ডিসেম্বর ২৯, ২০২২, ০১:২০ এএম
নিয়ন্ত্রক সংস্থার নানা চেষ্টা ও পদক্ষেপের পরও বিমা খাতে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসেনি। এখনো অতিরিক্ত ব্যয়ের নামে প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে, চলছে কমিশন-বাণিজ্য। বন্ধ হয়নি গ্রাহক ভোগান্তি, দাবি পরিশোধে দীর্ঘ অপেক্ষা তো রয়েছেই। মূলত আর্থিক ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের কারণে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম দূর করতে পারছে না বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
খাত সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে। নন-লাইফ খাতের দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন অত্যন্ত পরিচিতমুখ ও দেশের শীর্ষস্থানীয় এক ব্যবসায়ী। শুধু বিমাতেই নয়, দেশের ব্যাংকিং খাতেও রয়েছে তার বিনিয়োগ। সাম্প্রতিককালে একটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন।
এছাড়া প্রায় ২৪টি খাতে তিনি ব্যবসা পরিচালনা করছেন। কিন্তু বিপত্তি বাধে অন্যখানে। বিমা আইন-২০১০ অনুসারে কোনো বিমাকারীর পরিচালক সমশ্রেণির অন্য বিমা কোম্পানি অথবা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে একই সাথে পরিচালকের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। কিন্তু এরপরও তিনি ব্যাংক ও বিমায় একই সাথে পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
বিষয়টি জানার পরও পদক্ষেপ নিতে পারছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। আবার ইসলামি কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স নামে আরেকটি নন-লাইফ বিমা প্রতিষ্ঠান ধর্মীয় লেবাস ধারণ করে জড়িয়েছে অনৈতিক কার্যক্রমে। প্রতিষ্ঠানটির সিইওর বিরুদ্ধে অবৈধভাবে নিজ ছেলেকে অভিজ্ঞতা ছাড়াই বেশি বেতনে একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেয়া, ভুয়া উন্নয়নকর্মী দেখিয়ে কমিশনের নামে বিপুল অর্থ ব্যয়, নিয়ন্ত্রক সংস্থার চিঠি জাল করাসহ বিভিন্ন অনিয়মের প্রমাণ পায় বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এসব বিষয়ে ওই সিইওকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়ার সিদ্ধান্তও নেয় সংস্থাটি। কিন্তু কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত এই পদক্ষেপ থেকে সরে আসে আইডিআরএ।
এদিকে জীবন বিমা খাতে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স নিয়ে হাজার হাজার পলিসিহোল্ডারের অভিযোগ সত্ত্বেও কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক রুবিনা হামিদ।
সূত্র জানায়, রুবিনা হামিদ প্রভাবশালী একজন মন্ত্রীর বোন। ইতোপূর্বে কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন আদালত থেকে সানলাইফের চেয়ারম্যান ও সিইওসহ বিভিন্ন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাৎ সম্পর্কিত প্রায় অর্ধশত মামলা হলেও নির্বিঘ্নে সব কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। এদিকে আইনের আশ্রয় নিয়েও কাজ না হওয়ায় আরো হতাশায় ডুবেছে খেটেখাওয়া সাধারণ গ্রাহক। ,সানফ্লাওয়ার লাইফ নামে আরেক বিমা কোম্পানির চেয়ারম্যান মেজর (অব.) এম এ মান্নানের বিরুদ্ধে রয়েছে পলিসি গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ খেলাপি হওয়ার।
এছাড়া বিমা আইন-২০১০ লঙ্ঘন করে এক পরিবারের থেকে সাতজনেরও অধিক পরিচালক রয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে। এরপরও গ্রাহক স্বার্থ রক্ষায় কার্যকরি কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা। অবশ্য সম্প্রতি কোম্পানিটির চেয়ারম্যান ও সিইওকে আইডিআরএ কার্যালয়ে ডেকে সমস্যা উত্তরণে পরামর্শ দিলেও কোনো জোর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। অনিয়মের বিষয়ে জানতে ইসলামি কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মীর নাজিম উদ্দিনকে ফোনকল দেয়া হলে তিনি রিসিভ করেননি। পরে মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও কোনো প্রত্যুত্তর করেননি। অপরদিকে দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্সেও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদী খানমের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
শুধু উল্লিখিত কোম্পানিগুলোই নিয়ম ভাঙছে তা নয়, বিমা খাতে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই এমন অনিয়মের ঘটনা রয়েছে। সাধারণ কয়েকটি ক্ষেত্রে বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা কিছুটা পরিবর্তন আনতে পারলেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে এখনো তারা সেই আগের মতোই নিশ্চুপ হয়ে আছে। এখনো বিমা খাতের সিইওদের চাকরি নিশ্চয়তা দিতে পারেনি আইডিআরএ। ফলে চাকরি বাঁচাতে পরিচালকদের নির্দেশ মেনেই কাজ করতে হচ্ছে তাদের।
যদিও পরিচালকদের নির্দেশ মানতে গিয়ে কিছুটা জরিমানার সম্মুখীন হতে হচ্ছে প্রধান নির্বাহীদের, কিন্তু তাদের হয়ে কোম্পানিই সেই জরিমানা পরিশোধ করছে। আবার নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক পদ থেকে অপসারণের কোনো সিদ্ধান্ত এলেও তা পরিচালকদের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়ে যাচ্ছে। ফলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার বদলে পরিচালকদের কথামতো কাজ করতেই তারা বেশি আগ্রহী। ফলে উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে আইনের যথাযথ প্রয়োগ।
কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন ব্যর্থ হচ্ছে, এ প্রশ্নের উত্তরে আইডিআরএর এক শীর্ষ কর্মকর্তা দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, যারা আইন তৈরি করছে তারাই আইন ভাঙছে। আমরা কি করতে পারি? আমরা কিছু করতে গেলে অমুক জায়গা থেকে, তমুক জায়গা থেকে ফোন আসে। যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো আমাদের স্বতন্ত্র একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে সক্ষমতা তৈরির সুযোগ দেয়া না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত বিমা খাতের পরিবর্তন সম্ভব নয়। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট নাসিরউদ্দিন আহমেদের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তিনি দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, বিমার সব কার্যক্রম সিইওদের মাধ্যমে হয়ে থাকে। যদি কোনো অনিয়ম হয় তবে তাদের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। তবে যদি কোনো কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ সিইওকে বাধ্য করে অনিয়ম করতে তবে সে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে জানাতে পারে।
এ ছাড়া বিমা আইনে এক পরিবার থেকে দুইয়ের অধিক পরিচালক না থাকা ও তাদের সম্মিলিত শেয়ার ১০ শতাংশের বেশি ধারণ না করার বিষয়ে বলা হলেও তা মানছে না অনেকেই। এই নীতি লঙ্ঘনের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জানান, এগুলো নিয়ে আইনে কোনো বাধা নেই। ডেল্টা লাইফে তো এক পরিবার থেকে ২২ শতাংশের বিষয়ে সরকার অনুমোদন দিয়েছে। এছাড়া তিনজন পরিচালক আছে। এগুলো কোনো ইস্যু নয়। কোনো দুর্নীতি হয়েছে কি-না, সেটি বলেন। এছাড়া এক পরিবার থেকে ১০ শতাংশ শেয়ার না থেকেও ফারইস্ট ও প্রাইম ইন্স্যুরেন্সে যে অনিয়ম হয়েছে সেটিকেও স্মরণ করিয়ে দেন। কোম্পানিগুলোকে আইন পরিপালনে বাধ্য করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন ব্যর্থ হচ্ছে, তা জানতে আইডিআরএর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সেখানে মুখপাত্র না থাকায় কেউই এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি।
এরপর নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যানের কাছে এ বিষয়ে উত্তর জানতে চেয়ে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি এতে কোনো সাড়া দেননি। এমনকি পরবর্তীতে ফোনকল করা হলেও তাতে সাড়া দেননি তিনি।