ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৩, ১২:০৪ এএম
অভিনব জালিয়াতির মাধ্যমে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে বিপুল ঋণ বিতরণের কলঙ্কজনক অধ্যায় ছিল ২০২২ সাল। একই সাথে খেলাপিদের একের পর এক ছাড় ও ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষমতা ব্যাংকের হাতে ছেড়ে দেয়া হয় এ বছরই। ফলে বছর শেষে দেশের অর্থনীতির নেগেটিভ সূচক খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। বছরের শুরুতে যা ছিল এক লাখ তিন হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা।
গতকাল রোববার প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিসেম্বর-২০২২ প্রান্তিকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের এ চিত্র উঠে এসেছে। যদিও নানা কলাকৌশল প্রয়োগ করে বছরের শেষ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) খেলাপি ঋণ কিছুটা কমিয়ে তৃপ্ত বাংলাদেশ ব্যাংক। যা প্রথম তিন প্রান্তিকে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) গড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি বেড়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘খেলাপি ঋণ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করে যাচ্ছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে নীতি সহায়তাও দেয়া হয়েছে। ফলে বছরের শেষ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমেছে।’
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রভাবশালীদের চাপ ও নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় দেয়া ঋণ ফেরত আসছে না। তাই বাড়ছে মন্দ ঋণের বোঝা। এতে বিপাকে পড়ছে ব্যাংক। বিষয়টি নিয়ে বেশ উদ্বেগ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। অর্থাৎ উচ্চ খেলাপির ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। কারণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সহনীয় বলে ধরা হয়।
গত বছরের (২০২২ সাল) প্রথম তিন প্রান্তিকে অর্থাৎ ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ৩১ হাজার ১২২ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণ স্থিতি ছিল ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ১৯৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছিল এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে অর্থাৎ গত বছরের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণ ছিল ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ছিল এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
আর ২০২১ সালের ডিসেম্বর খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ তিন হাজার ২৭৪ কোটি টাকা যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এ হিসাবে গেল বছর (২০২২ সাল) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। তবে ত্রৈমাসিকের তুলনা করলে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের তুলনায় ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ১৩ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা বা ১০ দশমিক ২২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, করোনা মহামারির সময় ব্যাংকঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে দেয়া হয়েছিল বিশেষ ছাড় ও নানা সুবিধা। বছরের শুরুতে তা তুলে নেয়ার পর ধারাবাহিক বাড়তে থাকে। গেল বছর খেলাপি কিস্তির ৭৫ শতাংশ অর্থ জমা দিলে খেলাপি মুক্তির সুযোগ ছিল। কিন্তু তাতেও খেলাপি ঋণ না কমায় পরে খেলাপিদের সুবিধা আরো বাড়িয়ে দেয়া হয়। এ সুবিধার ফলে ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে যারা ঋণের কিস্তির ৫০ শতাংশ অর্থ জমা দিয়েছে তারা কেউ খেলাপি হননি। তারপরও বছরের ব্যবধানে বেড়েছে খেলাপি ঋণ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মোট ঋণের ২০ শতাংশের বেশিই খেলাপি। এর পরিমাণ ৫৬ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৬ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৫ শতাংশের বেশি। বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি চার হাজার ৭০৯ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের প্রায় ১৩ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকের খেলাপি ৪ দশমিক ৯১ শতাংশ। এর পরিমাণ তিন হাজার ৪৮ কোটি টাকা।
তথ্য অনুযায়ী, ঋণ খেলাপির তালিকায় থাকা শীর্ষ ১০টি ব্যাংক হলো— অগ্রণী (খেলাপি ঋণ ১৪ হাজার ৮১০ কোটি টাকা), জনতা (খেলাপি ঋণ ১৪ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা), সোনালী (খেলাপি ঋণ ১২ হাজার পাঁচ কোটি টাকা), বেসিক (খেলাপি ঋণ সাত হাজার ৬০৪ কোটি টাকা), ন্যাশনাল (খেলাপি ঋণ ছয় হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা), রূপালী (খেলাপি ঋণ ছয় হাজার ৬৩০ কোটি টাকা), ইসলামী (খেলাপি ঋণ পাঁচ হাজার ৪০২ কোটি টাকা), এবি (খেলাপি ঋণ তিন হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা), পদ্মা (খেলাপি ঋণ তিন হাজার ৪২৩ কোটি টাকা) ও বাংলাদেশ কৃষি (খেলাপি ঋণ তিন হাজার ২০৯ কোটি টাকা)।
খেলাপির বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, ‘অনেক দিন ধরেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। এর কারণ, ঋণ বিতরণের সময় যথাযথ বিশ্লেষণ হয় না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ বিতরণে তদারকি বাড়ানোর পরিবর্তে খেলাপিদের একটার পর একটা সুবিধা দিচ্ছে। তাই তারা বেপরোয়া। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে পরিসংখ্যান দিচ্ছে এটি আন্তর্জাতিক মানের নয়। কারণ এখানে অনেক তথ্য থাকে না। আবার খেলাপি কম দেখাতে অনেক তথ্য যোগ করা হয় না। ঋণ পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন ও রাইট অফ করা তথ্য দেয়া হয় না। পাশাপাশি বিশেষ ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ কম দেখানো হয় শুধু আর্থিক প্রতিবেদন ভালো দেখানোর জন্য যা কখনোই মানসম্পন্ন বলা যাবে না।’
ঋণখেলাপি বন্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। তার মতে, ‘খেলাপিদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা এবং তাদেরকে ফৌজদারি মামলার আওতায় আনা যায় কি-না তা ভেবে দেখা দরকার।’
গত পাঁচ বছরের খেলাপি ঋণের চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়— ২০১৮ সালে খেলাপি ঋণের হার ছিল ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ; পরিমাণ ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ; পরিমাণ ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। ২০২০ সালে খেলাপি ঋণের হার ছিল সাত দশমিক ৬৬ শতাংশ; পরিমাণ ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। ২০২১ সালে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ; পরিমাণ এক লাখ তিন হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। ২০২২ সালে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ; পরিমাণ এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা।