ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২৩, ০১:০৯ এএম
- সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর পিএসবি তহবিল বন্ধের হুঁশিয়ারি এসবিসির
- জেলদণ্ডের বিধান না থাকায় বাড়ছে আইন ভঙ্গের প্রবণতা
- আর্থিক জরিমানা করলেও তা নামমাত্র, গ্রাহক আমানত থেকে হয় পরিশোধ
- সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিমা করা হয়নি —সংশ্লিষ্ট দুই কোম্পানির সিইও
- আইন অনুসারে যাদের বিমা হয়েছে, সেগুলোও সরকারের এখতিয়ারভুক্ত – এসবিসি
- অভিযোগ পেলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা -আইডিআরএ
সরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার বিমা সরকারি বিমা প্রতিষ্ঠান করবে। বিমা কর্পোরেশন আইন-২০১৯ অনুসারে তেমনটি হওয়ার কথা থাকলেও কিছু প্রতিষ্ঠান তা লঙ্ঘন করছে। খোদ সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিয়মের এমন ব্যত্যয় ঘটানোর পরও কোনো শাস্তি-জরিমানা বা জবাবদিহিতা না থাকায় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও এমন কাজে উৎসাহী হবে। এতে একদিকে যেমন আইনের লঙ্ঘন হবে, অপরদিকে বিমা খাতে অনৈতিক প্রতিযোগিতা বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, বিমা কর্পোরেশন আইনের ১৬(১) ধারা লঙ্ঘন করে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের বিমা করে বেসরকারি ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। এ জন্য প্রিমিয়াম বাবদ ব্যাংক থেকে এক লাখ ৩৮ হাজার ৫২৩ টাকা গ্রহণও করে।
অপরদিকে পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে চলাচল করার জন্য রেল সংযোগ প্রকল্পের বিমাও গ্রহণ করে প্রতিষ্ঠানটি। আর এ জন্য ৬০ লাখ ৩০ হাজার ১২৭ টাকা প্রিমিয়াম নেয়। অর্থাৎ সরকারি দুই স্থাপনা বাবদ ৬১ লাখ ৬৮ হাজার ৬৫০ টাকা প্রিমিয়াম গ্রহণ করে, আইন ভেঙে। বিষয়টি নিয়ে গত ৫ ডিসেম্বর ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্সকে একটি পত্র দেয় সাধারণ বীমা কর্পোরেশন (সাবীক)। এরপর গত ৮ ডিসেম্বর, ১৫ ডিসেম্বর ও ২০ ডিসেম্বর পরপর আরও তিনটি চিঠি দেয়।
এসব চিঠিতে ২০ জানুয়ারি, ২০২৩ এর মধ্যে প্রিমিয়াম বাবদ উল্লিখিত টাকা সারীকের অনুকূলে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। অন্যথায় প্রতিষ্ঠানটির বিপরীতে সাবীকের প্রাইভেট সেক্টর বিজনেস (পিএসবি) অ্যাকাউন্ট বন্ধের হুঁশিয়ারিও দেয়া হয়। কিন্তু প্রিমিয়ামের টাকা ফেরত তো দেয়নি, উপরন্তু চিঠিগুলোর জবাব দেয়ারও কোনো প্রয়োজন মনে করেনি বেসরকারি এই বিমা প্রতিষ্ঠানটি।
অপরদিকে একইভাবে আইন লঙ্ঘন করে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের অধীনে পরিচালিত বগুড়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির (২) ক্ষেত্রেও। তাদের বিমাযোগ্য সম্পদের অনুকূলে ৭১টি মোটর বিমা পলিসি ইস্যু করে ফেডারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। এ ক্ষেত্রে ৭১টি মোটর বিমা পলিসি প্রিমিয়াম বাবদ ২৯ লাখ ৪৪ হাজার ৮৯৩ টাকা গ্রহণ করে। বিষয়টি অবগত হওয়ার পর প্রিমিয়ামের টাকা সাধীকের অনুকূলে জমা দিতে গত বছরের ২৮ নভেম্বর এবং ১৫ ও ২০ ডিসেম্বর তিনটি চিঠি দেয় সাধারণ বীমা কর্পোরেশন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই টাকা ফেরত দেয়া হয়নি বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সের সাথে যোগাযোগ করে জানতে চাইলে কোম্পানি সচিব শেখ মো. আনোয়ারুল হক আমার সংবাদকে জানান, পল্লী বিদ্যুৎ বগুড়া অফিস পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছে। সেই বিজ্ঞাপন অনুযায়ী অনেকেই বিমাটি করার আগ্রহ প্রকাশ করে তাদের রেট দিয়েছে। সেখান থেকে ফেডারেল ইন্স্যুরেন্স বিমা করার কাজটি পায়।
তা ছাড়া পল্লী বিদ্যুতের রেজ্যুলেশনেও বলা আছে, তারা সরকারি-বেসরকারি যেকোনো প্রতিষ্ঠান থেকে বিমা করতে পারবে। এমনকি পল্লী বিদ্যুৎ বগুড়া অফিস সরকারি প্রতিষ্ঠান নয় বলেই জানান এই কর্মকর্তা।
অপরদিকে পদ্মা সেতু প্রকল্পের মোটর বিমা ও রূপালী ব্যাংকের বিমা করা নিয়ে ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্সের সিইও জামিরুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, আমরা পদ্মা সেতু প্রকল্পের কোনো বিমা করিনি। এই প্রকল্পে যে চীনা ঠিকাদার কোম্পানি আছে তাদের মোটর ইন্স্যুরেন্স করেছি। এই বিমার প্রিমিয়ামও তারাই দিয়েছে। এ নিয়ে আমরা তাদের চিঠির জবাবও দিয়েছি। এ ছাড়া রূপালী ব্যাংকের বিষয়টি খোঁজখবর নিতে নির্দেশ দিয়েছি। যদি আইন ভঙ্গের বিষয় থাকে তবে প্রিমিয়ামের টাকা ফেরত দিয়ে দেবো।
তবে বিমা কর্পোরেশন আইনের সংজ্ঞায় সরকারি সম্পত্তি বিষয়ে বলা হয়েছে- ক. এমন স্থাবর বা অস্থাবর সম্পদ যা সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ বা সংরক্ষণে আছে এবং যা রক্ষণাবেক্ষণের আইনগত দায়িত্ব সরকারের, খ. সরকার অথবা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বরাবরে ন্যস্ত সম্পত্তি, গ. সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাধীনে বা নিয়ন্ত্রণে থাকা কোনো কোম্পানি, খামার, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, উদ্যোগ বা অন্য কোনো স্থাপনা অথবা যেগুলোতে সরকারের বা সরকার ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বা সরকার ও কোনো কোম্পানির যৌথ নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা রয়েছে বা যেখানে সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ওইরূপ আর্থিক সংশ্লেষ বা স্বার্থ আছে বা কোনো কোম্পানির অর্থায়নে সরকারের গ্যারান্টি রয়েছে, ঘ. সরকারের গ্যারান্টিযুক্ত বৈদেশিক ঋণ বা আর্থিক সাহায্যে পরিচালিত যেকোনো প্রকল্প: অথবা ড. সরকার নির্ধারিত অন্য কোনো সম্পত্তি।
এ নিয়ে সাবীকের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) অবলিখন বিভাগের প্রধান হামিদুল হক আমার সংবাদকে বলেন, এটি এক ধরনের চুরি। মূলত নৈতিকতা বোধ না থাকায় এমনটি হয়েছে। এভাবে কোনো কোম্পানি সরকারি বিমা করতে গেলে যেমনিভাবে আমরা মানে সরকার আয় বঞ্চিত হয়, তেমনিভাবে কোম্পানিগুলোও মুনাফা বঞ্চিত হয়। কারণ আমাদের আয়ের একটি অংশ তারাও পায়। রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে বঞ্চিত করছে, দ্বিতীয় অন্যদের বঞ্চিত করে এককভাবে ভোগ করছে। আইন ভেঙে অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সরকারি স্থাপনা ও প্রকল্পের বিমা করছে।
অপরদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও এসবিসিকে বাদ দিয়ে কোম্পানিগুলোর কাছে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে এসবিসির প্রচারণা ও কার্যক্রমে উদাসিনতা রয়েছে বলে মনে করছেন বিমা সংশ্লিষ্টরা। তবে এই অভিযোগ মানতে নারাজ সরকারি প্রতিষ্ঠানটি।
বিষয়টি নিয়ে হামিদুল হক আমার সংবাদকে জানান, বেসরকারি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর একটি অ্যাডভান্টেজ হলো- তারা সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন দিতে পারে, যেটা আমরা পারি না। কিন্তু আন-অফিসিয়ালি আমরা যেটি জানি তা হলো- কোম্পানিগুলো ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন দিচ্ছে। কাজেই যে পলিসির প্রিমিয়াম ধরুন এক কোটি টাকা এসেছে, তারা কমিশন বাবদ ৫০ লাখ টাকা পেয়ে যাচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানটির যারা এই পলিসির কাজে যুক্ত তারা নিজেরা এই টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নিচ্ছে। তাই তারাও বেসরকারিভাবে বিমা করতে আগ্রহী।
পাশাপাশি আইনেও কিছু দুর্বলতা আছে বলে মনে করেন এই নির্বাহী কর্মকর্তা। এই প্রতিবেদকের সাথে একমত প্রকাশ করে তিনি জানান, বিমা কর্পোরেশন আইনে সরকারি স্থাপনা ও প্রকল্পের বিমা সরকারি বিমা প্রতিষ্ঠান করবে, এমনটি বলা হলেও যদি কেউ না করে তাহলে কি হবে সে সম্পর্কে তেমন কিছু বলা নেই। শুধু জরিমানা করে এটি দূর করা যাবে না। কারণ আমাদের দেশে জরিমানার হারও অনেক কম। যে জরিমানা করা হয় তার চেয়ে বেশি লাভ করে অপরাধীরা। তা ছাড়া বিমা কোম্পানির ক্ষেত্রে এই জরিমানার টাকাও পরিশোধ করা হয় গ্রাহকের গচ্ছিত আমানত থেকে। তাই যদি জরিমানার পাশাপাশি কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়, তবে হয়তো প্রতিকার মিলতে পারে।
এদিকে সরকারি বিমায় বেসরকারি কোম্পানির অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থাও অবগত বলে জানা গেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার মুখপাত্র ও পরিচালক (উপসচিব) মো. জাহাঙ্গির আলম আমার সংবাদকে বলেন, এ ধরনের ঘটনায় বিমা খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, এটি বলাই বাহুল্য। তবে সাধারণ বীমা যদি এ নিয়ে কোনো অভিযোগ করে তবে বিচার-বিশ্লেষণ করে আইনমাফিক ব্যবস্থা নেবে আইডিআরএ।
তিনি বলেন, অভিযোগ জানানোর সাথে সাথেই ব্যবস্থা নেয়া যায় না, একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সে ক্ষেত্রে একটু বিলম্ব হলেও আইডিআরএ এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে।