Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

ডেঞ্জার জোন নেপাল

বিমান দুর্ঘটনায় নিহত ৬৮

নুর মোহাম্মদ মিঠু

জানুয়ারি ১৬, ২০২৩, ১০:২২ এএম


বিমান দুর্ঘটনায় নিহত ৬৮
  • আজ এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা
  • ৩০ বছরে ৩০ দুর্ঘটনা, হঠাৎই বদলে যায় আবহাওয়া, দুর্গম পাহাড়ে এয়ারস্ট্রিপ
  • হিমালয়ের একাধিক শৃঙ্গ, বিমান পরিষেবায় সংকট ও ঘন কুয়াশাই দুর্ঘটনার কারণ —বিশেষজ্ঞদের অভিমত

বিমান দুর্ঘটনার ডেঞ্জার জোনে পরিণত হয়েছে হিমালয় কন্যাখ্যাত নেপাল। কখনও দেশটির মাঝ আকাশে বিমানে আগুন, কখনও অবতরণের সময় ধাক্কা খেয়ে ভেঙে পড়া, কিংবা রানওয়ে ছাড়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই পাহাড়ের বুকে হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রায় প্রতি বছরই ঘটছে। ৩০ বছরে ৩০টিরও বেশি মারাত্মক বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে দেশটিতে। এতে বহু মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। কেন বারবার হিমালয়ের কোলে অবস্থিত দেশটিতে বিমান দুর্ঘটনা ঘটছে— এমন প্রশ্নে বিশেষজ্ঞরা তিনটি কারণের কথা বলছেন। 

প্রথমত, নেপালের ভূপ্রাকৃতিক গঠন। দেশটির অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে ছয় হাজার মিটারের বেশি হওয়ায় এখানে বিমানে পরিষেবা দেয়া খুবই কঠিন। এর মধ্যে আবার পোখরা বিমানবন্দরের কাছেই হিমালয়ের একাধিক শৃঙ্গ থাকায়ও দুর্ঘটনা ঘটছে বেশি। 

দ্বিতীয়ত, ঘন কুয়াশার দাপট। নেপাল প্রশাসনের দাবি— বিমান দুর্ঘটনার বেশির ভাগই ঘটেছে ঘন কুয়াশার কারণে। শীতকালে দৃশ্যমানতা কমে যাওয়ায় অনেক সময়ই উড়ার পর সোজা গিয়ে ধাক্কা মারে পাহাড়ের গায়ে। 

তৃতীয়ত, নেপালের অর্থনীতি। কাঠমাণ্ডুর আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় মেয়াদোত্তীর্ণ বিমান চালানোর অভিযোগও রয়েছে। এর জেরেও দুর্ঘটনা ঘটছে বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের। এভারেস্টসহ পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ১৪টি পর্বতের আটটিই নেপালে। দেশটির আবহাওয়া হঠাৎ করেই বদলে যায় এবং বেশির ভাগ এয়ারস্ট্রিপ দুর্গম পাহাড়ি এলাকায়। এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ বিমানবন্দরগুলোতে অবতরণ করতে অত্যন্ত চৌকস ও অভিজ্ঞ বৈমানিকেরও বেগ পেতে হয়।

বহুবিধ কারণে দেশটিতে বিমান দুর্ঘটনা যেন ধারাবাহিকতায় রূপ নিয়েছে। গত বছরের মে মাসে তারা এয়ারের একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনায় ২২ যাত্রী নিহতের পর গতকালও দেশটির পোখরায় ৭২ যাত্রী নিয়ে ইয়েতি এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়। এ ঘটনায় ৭২ জনই নিহতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। গতকাল এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ৬৮ জন নিহতের খবর নিশ্চিত করে দেশটির প্রশাসন। 

এ ঘটনায় দেশটিতে আজ এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। ৬৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হলেও বাকিদের উদ্ধারে কাজ চলার কথা জানিয়েছে দেশটি। উদ্ধারকাজে অংশ নেয়া এক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ৭২ যাত্রীর মধ্যে ৬৮ যাত্রী ও চারজন ক্রুু। মূলত রাজধানী কাঠমাণ্ডু থেকে পোখরার উদ্দেশে যাওয়ার সময়ই বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। 

দেশটির পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অজয় কেসি বলেছেন, বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে দুই পাহাড়ের মাঝের একটি গিরিগাদে। সেখানে পৌঁছানোই তাদের জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। তবে দুর্ঘটনার বিষয়ে দেশটির বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র জগন্নাথ নিরুলা রয়টার্সকে বলেন, উদ্ধার অভিযান চলছে। দুর্ঘটনার সময় আবহাওয়া পরিষ্কার ছিল। স্থানীয় টেলিভিশনে দুর্ঘটনাস্থল থেকেও ঘন কালো ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে এবং উদ্ধারকর্মী ও স্থানীয় লোকজনকে বিমানটির ধ্বংসাবশেষের চারপাশে জড়ো হতেও দেখা যায়।

ইয়েতি এয়ারলাইন্সের মুখপাত্র সুদর্শন বারতৌলা জানিয়েছেন, তাদের পরিচালিত টুইন-ইঞ্জিন এটিআর ৭২ মডেলের এই বিমানটিতে ৭২ জন আরোহীদের মধ্যে দুটি শিশু, চারজন ক্রু সদস্য এবং ১০ জন বিদেশি নাগরিক ছিলেন। ফ্লাইট ট্র্যাকিং ওয়েবসাইট ফ্লাইটরাডার টোয়েন্টিফোরের তথ্য অনুযায়ী, দুর্ঘটনাকবলিত বিমানটির বয়স ১৫ বছর। 

বিশ্বব্যাপী বহুল ব্যবহূত টুইন ইঞ্জিন টার্বোপ্রপ বিমান এটিআর ৭২ হচ্ছে এয়ারবাস এবং ইতালির লিওনার্দোর যৌথ উদ্যোগে নির্মিত। ইয়েতি এয়ারলাইন্সের ওয়েবসাইট অনুসারে, সংস্থাটির বহরে ছয়টি এটিআর৭২-৫০০ মডেলের বিমান রয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, নেপালে বিমান দুর্ঘটনা অস্বাভাবিক নয়। কারণ এভারেস্টসহ বিশ্বের ১৪টি সর্বোচ্চ পর্বতের মধ্যে আটটির অবস্থান এই দেশটিতে এবং এই কারণে আবহাওয়া হঠাৎ পরিবর্তন হতে পারে এবং বিমান চলাচলের জন্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহাল বিমান দুর্ঘটনার পর মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডেকেছেন বলে নেপালের সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছে। 

এদিকে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, দুর্ঘটনাকবলিত বিমানটিতে অন্যান্য যাত্রীদের মধ্যে পাঁচ ভারতীয়, চার রাশিয়ান, এক আইরিশ এবং দুই দক্ষিণ কোরীয় নাগরিক ছিলেন। তবে এই ফ্লাইটে কোনো বাংলাদেশি নাগরিক ছিল না বলে জানা গেছে। জানা গেছে, ১৯৪৯ সালে নেপালের মাটিতে প্রথম উড়োজাহাজ অবতরণ করে। এরপর ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াভহ দুটি দুর্ঘটনা ঘটে পিআইএর ফ্লাইটে, ১৯৯২ সালে। ওই ঘটনায়  মারা যায় ১৬৭ জন। এরপরের ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে ২০১৮ সালের মার্চে। 

ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইউএস বাংলার একটি ফ্লাইট বিধ্বস্তের ওই ঘটনায় নিহত হয় ৫১ জন। ১৯৯২ সাল থেকে শুরু করে এ দুটিসহ আরও বেশ কিছু ভয়াবহ উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা ঘটেছে নেপালে। এর মধ্যে ২০২২ সালের মে মাসে তারা এয়ারলাইন্সের একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়। এতে ২২ জন আরোহী মারা যান। যার মধ্যে চারজনই ছিল ভারতের। ২০১৬ সালে একই কোম্পানির বিমান ২৩ জন আরোহী নিয়ে অবতরণের সময় দুর্ঘটনার শিকার হয়। এতে সব আরোহীর মৃত্যু হয়। 

২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে সিতা নামের একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়। ওই বিমানটিতে ত্রুটি দেখা দেয়ায় ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরুরি ভিত্তিতে অবতরণ করতে গেলে বিধ্বস্তের ঘটনা ঘটে। এতে ১৯ জন যাত্রী নিহত হয়। একই বছরের ১৪ মার্চ পোখরা থেকে জমসন বিমানবন্দরে যাওয়ার সময় জমসন বিমানবন্দরে একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়। এতে ১৫ জন যাত্রী নিহত হয়। ২০১১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বুদ্ধা এয়ারের মার্কিন বিচক্রাফট ১৯০০ডি উড়োজাহাজটি ললিতপুরের কাছে বিধ্বস্ত হয়। 

১০ ভারতীয় নাগরিকসহ ২২ যাত্রীর সবাই প্রাণ হারান। ২০১০ সালের ১৫ ডিসেম্বর তারা এয়ারের ডিএইচসি-৬ টুইন অটার উড়োজাহাজ লামিডান্ডা থেকে কাঠমাণ্ডু যাত্রা শুরুর অল্প কিছুক্ষণ পরেই বিধ্বস্ত হয়। তিন ক্রুসহ ২২ আরোহীর সবাই প্রাণ হারান। একই বছর আরও একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনায় কাঠমাণ্ডু থেকে লুকলা যাওয়ার পথে ২২ মিনিট ওড়ার পর অগ্নি এয়ারের ফ্লাইট ১০১ বিধ্বস্ত হয়। এতে ফ্লাইটে থাকা ১৪ জনই নিহত হন।

নেপালে উড়োজাহাজ বিধ্বস্তে ফখরুলের শোক

নেপালের পোখারায় গতকাল রোববার সকালে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে অন্তত ৪০ জন নিহতের ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শোক বার্তায় তিনি শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা ও নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করেন। নেপালের পোখারা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৭২ আরোহী নিয়ে ইয়েতি এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজ রোববার বিধ্বস্ত হয়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত দুর্ঘটনাকবলিত উড়োজাহাজ থেকে ৪০ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

বিধ্বস্ত হওয়া উড়োজাহাজটিতে পাঁচজন ভারতীয়, চারজন রাশিয়ান, একজন আইরিশ, দুইজন দক্ষিণ কোরিয়ান, একজন অষ্ট্রেলিয়ান, একজন ফ্রেঞ্চ  এবং একজন আর্জেন্টিনিয়ান নাগরিক ছিলেন বলে জানিয়েছে নেপাল এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ। টুইন ইঞ্জিনের এটিআর ৭২ মডেলের উড়োজাহাজটি ইয়েতি এয়ারলাইন্সের। এ এয়ারলাইন্সের মুখপাত্র সুদর্শন বার্তাউলা বলেন, ৭২ আরোহীর মধ্যে চারজন ক্রু সদস্য ছিলেন। সংবাদ সংস্থা এএনআই সূত্রের খবর, ইয়েতি এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজটি পোখারা থেকে কাঠমান্ডু যাচ্ছিল।  টেক অবের ২০ মিনিটের মধ্যেই কাস্কি জেলার কাছে সেটি ভেঙে পড়ে।

টিএইচ

Link copied!