Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪,

খরচে দিশাহারা কৃষক

রেদওয়ানুল হক ও মহিউদ্দিন রাব্বানি

রেদওয়ানুল হক ও মহিউদ্দিন রাব্বানি

ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩, ১০:৫৪ এএম


খরচে দিশাহারা কৃষক

জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দফায় দফায় দাম বৃদ্ধিতে টালমাটাল দেশের সার্বিক অর্থনীতি। আমদানি, উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধির প্রভাবে মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট সাধারণ মানুষ। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির ফলে জীবনমানের আশঙ্কাজনক অবনতি, শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়া থেকে শুরু করে বেকারত্ব— সব ক্ষেত্রে পাহাড়সম চাপ তৈরি হয়েছে। আর এ সবই হয়েছে সরকারের সংস্কার পরিকল্পনার প্রভাবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নিতে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফলস্বরূপ বেড়েছে তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম।

জ্বালানি ও বিদ্যুতের বর্ধিত দামে অসহনীয় চাপের মুখোমুখি কৃষক। জীবনযাত্রায় ব্যয় বৃদ্ধির ফলে সংসার চালাতেই খরচ হয়ে যাচ্ছে সব টাকা। জমি চাষ ও বীজ কেনার টাকার সংকটে ব্যাহত হচ্ছে ধানের চারা লাগানোর কাজ। সার ও কীটনাশক তো পরের কথা। বেড়ে গেছে শ্রমিকের মজুরি। তাই অতিরিক্ত মজুরি দিয়ে শ্রমিক নিয়োগ দেয়া সম্ভব না হওয়ায় বোরো ধান রোপণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে ধান উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ ইরি মৌসুমে অনেক জমি অনাবাদি হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এতে একদিকে যেমন দেশে ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে, একইসঙ্গে ঋণগ্রস্ত কৃষক তাদের ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে মারাত্মক অর্থনৈতিক হুমকির মুখে পড়বে।

অন্যদিকে উৎপাদন খরচ বাড়লেও উৎপাদিত ফসলের সে অনুপাতে দাম পান না কৃষক। তাই অনেকেই লোকসানের মুখে পেশা পরিবর্তন করছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কৃষকের সন্তানের লেখাপড়াও ঝুঁকিতে পড়েছে। কৃষকরা বলছেন, তাদের অনেকে সন্তানদের নতুন বছরে স্কুলে ভর্তি না করে কাজে নিয়োগ করছেন।

ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার কৃষক হোসেন। এমবিএ পাস করেও বেছে নিয়েছেন কৃষিকাজ। পাশাপাশি কৃষি উপকরণ বিক্রি করেন। আমার সংবাদকে তিনি বলেন, ‘নিজে কৃষিকাজের পাশাপাশি সার, বীজ, কীটনাশকসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণ বিক্রির সুবাদে অনেক কৃষকের সঙ্গেই আমার কথা হয়। তার অভিজ্ঞতা হলো— সবাই হতাশায় ভুগছে। অনেকে কৃষিকাজ ছেড়ে অন্য কাজ করছেন। অনেকে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। কেউ কেউ শহরে গিয়ে রিকশা চালাচ্ছেন বা গার্মেন্টে কাজ নিয়েছেন। আবার অনেক কৃষক সন্তানের স্কুল বন্ধ রেখে কৃষিকাজে নিয়োগ করছেন। কারণ, শ্রমিক নিয়োগ দেয়ার মতো অর্থ তাদের কাছে নেই।’ সরকারের কৃষিনীতির বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করে এই তরুণ উদ্যোক্তা বলেন, একদিকে সরকার কৃষিতে জোর দেয়ার বিষয়ে বক্তব্য দিচ্ছে, অন্যদিকে ভর্তুকি প্রত্যাহার করছে। বিষয়টিকে একেবারেই অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সব সময় কৃষি সেচ ও হতদরিদ্র গ্রাহকদের বিশেষ ছাড় দেয়ার রেওয়াজ ছিল। তুলনামূলক ধনিক শ্রেণির ভোক্তাদের দাম বাড়িয়ে ঘাটতি মেটানো হতো, এখন এসব মানা হচ্ছে না।

বিদ্যুতের গুরুত্বপূর্ণ খাত বিবেচনা করা হয় কৃষি সেচকে। কৃষি উৎপাদন নিরবচ্ছিন্ন রাখতে এ খাতে বিদ্যুতের দাম সব সময়ই সাশ্রয়ী রাখার চেষ্টা করা হতো। এবার তারও ব্যত্যয় ঘটেছে। সার-বীজের দাম বেড়ে যাওয়ায় আসন্ন বোরো মৌসুম নিয়ে এমনিতেই শঙ্কায় রয়েছেন কৃষকরা। তারপর সেচে দফায় দফায় খরচ বেড়েছে। গত ১২ ডিসেম্বর বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ২১ পয়সা বাড়িয়ে চার দশমিক ৩৭ টাকা করা হয়েছিল, এরপর আরও ২২ পয়সা বাড়িয়ে চার  দশমিক ৫৯ টাকা করা হয়েছে। কৃষিতে মধ্যম চাপের ফ্ল্যাট রেটে পাঁচ দশমিক ৫১ টাকা, অফ-পিকে চার দশমিক ৯৭ টাকা এবং পিকে ছয় দশমিক ৮৯ টাকা করা হয়েছে। বাদ যায়নি পানির পাম্পের বিলেও। দুই দফায় বেড়ে আট দশমিক ৪৯ টাকা হয়েছে।

এ বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, ‘ভর্তুকি

 

কমানোর ফলে উৎপাদনে প্রভাব পড়বে কি-না সেটি নির্ভর করছে উৎপাদন খরচের বিপরীতে পণ্যের যথাযথ মূল্য প্রাপ্তির ওপর। এ ক্ষেত্রে দেখতে হবে তারা কোনো গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে কি-না। যদি কৃষক যথাযথ মূল্য পায় তবে উৎপাদন ব্যাহত হবে না। এ ছাড়া বিদ্যুৎ ও সারে ভর্তুকি কমানোর কারণে প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষুদ্র কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার কারণ চিহ্নিত করতে হবে। যদি বাস্তবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে তাদের নগদ সহায়তা দিতে হবে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিজেলের বর্ধিত দামে চাষের খরচ বেড়েছে। একইসঙ্গে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদিত ফসল বাজারজাত করতে কৃষককে বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে; কিন্তু সে অনুপাতে ধানের দাম পান না কৃষক।

উদ্যোক্তা হোসেন বলেন, ‘মফস্বলে ধানের দাম আগের তুলনায় খুব একটা বাড়েনি। ৭০০-৮০০ টাকায় মণ বিক্রি হয়। কিন্তু সার, কীটনাশক, ডিজেলের দাম দেড়গুণ বেড়েছে।’

তবে বোরো উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, চলতি মৌসুমে বোরোতে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ৫০ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দুই লাখ ৪১ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে। চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে দুই কোটি ১০ লাখ টন। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকার খাদ্যশস্যের উৎপাদন নিশ্চিত করতে এবং আমদানিনির্ভরতা কমাতে কৃষি খাতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। সে লক্ষ্যে চলতি মৌসুমে বোরো আবাদে জমির আওতাও বাড়িয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস আমার সংবাদকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ ও সারের দাম কিছুটা বাড়লেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যাঘাত ঘটবে না। প্রান্তিক পর্যায়ের বোরো উৎপাদনের তথ্যের সূত্রে তিনি বলেন, কৃষক কিছুটা চাপে থাকলেও নিজেদের প্রয়োজনেই তারা চাষ করছেন। কারণ কৃষকের বড় একটি অংশ কৃষিকাজের বাইরে আর কোনো কাজ করেন না। তারা অল্প লাভেও কৃষিকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে তাদের পুঁজি হচ্ছে না ঠিক, তবে নিজেদের প্রয়োজন মিটছে। তাই দেশে বিদ্যমান জমির বিপরীতে যে পরিমাণ কৃষক আছেন, তাতে বোরো উৎপাদনে লক্ষ্য অর্জিত হবে। তিনি বলেন, যেহেতু উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে, তাই কৃষক যাতে ন্যায্য দাম পান, সেদিকেও আমরা নজর রাখব।

প্রসঙ্গত, ২০২১-২২ অর্থবছরে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৮ লাখ ৭২ হেক্টর জমিতে। আবাদ হয়েছে ৪৯ লাখ ৫১ হাজার হেক্টরে। গত বছর চালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই কোটি ৯ লাখ টন। উৎপাদন হয়েছে দুই কোটি ১০ লাখ টন। গত বছরের তুলনায় এ বছর বোরো আবাদে জমির পরিমাণ বেড়েছে পাঁচ হাজার ৬০০ হেক্টর। আর চালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দুই কোটি ১০ লাখ টন, যা গত বছরের তুলনায় এক লাখ টন বেশি।

Link copied!