Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

বিপাকে বিদ্যুৎ খাত

মহিউদ্দিন রাব্বানি

ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৩, ১২:১৭ এএম


বিপাকে বিদ্যুৎ খাত
  • গ্রীষ্মে দরকার পাঁচ বিলিয়ন ডলার
  • বাংলাদেশ ব্যাংক সহযোগিতা করছে না —অভিযোগ পেট্রোবাংলার
  • ডলারের অভাবে পায়রার ১৩২০ মেগাওয়াট কেন্দ্র বন্ধ হতে পারে

 

কয়লাভিত্তিক  উৎপাদন বন্ধ হলে গ্রীষ্মে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে

—এম শামসুল আলম, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, ক্যাব

ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলের চেয়ে কয়লা সস্তা হওয়ায় কিছুটা স্বস্তি দেবে

—প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন, মহাপরিচালক, পাওয়ার সেল

 

ডলার সংকটে চরম বিপর্যয়ের মুখে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। ফলে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লোডশেডিংও। গ্রীষ্মে গরম বেড়ে যাওয়ায় ও বোরো সেচের মৌসুম হওয়ায় জুন পর্যন্ত বিদ্যুতের চাহিদা বাড়তে থাকবে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য মতে, জুন পর্যন্ত আগামী পাঁচ মাসে প্রতিদিন ১৫ হাজার থেকে ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে। সে হিসাবে আগামী জুন পর্যন্ত বিদ্যুতের চাহিদা ৫০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পাবে। পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন গ্রীষ্মে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে জ্বালানি খরচের জন্য অন্তত ৪ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। ভারতের আদানি পাওয়ার ও শেভরনকে প্রদেয় অর্থ যোগ করলে এই অংক পাঁচ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে— এমনটি নিশ্চিত করেছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলমান বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের যুগে সরকারের পক্ষে পাঁচ বিলিয়ন ডলার যোগান দেয়া সম্ভব নয়। তারা বলছেন, প্রতিদিন ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নিশ্চিত করার মতো এত ডলারের ব্যবস্থা কীভাবে করবে, সেটি চ্যালেঞ্জিং। সরকার দেশীয় গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধির গুরুত্ব দিয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সেচের জন্য সোলার সিস্টেম স্থাপনকে বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সরকারের এই নীতিতে বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন রাখেন— যদি উৎপাদন ও সোলারে সরকার গুরুত্ব দিয়ে থাকে তাহলে জ্বালানি আমদানির জন্য কেন এই বিপুল টাকার দরকার হবে? পিডিবির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন যথেষ্ট সাংঘর্ষিক। পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে প্রতিদিন প্রায় সাত হাজার থেকে ১০

 

হাজার মেগাওয়াট। গত বছর সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছিল এপ্রিলে ১৪ হাজার ৭৭৮ মেগাওয়াট। এ বছর প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গেছে। ফলে বড় দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হবে সাধারণ মানুষকে। পিডিবির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার সংবাদকে জানান, সরকার নতুন নতুন উৎপাদনে যাচ্ছে। অথচ যথেষ্ট জ্বালানি মজুত নেই। আমাদানিরও সক্ষমতা নেই। যে কারণে আমাদের রামপাল বন্ধ হয়ে গেছে। যদিও কয়েক দিনের মজুত নিয়ে ফের উৎপাদন শুরু করে। ডলারের অভাবে মার্চে বন্ধ হবে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি করতে সরকার তহবিল সরবরাহ করতে সক্ষম হবে কি-না, সেদিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। এদিকে রিজার্ভের ওপর চাপ এখনো কমেনি। গত ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২ দশমিক ৬ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে, যা এক বছর আগের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৮ শতাংশ কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, এই রিজার্ভ চার মাসের আমদানি বিল মেটানোর জন্য যথেষ্ট।

চলমান ডলার সংকট পিডিবিরও উদ্বেগের বিষয়। এই আর্থিক পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে পিডিবি গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে সর্বাধিক সুবিধা পাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। কারণ এর মাধ্যমেই সবচেয়ে কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। পিডিবি পেট্রোবাংলার কাছে প্রতিদিন এক হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ) গ্যাসের চাহিদা দিয়েছে। সমপ্রতি অর্থ বিভাগের কাছে একটি চিঠিতে পেট্রোবাংলা লিখেছে— স্পট মার্কেট ও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা মেটাতে তাদের পাঁচ মাসে প্রায় ১ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। পিডিবি বলেছে, তাদের অতিরিক্ত গ্যাস লাগবে, কিন্তু আমরা কোম্পানির কাছ থেকে বকেয়া অর্থ এখনো পাইনি। বাংলাদেশ ব্যাংকও সহযোগিতা করছে না। অর্থ বিভাগের কাছে আরেকটি চিঠিতে পিডিবি পায়রা ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ স্থানীয় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানি করতে ৭৫০ মিলিয়ন ডলার চেয়েছে। বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা জানিয়েছে, পিডিবির চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল আমদানি করতে তাদের ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে।

কয়লার দাম নিয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক ও আন্তর্জাতিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের  কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু আছে। বিশ্ববাজারে কয়লার দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলের চেয়ে কয়লা সস্তা হওয়ায় এটি একটু স্বস্তি দেবে।’

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘প্রয়োজনীয় পরিমাণ উৎপাদন না হওয়ায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েও লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ছেন ভোক্তা। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে আগামী গ্রীষ্মে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। জ্বালানি তেল আমদানি করা হয় ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) অর্থায়নে। তাদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে তেল আমদানির পর বিক্রি করে ওইসব অর্থ পরিশোধ করা হয়। তেল বিক্রি করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) ঋণ পরিশোধের জন্য টাকা ব্যাংকে জমা দিলেও ডলারের অভাবে পরিশোধ করা যাচ্ছে না। এতে ঋণের বেশ কয়েকটি কিস্তি আটকে গেছে। বকেয়া পড়েছে ১৪০ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১২২ কোটি ডলার বা ১৩ হাজার কোটি টাকা পরিশোধের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। যদিও এ মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু জানা গেছে, কিছু কিস্তির মেয়াদ বাড়ানো হলেও বেশির ভাগ এখনো আলোচনার টেবিলে।’

প্রসঙ্গত, ২০২১-২২ অর্থবছরে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রতি কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ছিল তিন টাকা ৪৬ পয়সা। বিপরীতে, কয়লাচালিত কেন্দ্রে খরচ হয়েছে ৯ টাকা ১৭ পয়সা, ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রে ২২ টাকা ১০ পয়সা ও ডিজেলচালিত কেন্দ্রে ১৫৪ টাকা ১১ পয়সা। ২৩ হাজার ৪৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের মধ্যে গ্যাসচালিত ৪৭ দশমিক ৮ শতাংশ, ফার্নেস অয়েলচালিত ২৫ দশমিক ২ শতাংশ, কয়লাভিত্তিক ১১ দশমিক ১ শতাংশ এবং ডিজেলচালিত ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।

Link copied!