Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪,

মাঘের শীতেও লোডশেডিং

মহিউদ্দিন রাব্বানি

জানুয়ারি ২৭, ২০২৩, ০১:৫৮ এএম


মাঘের শীতেও লোডশেডিং

আমরা যে পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিলাম তাতে কিছুটা ছন্দপতন হয়েছে —প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন, মহাপরিচালক, পাওয়ার সেল

  • উৎপাদন জ্বালানির আমদানি বন্ধ 
  • জ্বালানি সংকটে রামপাল ও পায়রায় উৎপাদন বন্ধ
  • ঘাটতি হাজার মেগাওয়াট

মাঘের শীতেও চলছে লোডশেডিং। হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিংয়ের কবলে দেশ। অথচ চাহিদা মাত্র ১০ হাজারের ঘরে। ডলার সংকটে কয়লা আমদানি করতে না পারায় বন্ধ হয়ে গেছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। উৎপাদন সংকটে পড়েছে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রেও। কারণ, সরবরাহ নেই চাহিদা মাফিক জ্বালানি। আগামী মাস থেকে সংকট আরও বাড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এক সময় ভুলতে বসা লোডশেডিং গত বছরের জুলাই মাসে ঘোষণা দিয়ে ফিরে আসে।

সে সময় বলা হয়েছে- অক্টোবর নাগাদ শীত এলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। কিন্তু তা ভুল প্রমাণিত হয়। শীতের ভরা মৌসুমেই এবার সাক্ষাৎ লোডশেডিংয়ের। শীত মৌসুমে গড় চাহিদা ১০ হাজার মেগাওয়াট কিন্তু উৎপাদন ৯ হাজারের মেগাওয়াটের কাছাকাছি। বাকিটা লোডশেডিং করতে হয়। শীতে বিদ্যুতের চাহিদা কম হলেও তা সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-পিডিবি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, কয়লা সংকটে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ থাকায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। ইউক্রেন- রাশিয়া সংকট, বিশ্ববাজারে জ্বালানি দাম বৃদ্ধি, দেশে ডলার সংকট, ডলারের বিপরীতে টাকার মান হ্রাসসহ নানা কারণে সরকার গত বছর থেকেই তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানি বন্ধ করেছে। এর পর থেকে তীব্র লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে পুরো দেশ। শীতের প্রভাবে নভেম্বর থেকে চাহিদা কমতে থাকে বিদ্যুতের। ফলে নভেম্বরে আর লোডশেডিং দেখা যায়নি। তবে ডিসেম্বরের শেষ দিকে তাপমাত্র কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও তেমন লোডশেডিং চোখে পড়েনি। জানুয়ারির শুরু থেকে আবারও লোডশেডিংয়ে ছন্দপতন।

পৌষ-মাঘ ভরা শীতের মৌসুম। গত পৌষ মাসেই ফের লোডশেডিংয়ের দেখা। সারা দেশে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ ও শীতল হওয়াতে বিদ্যুতে অতিরিক্ত চাহিদা ছিল না। পৌষ শেষে মাঘের শুরু থেকেই লোডশেডিংয়ের প্রবাহ বাড়তে থাকে।

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) দেয়া তথ্য মতে, ১ মাঘ সন্ধ্যা ৭টায় সর্বোচ্চ ৬৬৮ মেগাওয়াট ঘাটতি দেখা দেয়। দুই তারিখ সর্বোচ্চ এক হাজার ৯৫ মেগাওয়াট লোডশেডিং ছিল। ৩ মাঘ দুপুর ২টায় এক হাজার ২৫৫, ৪ মাঘ সকাল ১০টায় সর্বোচ্চ ৮৭৮, ৫ মাঘ সকাল ৭টায় সর্বোচ্চ ৭৭০, ৬ মাঘ সকাল ১০টায় ৫৩৭, ৭ মাঘ  সর্বোচ্চ ৪৭১, ৮ মাঘ সর্বোচ্চ ৯ হাজার ৭০৯ এবং ৯ মাঘ সর্বোচ্চ ৫১৬ মেগাওয়াট লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে দেশ। মূলত উৎপাদন কম হওয়ায় শীতের ভরা মৌসুমেও দেখতে হচ্ছে লোডশেডিং।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যদি ডলার সরবরাহ না করে তাহলে কয়লা আমদানি করা সম্ভব হবে না। এর আগে আমরা ডলার সংকটে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ করেছি। এখন কয়লা যদি আমদারি না হয় তাহলে এনার্জি খাত চলতে পারবে না। আমদানি করতে না পারলে ভেঙে পড়বে পুরো বিদ্যুৎ খাত। এদিকে শিগগিরই বাঁশখালির আরও একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উপাদনে আসার অপেক্ষায়। ফলে আসছে গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ খাতে সংকট আরও ঘনীভূত হওয়ার শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মু. তামিম বলেন, আসছে গ্রীষ্মে আমি মনে করি চরম একটি লোডশেডিংয়ের সিচুয়েশনে চলে যাব আমরা। পড়তে হবে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে। ব্যাহত হবে নিয়মিত কার্যক্রম।

আন্তর্জাতিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও পাওয়ার সেলে মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহামম্মদ হোসাইন আমার সংবাদকে বলেন, সবই কিছুই ঠিক ছিল। এলসি জটিলতায় কয়লা আমদানি কার্যক্রম সাময়িকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ জন্য এখনো কয়লা দেশে এসে পৌঁছেনি। আমরা যে পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিলাম তা কিছুটা ছন্দপতন হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ‘গ্রীষ্ম মৌসুমকে সামনে রেখে আমাদেরকে আশ্বস্ত করা হয়েছে, যতটুকু রিসোর্স দেয়া দরকার সেটি দেয়া হবে। তবে আমরা রিকোভার করার ব্যবস্থা করেছি। আশা করি শিগগিরই একটি সমাধান হবে।’

সূত্র বলছে, চলতি ২৮ জানুয়ারি ইন্দোনেশিয়া থেকে এক লাখ টন আমদানিকৃত কয়লা দেশে আসবে। যা আগামী দুই-তিন মাস ব্যবহার করা যাবে।

তবে ভোক্তা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামনে রমজান মাস উৎপদান পরিস্থিতি এমন থাকলে সংকট আরও বড় আকারে ধারণ করবে। 
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-পিডিবির এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছর প্রতি মাসেই কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে। গত অর্থবছর প্রথম ছয় মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল চার হাজার ১৫১ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা। আর চলতি অর্থবছর প্রথম ছয় মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৩৭৯ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা। এ হিসাবে গত ছয় মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে এক হাজার ৭৭২ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা। সে হিসাবে উৎপাদন কমেছে ৪২ দশমিক ৬৯ শতাংশ। যদিও চলতি অর্থবছরের শুরুতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়বে বলেই প্রক্ষেপণ করেছিল পিডিবি।

এ সময় গত ছয় মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার হাজার ৪৯২ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা। তবে লক্ষ্যমাত্রার প্রায় অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে এ সময়। এর মূল কারণ গ্যাস ও তেলের সংকট। চলতি অর্থবছরের বাকি ছয় মাসও এ অবস্থা অব্যাহত থাকবে বলেই মনে করা হচ্ছে। আর ডলার সংকটে তেল ও গ্যাস আমদানিও করা যাচ্ছে না। তাই সহজেই এ পরিস্থিতি উন্নতির আশা নেই।

এর আগে পিডিবির দেয়া এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে ১২ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। মার্চে তা আরও বেড়ে দাঁড়াবে ১৪ হাজার ১০০ মেগাওয়াট। আর এপ্রিল ও মে মাসে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে। সে সময় সর্বোচ্চ ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদা থাকবে। ওই সময় লোডশেডিংও সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

Link copied!