Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২৪,

পেরিয়েছে মোহন হত্যার ১৭ বছর

স্থগিতাদেশে বিচার বন্ধ

শরিফ রুবেল

জানুয়ারি ১২, ২০২৩, ০১:২১ পিএম


স্থগিতাদেশে বিচার বন্ধ
  • ১০ বছরে শুনানি পেছাল ৯৫ বার
  • বিচার চেয়ে এলাকাছাড়া পরিবার
  • পূর্ণ তদন্তে বাদীকেই করা হয়েছে আসামি
  • উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ কাটবে কবে জানা নেই
  • সব হত্যামামলা মনিটরিং জরুরি : মত বিশেষজ্ঞদের

আরিফুল শেখ মোহন। বগুড়া সদর উপজেলার বাসিন্দা। ২০০৬ সালে দলীয় কর্মসূচিতে হট্টগোলের মধ্যে কয়েকজন দুর্বৃত্ত মোহনকে বেধড়ক মারধর করে। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে শত শত মানুষের সামনেই হত্যা করা হয় তাকে। হত্যাকাণ্ডের পর আতাউর রহমান শম্ভু নামে এক যুবদল নেতা বাদী হয়ে ২১ জনকে আসামি করে সদর থানায় মামলা করেন। 

তবে তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও তদন্তে সমীকরণ পাল্টে যায়। দীর্ঘ তদন্ত শেষে বাদী শম্ভুকেই আসামি করে মামলা করে চার্জশিট দেয় পুলিশ। জড়ানো হয় স্থানীয় বিএনপির আরও অনেক নেতাকে। হত্যার পর কেটে গেছে ১৩ বছর। কিন্তু বিচার নিয়ে ধোঁয়াশা এখনো কাটেনি। বিচার শুরু হবে কবে তারও নেই কোনো নিশ্চয়তা। 

এ পর্যন্ত মামলার শুনানির তারিখ পিছিয়েছে ৯৫ বার। এর মাঝে কয়েক দফা সরকার বদলেছে। নিহতের পরিবার হয়েছে এলাকা ছাড়া। তবে মামলা যেখানেই ছিল সেখানেই রয়ে গেছে। বিচারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার তাগিদ নেই কারোরই। রাষ্ট্রপক্ষও তেমন কোনো কার্যকরী উদ্যোগ নেয়নি। বর্তমানে মামলাটি বগুড়ার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত-৩ এ ঝুলে আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রথমে বিচারক সংকট এবং পরবর্তীতে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের কারণে থেমে আছে মামলার বিচার। 

এদিকে মামলার সর্বশেষ শুনানিতে আদালত বলেছে মামলার ৮ নম্বর আসামি ভিপি সাইফুল ইসলাম উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়েছেন। এ বিষয়ে আদালত রুল ইস্যু করেন। তাই হাইকোর্টের রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মামলার বিচারকার্য স্থগিতই থাকবে। শুধু মোহন হত্যামামলাই নয়, এছাড়াও বেশ কয়েকটি হত্যামামলা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের অদক্ষতা, সাক্ষী হাজিরে অসহযোগিতার কারণে মামলা ঝুলে থাকে।

বিচারপ্রার্থীদের অভিযোগ, অনেক সময় সাক্ষী এলেও তাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়। আসামিপক্ষের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে এমন কাজ করা হয়। আর রাষ্ট্রপক্ষ নিজেও অনেক সময় অযথা সময়ের আবেদন করে। এতে মামলা নিষ্পত্তিতে দেরি হয়। 

এমনকি সরকারি সাক্ষী (ডাক্তার-পুলিশ) হাজির করতে গাফিলতি করেন সরকারি কৌঁসুলিরা। তাদের হাজির না করেই বলেন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। মানে দায় এড়ানোর চেষ্টা। আবার শুনানির তারিখ এলেই রাষ্ট্রপক্ষ প্রস্তুত নয় বলে আদালতে আবেদন করা হয়। আদালতও নির্বিকার হয়ে সময় আবেদন মঞ্জুর করেন। ফলে মামলার বিচারপ্রক্রিয়া ঝুলে যায়। একসময় বিচারপ্রার্থীরা হতাশ হয়ে রায়ের আশা ছেড়ে দেন। বিরক্তি চলে আসে আদালতের প্রতি।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালত যখন কোনো আসামির ফাঁসি বহাল রাখে তখন ওই রায়ের বিরুদ্ধে সাধারণত তিনি রিভিউ পিটিশন দায়ের করেন। সেই রিভিউর শুনানি ও নিষ্পত্তি হতে ছয় মাস থেকে অনেক সময় দেড় থেকে দুই বছর লেগে যায়। বিচারের এই দীর্ঘসূত্রতায় অপরাধীর সর্বোচ্চ সাজা কার্যকর হলেও তা সমাজে অপরাধ দমনে কেমন প্রভাব ফেলে এ নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন। 

বিচারাধীন হত্যামামলাগুলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যেসব মামলার সাক্ষী আসছে না এবং বারবার সময় চায় রাষ্ট্রপক্ষ, সেগুলোর বেশির ভাগই খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ, মাদক, অস্ত্র ও ছিনতাইয়ের মামলা। মারাত্মক অপরাধের এসব মামলায় সহজে কেউ সাক্ষ্য দিতে চান না। আর সাক্ষী না আসায় মামলার শুনানি পেছাতে বারবার সময় নেয় রাষ্ট্রপক্ষ। কোনো কোনো মামলায় ২০০ থেকে ৩০০ বারও সময় নেয়া হয়েছে এমন নজিরও রয়েছে। তবে এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সরকারি কৌঁসুলিরা সাক্ষীদের হাজির করতে না পারার পেছনে পুলিশকে দোষারোপ করেন। তারা বলছেন, সাক্ষীদের হাজির করার দায়িত্ব পুলিশের। 

তারা তাদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে আমাদের কিছু করার নেই। আমরা তাদের বারবার বলতে পারি কিন্তু এ ছাড়া অন্য কিছু করতে পারি না। এদিকে গেল বছর ২০২১ সালে আপিল নিষ্পত্তি হওয়া বেশ কয়েকটি হত্যামামলা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মামলা দায়ের থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি মামলার চূড়ান্ত বিচারকাজ শেষ করতে গড়ে সময় লেগেছে প্রায় ২৫ বছরেরও অধিক। কোনোটিতে পার হয়েছে দুই যুগও। বিচারিক আদালত দ্রুত রায় দিলেও উচ্চ আদালতে এসে আটকে গেছে। 

তবে উচ্চ আদালতে ঝুলে থাকা চাঞ্চল্যকর মামলাগুলো সচলের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলেও জানা গেছে। বাদী, আসামি, কৌঁসুলিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফৌজদারি মামলায় প্রতিবেদন দেরিতে আসা, আসামিপক্ষের বারবার সময়ের আবেদন, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ, বছরের পর বছর সাক্ষীদের হাজির করতে না পারাসহ নানা কারণে নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এতে আদালতের কর্মঘণ্টা ব্যাহত হচ্ছে। বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগও বাড়ছে। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বাদী-বিবাদীরা।

মোহন হত্যামামলার বিচারকাজ শুরু কেন হচ্ছে না, জানতে চাইলে বগুড়া জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি আবদুল মতিন বলেন, শুরু থেকেই গুরুত্ব সহকারে মামলাটি দেখা হচ্ছে। মূলত বিচারক সংকটের কারণে এই মামলা এখন ঝুলে আছে। তবে বর্তমানে মামলাটি অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত-৩ এ স্থানান্তর করা হয়েছে। আসামিদের একজন হাইকোর্টে আবেদন করায় মামলাটি স্থগিত রয়েছে। 

স্থগিতাদেশ কেটে গেলে মামলার বিচারকাজ শুরু হবে। যেকোনো হত্যামামলাগুলো বিলম্বিত হওয়ার বিষয়ে ফরিদপুর জজকোর্টের আইনজীবী মোসাদ্দেক আহম্মেদ বশির বলেন, বিচারের সাথে দীর্ঘসূত্রতা বেমানান। একজন আসামিকে কেন ১০-১২ বছর কনডেম সেলে থাকতে হবে। আসলে আমাদের দেশে সিস্টেমেই গলদ আছে। এই দীর্ঘসূত্রতায় আসামি ও ভিকটিম দুজনই হয়রানির শিকার হতে পারেন। 

নিম্ন আদালতে কোনো আসামির ফাঁসি হলে ভিকটিমের স্বজনরা চান দ্রুত ফাঁসি কার্যকর হোক। কিন্তু সব বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সেই দণ্ড কার্যকরে যদি ১৫-২০ বছর চলে যায়, তাহলে বিচারের প্রতি বিচারপ্রার্থীর এক ধরনের আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়।

মোহন হত্যামামলার নথি থেকে জানা যায়, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী শহরের সাতমাথায় সপ্তপদী মার্কেটের ছাদে দেশীয় অস্ত্র, ককটেলসহ অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে আসামিরা অবস্থান নেয়। একপর্যায়ে তারা ছাত্রঐক্যের সমাবেশের নেতাকর্মীদের দিকে ককটেল নিক্ষেপ করতে করতে এগিয়ে আসে। এর মধ্যে নেতাকর্মীরা ছোটাছুটি শুরু করলে যুবদল ১ নম্বর ওয়ার্ড আঞ্চলিক কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক আরিফুল শেখ ওরফে মোহন মাঝে পড়ে যায়। আসামিরা মোহনকে ছাত্রঐক্যের মনে করে একের পর এক আঘাত করতে থাকে। একই সঙ্গে লাঠি দিয়েও আঘাত করা হয় তাকে। 

মোহনের মৃত্যু নিশ্চিত হলে তার লাশের ওপর উঠে উল্লাস করে খুনিরা। এ ঘটনায় তৎকালীন যুবদল নেতা আতাউর রহমান বাদী হয়ে ২১ জনের বিরুদ্ধে হত্যামামলা করেন। প্রথম মামলায় ত্রুটির অভিযোগ করে আদালতে নতুন করে হত্যামামলা হয়। এই মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) তৎকালীন পরিদর্শক আব্দুল মান্নানকে। তিনি তদন্তের পাশাপাশি আদালতে দেয়া আসামিদের স্বীকারোক্তি বিশ্লেষণ করে ২০০৭ সালের ১৩ অক্টোবর অভিযোগপত্র দাখিল করেন। 

আব্দুল মান্নান অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন, প্রকৃত দোষীদের আড়াল করতে ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয় এমন ব্যক্তিদের আসামি করেন প্রথম মামলার বাদী আতাউর রহমান। মামলার অধিকতর তদন্তে ১৩ জনকে সম্পৃক্ত করে তিনি (আবদুল মান্নান) অভিযোগপত্র দিয়েছেন শাহ আলম ওরফে ককটেল আলম, সোনা মিয়া, জেলহজ্ব ওরফে জুলহক, আতাউর রহমান ওরফে শম্ভু, মিজানুর রহমান, জহুরুল ইসলাম, বিএনপি চেয়ারপারন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও সাবেক সাংসদ হেলালুজ্জামান তালুকদার লালু, বগুড়া জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি রেজাউল করিম বাদশা ও সাইফুল ইসলাম সাইফুল, সাবেক সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন চান, জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি সিপার আল বখতিয়ার, জাকিউল্লা ওরফে আপেল ও খায়রুল বাশারের বিরুদ্ধে। এ অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হবে কি না, সে বিষয়টির  সিদ্ধান্ত হয়নি। তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল মান্নান উল্লেখ করেন আলোচিত এই মামলার অভিযোগপত্র ২০০৭ সালে দেয়া হয়। এজাহারের বাইরে অনেক নাম পাওয়া গেছে অন্য আসামিদের স্বীকারোক্তি ও টেলিভিশনের ভিডিও দৃশ্য থেকে।

খোঁজ নেই মোহনের পরিবারের : মোহন তার বাবা-মায়ের সঙ্গে বগুড়া পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের গোয়ালগাড়ি এলাকায় বসবাস করতেন। ছেলেকে হারানোর কিছুদিন পর মা মারা যান। বাবা শহরের অন্য এলাকায় বিয়ে করেছেন। 

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, মোহনের পরিবার যে বাড়িতে থাকতেন তা বিক্রি করা হয়েছে প্রায় আট বছর আগে। মোহন হত্যার সময় এক নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন বগুড়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি শাহ মেহেদী হাসান হিমু। তিনি বলেন, এই এলাকায় থেকে বাড়িঘর বিক্রি করার পর মোহনের পরিবারের কারো খোঁজখবর নেই। এই কারণে মামলারও কেউ খবর নেয় না।

Link copied!