ডিসেম্বর ২৫, ২০২২, ১২:৪৮ এএম
- সংকটে আরও কমছে উৎপাদন
- অনুসন্ধানই সর্বোত্তম বিকল্প
- এক দশক পর অজানা শঙ্কা
- অনুসন্ধানের জন্য জোর তাগিদ বিশেষজ্ঞদের
- ৩২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট অনাবিষ্কৃত
বিশ্বব্যাপী চলছে জ্বালনি সংকট। সংকট কত দিন থাকবে তাও স্পষ্ট নয়। অন্যদিকে ফুরিয়ে আসছে গ্যাসের মজুত। এর মধ্যেই দেশে ৭০টি কূপের অধিকাংশেই উৎপাদন কমছে। সংকটের আগে জ্বালানি খাতে উৎপাদনের চেয়ে আমাদানিতেই মনযোগ বেশি ছিল। সিলেট গ্যাস ফিল্ড লিমিটেডের (এসজিএফএল) সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র কৈলাশটিলা থেকে ২০১৬ সালে দৈনিক প্রায় ৭০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হতো।
চলতি বছরের শুরুতে তা ২৯ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে এসেছে। সত্তরের দশকে আবিষ্কৃত এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু হয় ১৯৮৩ সালে। মোট সাতটি কূপের অধিকাংশ কূপ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস উৎপাদন কমে যাওয়া— দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগের বিষয়। তারা নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র ও কূপের জন্য জোরেশোরে অনুসন্ধান চালানোর কথা বলছেন। সরকার সঠিকভাবে গ্যাস অনুসন্ধান করেনি। তাই এখনো অনেক জায়গায় গ্যাসক্ষেত্র অনাবিষ্কৃত থাকতে পারে। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উৎপাদন কমে যাওয়া অবশ্য কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বর্তমানে ২০টি গ্যাসক্ষেত্রের বেশির ভাগ থেকেই আগের তুলনায় কম গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে।
এদিকে সরকারের জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের হাইড্রোকার্বন ইউনিট থেকে পাওয়া তথ্য মতে, মাত্র চারটি গ্যাসক্ষেত্রে আগের চেয়ে বেশি উৎপাদন হচ্ছে। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি উৎপাদনকারী গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানায় প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে ২৬টি কূপের মধ্যে চলতি মাসের শুরুতে ছয়টির উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে দেশে গ্যাসের তীব্র সংকট দেখা দেয়। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তিনটি এবং দুটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের অধীন পরিচালিত গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে ২০২১ সালে প্রতিদিন দুই হাজার ৩৫২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হয়।
অথচ ২০১৬ সালে দেশে প্রতিদিন দুই হাজার ৬৬৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হতো এমন তথ্য পাওয়া যায় হাইড্রোকার্বন ইউনিট থেকে। শঙ্কার কথা বলছেন ভূতত্ত্ববিদরা। তারা বরাবরই অনুসন্ধানের তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন।
এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ কর্পোরেশনের (পেট্রোবাংলা) তথ্য বলছে, দেশে মাত্র ৯-১০ বছর ব্যবহারের জন্য গ্যাস মজুত আছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলমান বৈশ্বিক সংকট না হলেও আমদেরকে জ্বালানি সংকটের মুখোমুখি হতে হতো। ২০১৫ সাল থেকে স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন ও সরবরাহ কমে এসেছে এবং অদূর ভবিষ্যতে তা অব্যাহত থাকবে।
অন্যদিকে ভূ-বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুসারে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যতটুকু গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি প্রাকৃতিক গ্যাস অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। ফলে গ্যাস অনুসন্ধান দেশের জ্বালানি সংকট কাটিয়ে ওঠার সর্বোত্তম বিকল্প। দেশের গ্যাসে মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদন, সারসহ অন্যান্য শিল্প কারখানার উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এবং বাসাবাড়িতে রান্নার কাজে ব্যবহূত হয়।
বিইআরসির দেয়া তথ্য সূত্রে, প্রায় ১২৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে কমপক্ষে ৪০টি কূপের ধারণক্ষমতা বাড়ানো যায় এবং সেগুলো থেকে প্রতিদিন ৪০০-৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। কিন্তু সরকার তা করেনি। গ্যাস উৎপানের সংশ্লিষ্টদের গাফলতি নিয়েও কথা বলেন ভূতত্ত্ববিদরা। গ্যাস উত্তোলনের সার্বিক বিষয়ে কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম।
আমার সংবাদকে তিনি বলেন, আমাদের দেশে বর্তমানে অধিকাংশ গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন কমে গেছে। তবে এটিও আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে এখনো সব গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়নি। প্রতিটি গ্যাসক্ষেত্র তার সর্বোচ্চ উৎপাদনের একটি সীমায় উঠার পর ধীরে ধীরে উৎপাদন কমতে শুরু করে।
তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গত ২০ বছরে মাত্র ২৮টি অনুসন্ধানী কূপ খনন করেছে। হাইড্রোকার্বন থাকার সমূহ সম্ভাবনা আছে, এমন একটি দেশের জন্য এই সংখ্যাটি খুবই কম।
এই ভূতত্ত্ববিদ আরও জানান, আমাদের দেশে প্রতি তিনটি কূপ খনন করলে একটিতে গ্যাস পাওয়া যায়। যেখানে বিশ্বের অন্যান্য দেশের গড় প্রতি পাঁচটিতে একটি। সে হিসাবে আমাদের দেশ অনেক উর্বর। তিনি সরকারকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে উত্তোলনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেয়া পরামর্শ দেন।
এর আগে ‘সরকার আমদানিতে আগ্রহী বেশি’-এমন বক্তব্য খণ্ডন করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, যারা বলে— আমরা অনুসন্ধানের চেয়ে আমদানিতে বেশি আগ্রহী, তারা আমাদের খনন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে দেখুক বিষয়টি। তিনি আরও বলেন, অনুসন্ধান কার্যক্রম পেট্রোবাংলার অধীনে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (বাপেক্স) একটি নিয়মিত কাজ।
এদিকে ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে এবং পেট্রোবাংলার দুই বছরের যৌথ সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ৩২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস অনাবিষ্কৃত। নরওয়ের পেট্রোলিয়াম ডিরেক্টরেট এবং হাইড্রোকার্বন ইউনিট আরেকটি যৌথ গবেষণায় প্রস্তাব করেছে, বাংলাদেশের অনাবিষ্কৃত গ্যাস সম্পদের গড় সম্ভাবনা ৪২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের আয়তন এক লাখ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং এখন পর্যন্ত মোট ১০০টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে। অন্যদিকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আয়তন ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং সেখানে ১৫০টিরও বেশি অনুসন্ধানী কূপ খনন করা হয়েছে। এ ধরনের পরিসংখ্যান দেখায়, বাংলাদেশে অনুসন্ধানের হার আসলে কতটা কম।
বিশেষজ্ঞরা জানান, ১৯৭৪ সাল থেকে দেশের সমুদ্র এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধান শুরু হলেও ওই সময়ের পর এখন পর্যন্ত আর কোনো বড় কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়নি।২০১৫ সালে পেট্রোবাংলা মাল্টি-ক্লায়েন্ট জরিপের একটি প্রক্রিয়া শুরু করলেও, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সেটি আটকে আছে।
এ বিষয়ে কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানির নিচে খনিজ অনুসন্ধানে মাল্টি-ক্লায়েন্ট জরিপ একটি মৌলিক কাজ।
এদিকে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী দাবি করেছেন, গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধান চালানো ভবিষ্যতে আর সম্ভব হবে না। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন উল্টো কথা।
তাদের মতে, কর্তৃপক্ষ অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার কাজগুলো ঠিকঠাক করছে না। বাংলাদেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে জ্বালানি চাহিদা মেটাতে, নির্ভরযোগ্য সমাধান হিসেবে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ব্যবহার করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, চলমান জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় গ্যাস উত্তোলন ও অনসন্ধানে অনেক বেশি মনযোগ করতে হবে। আর এটিই সংকট সমাধানে সর্বোত্তম বিকল্প।