হামলার শিকারও হন। ঘটে প্রাণহানির ঘটনায়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে— এত বিপদসঙ্কুল পথ অতিক্রম করে কেন সাক্ষী দিতে যাবেন। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আদালতে যাওয়ার দরকারটাই বা কি? এই প্রশ্নের জবাব মিলছে না। সাক্ষীদের সুরক্ষা দিতে না পারলে তাদের আদালতে নেয়া সম্ভব হবে না এমন অভিমত দিয়েছেন আইনজ্ঞরা। এতে মামলার বিচার প্রক্রিয়া মুখথুবড়ে পড়বে। বাড়বে মামলাজট।
এমন সব বাস্তবতার কথা বিবেচনায় সাক্ষী সুরক্ষা আইন জরুরি বলে মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। দ্রুত আইনটি করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্ট। তবে এখনো বাস্তবায়ন নেই উচ্চ আদালতের আদেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাক্ষীর নিরাপত্তায় আইন আছে। তবে বাংলাদেশে আইন প্রণয়ন শুধু বিবেচনাধীনই রয়েছে।
কবে নাগাদ সাক্ষীদের সুরক্ষা দিতে পৃথক আইন করা হবে সে বিষয়েরও কোনো নিশ্চয়তা নেই। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য ২০১০ সালে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু ১২ বছরেও সাক্ষীদের সুরক্ষা এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার।
এমনকি সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়নের আশ্বাস দিলেও এখনো সেটি করা হয়নি। মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের মামলার এক নম্বর সাক্ষী ফরিদপুর শহরের চিত্তরঞ্জন বালা। মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। তবে দীর্ঘ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো আতঙ্কে ভুগছে তার পরিবার। প্রভাবশালী মুজাহিদের অনুসারীরা এখনো হুমকি-ধমকি দেন। নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটছে চিত্তরঞ্জনের পরিবারের। চিত্তরঞ্জন পরিবারের অভিযোগ, সাক্ষ্য দেয়ার আগে নিরাপত্তার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আশ্বাস দিলে পরে তা বাস্তবায়ন করেনি। বর্তমানে কেউ খোঁজও রাখে না।
শুধু চিত্তরঞ্জনই নয়, মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় অনেক সাক্ষীই এখনো নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছেন। সাক্ষ্য শেষ হওয়ার পরে তাদের খোঁজও রাখেনি রাষ্ট্রপক্ষ। চলমান মামলাগুলোর সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে ট্রাইব্যুনালেই আসতে চান না। এর মূল কারণ— ওই নিরাপত্তা ঝুঁকি।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফৌজদারি মামলার আসামিদের অধিকার রক্ষায় সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও আইন রয়েছে। কিন্তু যাদের সাক্ষ্যের মাধ্যমে আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ এবং সাজা হয় সেই সাক্ষীদের সুরক্ষায় দেশে এখন পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট আইন নেই। কেবল সাক্ষ্য আইনের ১৫১ ও ১৫২ ধারা অনুযায়ী সাক্ষীকে অপমানজনক, কুরুচিপূর্ণ বা আগ্রাসী প্রশ্ন করার ব্যাপারে বিধিনিষেধ রয়েছে।
আইনজীবীদের অভিমত, খুন, ধর্ষণের মতো গুরুতর ফৌজদারি অপরাধে ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা ভুক্তভোগী ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। কিন্তু ঘটনার পর নিরাপত্তাহীনতায় থাকতে হয় তাদের। বর্তমানে খুন, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, এসিড নিক্ষেপের মতো গুরুতর অপরাধের বিচারে দীর্ঘসূত্রতা নিয়মিত বিষয়। এর অন্যতম কারণ, এসব মামলার আসামিরা অনেক ক্ষেত্রেই সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। সাক্ষীকে খুন, মারধর ও হুমকির ঘটনা নিয়মিতই ঘটছে। এতে করে নিরাপত্তাহীনতায় শুনানির দিন সাক্ষীরা আদালতে যান না।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মাদ ফারুক হোসেন বলেন, ‘সাক্ষী সুরক্ষা আইনের অভাবে সাক্ষীরা আদালতে আসেন না। এতে করে ন্যায়বিচার মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে। সুরক্ষা না থাকলে সাক্ষীরা কোর্টে আসবে না, ভয়ভীতি পাবে— এটিই স্বাভাবিক। মানুষ মৌলিক ও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবে। এই আইনটি করা হলে সাক্ষীরা আদালতে আসবে নির্ভয়ে। সেই সঙ্গে ন্যায়বিচারও নিশ্চিত হবে।’
সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালে এখন সাক্ষী হাজির করা কষ্টকর। তবে প্রথমে সাক্ষীদের সুরক্ষা দেয়া হলেও বর্তমানে সেটি করা হয় না। আসলে আলোচিতদের সাজা কার্যকর হওয়ায় ট্রাইব্যুনালেরই গুরুত্ব কমে গেছে, তাই সাক্ষীদের নিয়ে আলাদা করে ভাবা হয় না। যদি সাক্ষীদের সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসার সুরক্ষা দেয়া হয়, তবে এসব জটিলতা কেটে যাবে, মামলাও নিষ্পত্তি হবে দ্রুত।
সুপ্রিম কোর্ট এক নির্দেশনায় বলেছেন, পুরনো মামলার বিচার দ্রুত শেষ করতে। ২০২০ সালের আগের মামলাগুলো নিষ্পত্তি করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ মামলাগুলো বিচারিক আদালতে ঝুলে আছে, কারণ সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসেন না।’ আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেন, ‘সুরক্ষা আইন করতে আইন কমিশন সুপারিশ পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন কেন এই আইন হচ্ছে না তা সরকার জানে। হয়তো কোনো সমস্যা থাকতে পারে, তা তো বলতে পারছি না।’
সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়নে কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, সাক্ষীদের নিরাপত্তার জন্য সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। এটি নিশ্চিত— রাষ্ট্র সাক্ষীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলে অপরাধীরা সাক্ষ্যের অভাবে খালাস পেতে থাকবে, যা দেশের আইন, বিচার ব্যবস্থা ও আইনশৃঙ্খলার জন্য মারাত্মক হুমকি হবে। সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও মামলার সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য পৃথক স্থায়ী তদন্ত সংস্থা গঠনে সরকারকে জোর সুপারিশ করে আইন কমিশন। কমিশন মনে করে, এ ধরনের আইন করা হলে সাক্ষীরা নির্ভয়ে আদালতে ফৌজদারি মামলায় সাক্ষ্য দিতে আসবেন।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শফিক আহমেদ বলেন, ‘সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা দরকার। আমরা সুপারিশটি পাওয়ার পর খসড়াকারে তৈরি করে তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলাম। এরপর বিষয়টি আর এগোয়নি। নিয়ম অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তা মন্ত্রিসভার বৈঠকে তোলার কথা। মন্ত্রিসভা থেকে তা পাস করার জন্য সংসদে পাঠানোর নিয়ম। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তা করেনি।