Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪,

বাধ্যতামূলক অবসর ও পদোন্নতি

বেলাল হোসেন

ডিসেম্বর ২৯, ২০২২, ০১:১২ এএম


বাধ্যতামূলক অবসর ও পদোন্নতি

প্রত্যেক বছর শুরু হয় ভালো কিছু দিয়ে। তবে বছর শেষে ঘটে যায় নানা আলোচিত ঘটনা। ২০২২ সালও এর ব্যতিক্রম ছিল না। করোনার প্রভাব কাটিয়ে স্বাভাবিক কার্যক্রমে সরগরম ছিল সব মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম। তবে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে রদবদল, বাধ্যতামূলক অবসর ও ওএসডি বছরজুড়ে ছিল আলোচনায়। বিশেষ করে বছরের শেষ দিকে তথ্য সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো ও পুলিশের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকেও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো— সব কিছুকে ছাপিয়ে সবার মধ্যে ব্যাপক আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে।

এছাড়াও ধর্ষণ মামলায় উপসচিব রেজাউল করিমকে অবসর, একই দিন ২৩ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ, বিভিন্ন পর্যায়ের ৬৩৩ কর্মকর্তার পদোন্নতি হয়েছে। আবার সব যোগ্যতা থাকার পরও পদোন্নতি-বঞ্চিত থাকতে হয়েছে কিছু কর্মকর্তাকে। গেল বছর একাধিকবার সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হলেও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এ সংক্রান্ত বিধিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নিলেও পরবর্তীতে তা থেকে সরে আসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। অপরদিকে, বছরের পর বছর মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোতে প্রায় ৯০ হাজার মামলা জোটের অবস্থা লেজেগোবরে।

তথ্য সচিবের বাধ্যতামূলক অবসর : গত ১৬ অক্টোবর তথ্য ও সমপ্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মকবুল হোসেনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় সরকার। চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার বছর খানেক আগে প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তাকে এভাবে বিদায় দেয়া নিয়ে প্রশাসনে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দেয়। নিজেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হল শাখার সাবেক সহসভাপতি পরিচয় দিয়ে মকবুল হোসেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, যত দিন বেঁচে আছি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়েই বেঁচে থাকব।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকারি চাকরি আইন-২০১৮-এর ধারা ৪৫ অনুযায়ী, জনস্বার্থে সরকারি চাকরি থেকে সচিব মকবুল হোসেনকে অবসর দেয়া হলো। কোনো সরকারি কর্মচারীর চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর যেকোনো সময় সরকার জনস্বার্থে প্রয়োজন মনে করলে কারণ দর্শানো ছাড়াই তাকে চাকরি থেকে অবসর দিতে পারবে। মকবুল হোসেনের চাকরির মেয়াদ ছিল আগামী বছরের ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত।

পুলিশে বাধ্যতামূলক অবসর : গত ১৬ অক্টোবর পুলিশ সুপার (এসপি) পদমর্যাদার কর্মকর্তা মো. আলী হোসেন ফকিরকে সরকারি চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়। এরপর গত ১৮ অক্টোবর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মীর্জা আবদুল্লাহেল বাকী ও মো. দেলোয়ার হোসেন মিঞা এবং পুলিশ সদর দপ্তরের এসপি (টিআর) মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চৌধুরীকে চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই অবসরে পাঠানো হয়। এরপর ৩১ অক্টোবর দুই অতিরিক্ত ডিআইজিকেও বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়। তারা হলেন ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মাহবুব হাকিম ও সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আলমগীর আলম।

গত ২১ নভেম্বর সরকারি চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছে এসপি ব্যারিস্টার জিল্লুর রহমানকে। এরপর ৩১ অক্টোবর দুই অতিরিক্ত ডিআইজিকেও বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়। তারা হলেন— ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মাহবুব হাকিম ও সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আলমগীর আলম। গত ২১ নভেম্বর সরকারি চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছে এসপি ব্যারিস্টার জিল্লুর রহমানকে। সর্বশেষ ২০ ডিসেম্বর অপরাধ তদন্ত বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. মুনির হোসেনকে অবসরে পাঠিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

প্রশাসনে পদোন্নতি পদের চেয়ে কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি : গত ২ নভেম্বর উপসচিব পদে পদোন্নতির এক দিন পর ১৭৫ জনকে পদোন্নতি দিয়ে যুগ্ম সচিব করেছে সরকার। প্রশাসনিক কাঠামোয় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই পদে পদোন্নতি পাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই কর্মকর্তারা খুশি হয়েছেন। তবে পদোন্নতি হলেও বেশির ভাগ কর্মকর্তাকেই কাজ করতে হবে আগের পদেই।

অর্থাৎ তারা উপসচিব হিসেবে যে কাজ করে আসছিলেন, এখনো সে কাজই করতে হবে। কারণ, এই পদোন্নতির পর নিয়মিত পদের চেয়ে কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে। নতুন পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়ে এখন সরকারের যুগ্ম সচিবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৮৮ জন। কিন্তু প্রশাসনে যুগ্ম সচিবের নিয়মিত পদ আছে ৫০২টি।

এই পরিসংখ্যান বলছে, নিয়মিত পদের চেয়ে ৩৮৬ জন যুগ্ম সচিব বেশি। এ কারণে এসব কর্মকর্তাকে স্বাভাবিকভাবেই আগের পদে কাজ করতে হবে। অন্য অনেককেও আগের পদে কাজ করতে হবে। কারণ, অতিরিক্ত সচিবের ক্ষেত্রেও নিয়মিত পদের চেয়ে কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি। এ জন্য ওই পদের অনেক কর্মকর্তা এখন যুগ্ম সচিবের কাজ করছেন।

আবার এর আগে যারা যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন, তাদেরও অনেকে এক ধাপ নিচের পদে, অর্থাৎ উপসচিব পদে কাজ করছেন। ফলে, যুগ্ম সচিবের নিয়মিত পদ খালি হলে তারা আগে অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা। এ কারণে নতুন পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম সচিব হওয়া কর্মকর্তাদের খুব শিগগিরই নিয়মিত যুগ্ম সচিব পদে কাজ পাওয়া সহজ হচ্ছে না। বর্তমানে অতিরিক্ত সচিবের নিয়মিত পদ আছে ২১২টি। এরসঙ্গে সমপর্যায়ের বিভিন্ন দপ্তরে প্রেষণে (নির্ধারিত পদের বাইরে অন্যান্য দপ্তর বা সংস্থায় নিয়োগ) থাকা পদ আছে আরও ১২৫টির মতো। সব মিলিয়েও অতিরিক্ত সচিবের পদ দাঁড়ায় ৩৩৭টিতে। কিন্তু কর্মরত অতিরিক্ত সচিব ছিলেন ৪১৪ জন। অর্থাৎ পদের চেয়ে ৭৭ জন অতিরিক্ত সচিব বেশি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, পর্যাপ্ত শূন্য পদ না থাকলেও পদোন্নতির এই প্রবণতা চলছে মোটামুটি এক যুগ ধরে। এ কারণে পদোন্নতি পেলেও বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তাকে কাজ করতে হয় আগের পদেই। অবশ্য কর্মকর্তারা বলছেন, সময় ও যোগ্য হলে পদোন্নতি হওয়া উচিত।

এদিকে একই কারণে উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি পাওয়া ২৫৯ কর্মকর্তার মধ্যে অধিকাংশকেই আগের পদে দায়িত্ব পালন করতে হবে। প্রশাসন ক্যাডারসহ বিভিন্ন ক্যাডারের আড়াই শতাধিক কর্মকর্তাকে পদোন্নতির পর এখন সরকারের উপসচিবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৮৯৩ জন। এ পদে কার্যত নিয়মিত পদ আছে হাজারখানেক। যদিও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলছে, সারা দেশে সমপর্যায়ের পদগুলো মিলিয়ে উপসচিব বা সমপর্যায়ের পদ আছে এক হাজার ৭৫০টি। করোনা মহামারিতে প্রায় তিন বছর স্বাভাবিক নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ ছিল। এতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তৈরি হয় জনবল সংকট। সরকারি দপ্তরগুলোয় দুই দফায় বয়সে ছাড়া দিয়ে নিয়োগের নির্দেশনা দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়

একই দিনে ২৩ জেলায় নতুন ডিসি : গত ২৩ নভেম্বর মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। ওই দিন রাতে ২৩ জেলার ডিসি পদে পরিবর্তন আনা হয়। ঢাকা, কুমিল্লা, পটুয়াখালী, টাঙ্গাইল, বরিশাল, সুনামগঞ্জ, খুলনা, গোপালগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কুড়িগ্রাম, রংপুর, সিরাজগঞ্জ, ঝালকাঠি, ফরিদপুর, খাগড়াছড়ি, ময়মনসিংহ, বগুড়া, কিশোরগঞ্জ, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কক্সবাজার, জয়পুরহাট ও মাগুরায় নতুন জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়।

ধর্ষণ মামলায় উপসচিব বাধ্যতামূলক অবসরে : উপসচিব এ কে এম রেজাউল করিম রতনকে গত ২১ নভেম্বর বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। ধর্ষণ মামলার অভিযোগে তিনি সাময়িক বরখাস্ত থাকা অবস্থায় গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। এরপর বিভাগীয় মামলায় দোষী প্রমাণিত হওয়ায় চাকরি হারালেন তিনি। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিভাগীয় মামলায় ‘অসদাচরণ’-এর অভিযোগে এ উপসচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর কারণ দেখানো হয়েছে। উপসচিব রেজাউল রতন শিক্ষা ক্যাডারের ১৪ ব্যাচের কর্মকর্তা হিসেবে সরকারি চাকরি শুরু করেছিলেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেন।

সরকারের ঘাড়ে ৯০ হাজার মামলা : উচ্চ আদালতে বিচারাধীন সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন আইন-সংক্রান্ত মামলাটি বেশ সাড়া জাগানো। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনের মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে নেয়া হয়। এই সংশোধনের বিরুদ্ধে রিট হলে হাইকোর্ট সরকারের বিরুদ্ধে রায় দেন। আপিল বিভাগও হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে রিভিউর অনুমতি চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এখন মামলাটি রিভিউ নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। অর্থাৎ অর্ধযুগেরও বেশি সময় ধরে মামলাটি ঝুলছে। মোবাইল কোর্ট-সংক্রান্ত আইনের মামলাটিও আলোচিত। ২০০৯ সালে প্রণীত মোবাইল কোর্ট আইনের বিরুদ্ধে ২০১১ সালের ১১ অক্টোবর এক ভুক্তভোগী রিট করেন। এ মামলায় ২০১৭ সালের ১১ মে হাইকোর্ট সরকারের বিরুদ্ধে রায় দেন।

মামলাটি এখন আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায়। অর্থাৎ গেল পাঁচ বছরেও মামলাটির শুনানি হয়নি। হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে এ রকম সরকার-সংশ্লিষ্ট ৯০ হাজারের মতো মামলা নিয়ে লেজেগোবরে পরিস্থিতিতে পড়েছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। এই বৃত্ত থেকে বের হতে বড় উদ্যোগ নিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এ ছাড়াও মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের বিদায়, তার স্থলে কবির বিন আনোয়ারের যোগদান ও আগামী ৩১ ডিসেম্বর ছয় সচিবের মেয়াদ শেষে অবসর দেয়ার ঘটনা বেশ আলোচনায় আছে। এ ছাড়া বছরের শুরু থেকে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা ও প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতে মন্ত্রীদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার কড়া নির্দেশনা দিয়েছিল সরকার। সেই নির্দেশনার পর প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আনা ও যথাযথভাবে কাজ শেষ করার প্রতিযোগিতায় নেমেছিল মন্ত্রণালয়গুলো।

Link copied!