Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

লাগামহীন বৃদ্ধিতে দিশাহারা মানুষ

মহিউদ্দিন রাব্বানি

ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২৩, ০৪:০৭ পিএম


লাগামহীন বৃদ্ধিতে দিশাহারা মানুষ
  • জ্বালানির দাম বাড়ছে যখন-তখন
  • দুই ধাপে বিদ্যুতের দাম বাড়ে ৩৯ পয়সা (ইউনিট)
  • শিল্পে গ্যাসের দাম বেড়েছে তিনগুণ
  • এলপিতে এক লাফে বেড়েছে ২৬৬ টাকা

বিইআরসি আইনের সংশোধন অত্যন্ত দুঃখজনক -ইজাজ হোসেন, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
জ্বালানির দাম বাড়লে সব ধরনের পণ্যের দামও বেড়ে যায় -গোলাম রহমান, সভাপতি, ক্যাব

দফায় দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের লাগামহীন দাম বাড়ায় নাভিশ্বাস উঠছে ভোক্তার। দৈনন্দিন খরচ সামলানো এখন দুরূহ ব্যাপার হয়ে পড়েছে। নজিরবিহীন বিদ্যুৎ-গ্যাসে দাম বাড়ায় দিশাহারা সাধারণ মানুষ। বিদ্যুৎ-গ্যাসের মূল্য নির্ধারণে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) পাশ কাটিয়ে এক মাসে তিন দফা দাম বাড়িয়েছে সরকার। 

চলতি মাস থেকেই গ্যাস ও বিদ্যুতের নতুন দাম কার্যকর হচ্ছে। এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে গণশুনানি ছাড়া সরকারের নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে। বিইআরসি আইন-২০০৩ সংশোধন করে জ্বালানি তেলের মতো গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা এখন সরকারের হাতে নিয়ে নিয়েছে। 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ আইন সংশোধন করে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম ইচ্ছেমতো বাড়ানোর ক্ষমতা পেলো সরকার। জাতীয় সংসদের অধিবেশন আইন সংশোধনের বিল পাসের আলোচনায় একজন সংসদ সদস্য এই সংশোধনীকে 'কালো আইন' হিসেবেও অভিহিত করেছেন। ১২ জানুয়ারি গ্রাহক পর্যায়ে গড়ে পাঁচ শতাংশ বাড়ানো হয়। 

অন্যদিকে বিইআরসি সর্বশেষ গত ২১ নভেম্বর বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়িয়েছিল। তখন ইউনিটপ্রতি ৫.১৭ টাকা থেকে গড়ে ১৯.৯২ শতাংশ বাড়িয়ে ৬.২০ টাকা করা হয়। এরপর ১৮ দিনের ব্যবধানে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে আবারও বাড়ল বিদ্যুতের দাম। এবার নির্বাহী আদেশে গ্রাহকের পাশাপাশি পাইকারি পর্যায়েও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। বাড়তি দর চলতি ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হয়। এ দফায় গ্রাহক পর্যায়ে পাঁচ শতাংশ এবং পাইকারি পর্যায়ে আট শতাংশ দাম বাড়িয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। এভাবে ঘন ঘন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘটনা নজিরবিহীন। 

অন্যদিকে সবচেয়ে কম বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী লাইফ লাইন (৫০ ইউনিট ব্যবহারকারী) গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম এর আগে ১৯ পয়সা বাড়িয়ে ৩.৯৪ টাকা করা হয়েছিল। এবার আরও ২০ পয়সা বাড়িয়ে ৪.১৪ টাকা করা হয়েছে । কৃষি সেচে গত ১২ ডিসেম্বর ২১ পয়সা বাড়িয়ে ৪.৩৭ টাকা করা হয়েছিল। এবার আরও ২২ পয়সা বাড়িয়ে ৪.৫৯ টাকা করা হলো। শিক্ষা, ধর্মীয়, দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালে ৬.৩২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬.৬৪ টাকা, রাস্তার বাতি ও পানির পাম্পে ৮.০৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮.৪৯ টাকা, বাণিজ্যিক ও অফিসের বর্তমান দর ফ্ল্যাট রেটে ১০.৮২ টাকা বাড়িয়ে ১১.৩৬ টাকা, অফ-পিকে ৯.৭৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০.২২ টাকা, পিকে ১২.৯৮ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৩.৬৩ টাকা করা হয়েছে। ক্ষুদ্র শিল্পে (নিম্নচাপ) ফ্ল্যাট রেটে ৯.৪১ টাকা, অফ পিকে ৮.৪৬ টাকা, পিকে ১১.২৯ টাকা দর ধরা হয়েছে।

এর আগে ১৯ জানুয়ারি শিল্প ও বিদ্যুতে গ্যাসের দাম বাড়ে তিনগুণ। এই দামও ১ ফেব্রুয়ারি থেকে নতুন দর কার্যকর হয়। আগের দফায় সিএনজি বাদে সব শ্রেণির গ্রাহকের জন্য গ্যাসের দাম বাড়ানো হলেও এ দফায় বিদ্যুৎ, শিল্প ও বাণিজ্য শ্রেণির গ্রাহকদের গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। মাঝারি শিল্প ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্যাসের দাম সবচেয়ে বেশি ১৭৯ শতাংশ বা প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এবার দাম বাড়েনি আবাসিক, সিএনজি, সার এবং চা-শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের। মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে দেশে বিদ্যুৎ, শিল্পজাত পণ্যের দাম এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও হোটেল-রেস্টুরেন্ট পরিচালনায় খরচ বাড়বে।

শুধু তাই নয়, গত বৃহস্পতিবার ১২ কেজি এলপির দাম এক লাফে বাড়ে ২৬৬ টাকা। নজিরবিহীন দাম বৃদ্ধিতে ক্ষুব্ধ ভোক্তারা। নতুন দাম অনুযায়ী ভোক্তা পর্যায়ে ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম হবে এক হাজার ৪৯৮ টাকা, যা এতদিন এক হাজার ২৩২ টাকা ছিল। এর আগে গত জানুয়ারিতে ভোক্তা পর্যায়ে ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ৬৫ টাকা কমিয়ে এক হাজার ২৩২ টাকা নির্ধারণ করে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। গত ডিসেম্বরে যার দাম ছিল এক হাজার ২৯৭ টাকা। 

ছয় মাস আগে যাত্রাবাড়ীতে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা শুরু করেন কাশেম নামে এক ব্যক্তি। কিন্তু অব্যাহত লোকসানের মুখে তিনি এখন ব্যবসা বন্ধ করে দিতে চাইছেন। কারণ, গত কয়েক মাসে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম লাগামহীন বেড়েছে। এই বাড়তি দামের কারণে কাশেম ব্যবসা গুটিয়ে নিতে চাচ্ছেন। 

যখন ব্যবসাটা শুরু করেন, তখন সিলিন্ডার গ্যাস তিন হাজার ৪০০ টাকায় কিনতেন জানিয়ে কাশেম আরও বলেন, এখন সেই একই গ্যাস কিনতে হচ্ছে পাঁচ হাজার ২০০ টাকায়। এর ওপর আবার বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হলো। কিন্তু খাবারের দাম তো সেভাবে বাড়াতে পারি না। দাম বাড়ালে মানুষ কিনতে চায় না । গত বছর জ্বালানির দাম রেকর্ড বাড়ার কারণে এমনিতেই মানুষ খুব বিপদে রয়েছে। তার ওপর গ্যাসের দাম হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, সবচেয়ে আশঙ্কার ব্যাপার হলো সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে ভর্তুকি তুলে দেয়া হবে । সেক্ষেত্রে সবকিছুর দাম একেবারে নাগালের বাইরে চলে যাবে। গত বছর সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড বৃদ্ধির কারণে এক দফা ভয়াবহ মূল্যস্ফীতির কবলে পড়েছে মানুষ। সামনে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে।

এ বিষয়ে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত হৃদয় আহমেদ বলেন, ৩০ হাজার টাকা বেতন পাই। আগে ভালোই চলত। এখন চলে
না। বাসা ভাড়া, দুই বাচ্চার লেখাপড়া চালানো, মায়ের ওষুধ কেনা— এসব ব্যয় এখন মেটানো যাচ্ছে না। কারণ, সবকিছুর দাম প্রতিদিন বাড়ে। 

তিনি বলেন, সবকিছুর দাম বাড়লেও আমাদের বেতন বাড়ে না। কারণ, মন্দার কারণে চাকরিই থাকে না- এমন শঙ্কা রয়েছে। তাই বেতন না বাড়লেও তা মেনে নিয়েই চাকরি করি। সামনের দিনগুলোতে কী অপেক্ষা করছে জানি না। 

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, গত বছর যখন জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলো, তখন থেকেই এই মূল্যস্ফীতি শুরু হয়েছে। তারপর থেকে মানুষ দাম বৃদ্ধির সঙ্গে আর পেরে উঠছে। না। জ্বালানি তেল এবং গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্গে সবকিছুর সম্পর্ক রয়েছে। ফলে এসবের দাম যখন বেড়ে যায়, তখন সব ধরনের পণ্যের দামও বেড়ে যায়। গ্যাস বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণে বিইআরসি আইনের সংশোধনকে দুঃখজনক হিসেবে উল্লেখ করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন। 

তিনি বলেন, এটা তো খুবই দুঃখজনক, সাংঘাতিক রকমের দুঃখজনক। দেখা যাচ্ছে মন্ত্রণালয় যে পদ্ধতিতে মূল্য নির্ধারণ করছে, তাতে তারা সন্তুষ্ট নয়। আমি তো এ কারণে অসন্তুষ্ট, দুঃখিত এবং সাংঘাতিক রকমের নেতিবাচক একটা জিনিস হলো যে, আমরা এ প্রক্রিয়ায় পিছিয়ে গেলাম। 

Link copied!