জানুয়ারি ৩০, ২০২৩, ০১:৩৬ এএম
সরকার চাইলে বিদ্যুতের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে পারে - ম. তামিম জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
দফায় দফায় দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা নেই -এম শামসুল আলম সহসভাপতি, ক্যাব
- দাম বাড়ছে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে
- এবার বাড়তে পারে ৪০ পয়সা (ইউনিটপ্রতি)
- প্রতি মাসেই দাম সমন্বয় করবে সরকার
- ১৪ বছরে দাম বেড়েছে ১১ বার
ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাহী আদেশে ফের বাড়ছে বিদ্যুতের দাম। আরও এক ধাপ বিদ্যুতের দামের বোঝা চাপতে যাচ্ছে ভোক্তার ওপর। মূলত সরকারের ঘাটতি থেকে বেরিয়ে আসার তাগিদেই বাড়ছে বিদ্যুতের দাম।
গ্রীষ্মকালে ১৬ হাজার মেগাওয়াটের চাহিদা পূরণে আমদানি বাড়াতে হবে গ্যাস, কয়লা এবং তরল জ্বালানির। তাই আর্থিক সংকট কাটাতে ও আগাম প্রস্তুতিতে যেতে চাইছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্তমানে তেল-গ্যাসে সরকার লাভে আছে। আপাতত বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে বরং সমন্বয় করা উচিত। এভাবে দফায় দফায় দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা নেই। সাধারণ মানুষের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে একটা সংকট চলছে তা ঠিক আছে।
সম্প্রতি গ্যাসের দাম বেড়েছে। এরপর জ্বালানি তেলের দাম ব্যাপক পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে। সেই ধাক্কা এখনো সামাল দিতে পারছে না জনগণ।
এসব দাম বৃদ্ধির কারণে নিত্যপণ্যের বাজার উত্তপ্ত সূত্র বলছে, দেশে প্রায় ২২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে। এর মধ্যে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্ৰই অর্ধেক। ফেব্রুয়ারি থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য গ্যাস ক্রয় করতে হবে ১৪ টাকা প্রতি ঘনমিটার হারে। যা এক লাফে বেড়েছে প্রায় তিনগুণ।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-বিপিডিবির হিসাব মতে, বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় ৯ টাকার মতো। কিন্তু গ্যাসের নতুন দাম কার্যকর হলে ইউনিট প্রতি খরচ বাড়বে অন্তত এক টাকা। যার ফলে, সেই বিদ্যুৎ কিনতে পিডিবির বাড়তি ব্যয় হবে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। আর তা সমন্বয়ের কমানোর প্রধান পথই ভোক্তা পর্যায়ে দাম বাড়ানো।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী এমন মন্তব্যই করেছেন। এর আগে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখে প্রতি মাসে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য সমন্বয় করা হবে । তিনি তখন বলেছিলেন, জ্বালানি তেলের বিষয়ে একটি রূপরেখা তৈরি হচ্ছে। এ মাসের মধ্যেই খসড়া তৈরি হবে। এরপর প্রতি মাসে জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম একইভাবে সমন্বয় করা হবে। নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে ভর্তুকি দিতে হবে না। গ্যাস বিক্রির বিপরীতে জ্বালানি তেলের বাণিজ্যে অনেক দিন ধরে মুনাফা করছে বিপিসি। এক মাত্র বিদ্যুতেই লোকসান যাচ্ছে সরকারের। সেটির দাম সম্প্রতি বেড়েছে ৫ শতাংশ। তাহলে এখন দাম বৃদ্ধিতে কেন এত তোড়জোড় প্রশ্ন বিশ্লেষকদের।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, এখন আর মোটা অঙ্কে ঘাটতি দেয়ার সমর্থ নেই সরকারের। গ্রীষ্মে প্রয়োজনীয় জ্বালানি মিলবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম চওড়া থাকলে সেই সুযোগ কম। বিইআরসির মাধ্যমে দাম সমন্বয় করতে সময়ের ব্যাপার থাকে। তাই জরুরি সময়ে দাম বাড়ানোর জন্য আইন করে কিছু ক্ষমতা নিয়েছে সরকার। এখন ভোক্তাপর্যায়ে একটু সহ্য করতে হবে। এটা থেকে লাঘব করার জন্য সরকারের হাতে কোনো অপশন নেই।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে যখন জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠছে, তখনই বাড়ানো হয় গ্রাহকপর্যায়ে বিদ্যুতের দাম। এক সপ্তাহের মাথায় বাড়ে শিল্প খাতে গ্যাসের দামও। সরকারের নির্বাহী আদেশে গ্যাস-বিদ্যুতের বাড়তি দাম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই আবারও বাড়ছে বিদ্যুতের দাম। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই আরও অন্তত ১০ শতাংশ বাড়ানো হবে দাম। এর আগে চলতি মাসে ৫ শতাংশ করে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় ১৯ পয়সা। এবার আরও ৪০ পয়সা পর্যন্ত বাড়তে পারে বিদ্যুতের দাম। বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয়ের নামে প্রতি মাসেই এমনভাবে দাম বাড়তে বাড়তে একপর্যায়ে ঠিক কোন জায়গায় পৌঁছাবে তা নিয়ে শঙ্কিত সাধারণ মানুষ।
বিইআরসি সূত্র জানায়, যেহেতু সরকারের হাতে দাম বাড়ানো-কমানোর নির্বাহী ক্ষমতা রয়েছে তাই এক্ষেত্রে বিইআরসির কিছু বলার নেই। নির্বাহী আদেশে যদি আগামী মাসেও দাম বাড়ে এক্ষেত্রেও আমাদের কিছু করার থাকবে না। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ- সভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম আমার সংবাদকে বলেন, এভাবে দফায় দফায় দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা নেই। নিত্যপণ্যের মূল্য তাহলে ধারাবাহিকভাবে বাড়তেই থাকবে। দুর্ভোগে পড়বে সাধারণ মানুষ।
অপর জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম. তামিম আমার সংবাদকে বলেন, আমরা সারাজীবন ভর্তুকি দিয়ে গেছি। এখন একেবারেই ভর্তুকি উঠিয়ে দিবো যখন মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপদে আছে। এখন সবচেয়ে কঠিন অবস্থা পার করছে জনগণ। এসব দাম বৃদ্ধির কারণে নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। যা মোকাবিলা করা কঠিন।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে গ্যাসে কোনো ভর্তুকি নেই। বলতে গেলে তেলেও ভর্তুকি নেই। আমি মনে করি, সরকার চাইলে একটু ভর্তুকি দিয়ে বিদ্যাতের মূল্যটা স্থিতিশীল রাখতে পারে।
প্রসঙ্গত, গত ১৪ বছরে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ১১ বার। বর্তমান সরকারের শুরুতে ২০১০ সালের মার্চে প্রথম বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। সে সময় বিদ্যুতের গড় দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৩ টাকা ৯২ পয়সা। পরের বছর (২০১১ সাল) গ্রাহকপর্যায়ে দুই দফা বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে বাড়ানো হয় ৫ শতাংশ ও ডিসেম্বরে ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। এতে বিদ্যুতের গড় দাম বেড়ে দাঁড়ায় চার টাকা ৬৭ পয়সা।
২০১২ সালেও খুচরা বিদ্যুতের দাম দুই দফা বাড়ানো হয়। এর মধ্যে মার্চে বাড়ে ৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ ও সেপ্টেম্বরে ১৫ শতাংশ। এতে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে বিদ্যুতের গড় মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ টাকা ৭৫ পয়সা। এরপর ২০১৪ সালের মার্চে বিদ্যুতের দাম ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয় ছয় টাকা ১৫ পয়সা। আর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে তা ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ বেড়ে হয় ছয় টাকা ৩৩ পয়সা। একইভাবে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে গ্রাহকপর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ানো হয়। সে সময় বিদ্যুতের গড় মূল্যহার ছয় টাকা ৮৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ওইবারই প্রথম বিদ্যুৎ বিতরণকারী সব কোম্পানির জন্য অভিন্ন মূল্যহার নির্ধারণ করা হয়। এতে ঢাকার চেয়ে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতের দাম বেশি হারে বাড়ে। এর প্রভাবে গড় মূল্যহার কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল গড়ে ছয় টাকা ৭৭ পয়সা।
২০২০ সালের মার্চে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের গড় মূল্যহার ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এতে গড় মূল্যহার দাঁড়ায় সাত টাকা ১৩ পয়সা। সর্বশেষ ২০২২ সালে নভেম্বরে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়ায় বিইআরসি। এটি ডিসেম্বর থেকে কার্যকর করা হয়। এরপর চলতি বছর সরকারের নির্বাহী আদেশে গ্রাহক পর্যায়ে ৫ শতাংশ বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম।