ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৩, ১২:৫১ এএম
- উৎপাদন কমেছে ৫০ শতাংশ
- কয়েকগুণ বেড়েছে উৎপাদন খরচ
- কর্মী ছাঁটাই চলছে হরহামেশা
চলমান জ্বালানি সংকটে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পে প্রভাব পড়বে
—ড. মো. মফিজুর রহমান
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এসএমই ফাউন্ডেশন
কারখানা সচল রাখা নিয়ে বড় ধরনের সংকটের মধ্যে আছেন উদ্যোক্তারা
—রেজবিন বেগম
শিল্প উদ্যোক্ত
জ্বালানি সংকটে হুমকি মুখোমুখি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তারা। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি ও তার ধারাবাহিকতায় ডলার সংকটের ঘটনায় দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনও ব্যাহত হয়েছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে শিল্প খাত। বৃহৎ ও মাঝারি উদ্যোক্তারা তাদের অন্যান্য ব্যবসার সাথে সমন্বয় করে হিমশিম খাচ্ছেন। আর ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প চরম বিপর্যয়ে মুখে। বহু উদ্যোক্তা কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে আর কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধের পথে।
সংকটের মধ্যেই দফায় দফায় গ্যাস-বিদ্যুৎ দাম বৃদ্ধি ফলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জ নিয়েছে উদ্যোক্তারা। বৃহৎ শিল্পের সঙ্গে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের একই হারে গ্যাসের দাম নির্ধারণ অন্যায্য বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা। অতীতে বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়ানোর সময় ক্ষুদ্র শিল্পের উৎপাদন খরচ যাতে কম বাড়ে সে দিকে নজর রাখা হতো। এবার তা হয়নি। উদ্যোক্তারা জানান, গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এরই মধ্যে ক্ষুদ্র শিল্পের উৎপাদন খরচ ২৫-৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে। কারণ একই সময় কাঁচামালের দামও বেড়েছে। এই খাতে ব্যবহূত প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১৭৮.২৯ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে বিদ্যুতের দাম ১০ শতাংশ বাড়ানো হয়। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বলছেন, আমরা এখন সর্বোমুখী চাপের মধ্যে আছি। নেই নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ। এর মধ্যে দাম বৃদ্ধি হলো।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে শ্রমিকদেরও আগের থেকে বেশি পারিশ্রমিক দিতে হয়। সব মিলিয়ে আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ। জ্বালানি সংকটের দরুণ আমাদের উৎপাদন কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প মূলত স্থানীয় বাজারে বিভিন্ন পণ্য সরবরাহ করে, পাশাপাশি রপ্তানিতেও কিছুটা ভূমিকা রাখে। পুঁজি কম এবং সঞ্চয় সীমিত হওয়ায় উদ্যোক্তাদের ঝুঁকি মোকাবিলার ক্ষমতাও কম। ফলে হুমকিতে পড়তে যাচ্ছে কর্মসংস্থানে বড় ভূমিকা রাখা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পগুলো। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বলছেন, তারা যেসব কারখানা থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করেন, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে উৎপাদন কমেছে। বিপরীতে আমাদের খরচ বেড়ে গেছে। এখন আগের চেয়ে প্রতিটি কাঁচামাল বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। অন্যদিকে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। ফলে সেভাবে পণ্যের দামও বাড়াতে পারছেন না তারা। বাংলাদেশ সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশনের (এসএমইএফ) দেয়া তথ্য মতে, দেশে সিএসএমই খাতের উদ্যোক্তা ছিল এক কোটির ওপরে। করোনার কারণে প্রায় ৩০-৪০ শতাংশের মতো বন্ধ হয়ে গেছে। এখন এই খাতে যদি নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুতে সরবরাহ ও দাম না কমানো হয় তাহলে সামনে আরো শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে। এতে কর্মসংস্থানে বড় ধরনের আঘাত আসবে। তাই এখনই এই খাতকে বাঁচাতে পরিকল্পনা নিয়ে নামতে হবে। সিএসএমই খাত জিডিপিতে অবদান রয়েছে ২৫ শতাংশের মতো।
এসএমই ফাউন্ডেশন ও বিসিক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নকশি কাঁথা তৈরি হয়। তবে ময়মনসিংহ, রাজশাহী, ফরিদপুর ও যশোর নকশি কাঁথার জন্য বিখ্যাত। খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, নিয়মিত গ্যাস বিদ্যুতের অভাবে নকশি কাঁথা শিল্প ক্ষতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। উৎপান খরচও বেড়েছে। তার আগে আমরা করোনার বড় ধাক্কা ফেরিয়ে এসেছি। এদিকে দোকান, রেস্টুরেন্ট বা ফুটপাতে চা, কফি পানে ব্যাপকভাবে বেড়েছে ওয়ানটাইম পেপার কাপের ব্যবহার। পেপার কাপ ২০১২ সালে সর্বপ্রথম কেপিসি নামের প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা বাংলাদেশে উৎপাদন শুরু করেন। এর আগে চাহিদার পুরোটাই আমদানিনির্ভর ছিল। বর্তমানে দেশের সব জায়গায় পেপার কাপ খুব প্রচলিত একটি পণ্য। এই খাতে ২০ থেকে ২৫টি কারখানা গড়ে উঠেছিল। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় বেশির ভাগই বন্ধ হয়ে গেছে। এখন চার-পাঁচজন উদ্যোক্তা উৎপাদনে আছেন বলে জানান বাংলাদেশ পেপার কাপ ম্যানুফ্যাকচারার অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (পিসিএমএবি)।
উদ্যোক্তারা আরও জানান, আমাদের উৎপাদন খরচ প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে। কিন্তু আমরা এক পয়সাও দাম বাড়াতে পারছি না। কারণ সব পণ্যের দাম চাইলেই বাড়ানো যায় না। ফলে ক্ষতির মুখে পড়ে এরই মধ্যে আমার কারখানা থেকে ৫০ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করতে হয়েছে। খরচ সামাল দিতে না পেরে কারখানার উৎপাদনও কমিয়ে দেয়া হয়েছে। পিপলস ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদার গুডসের স্বত্বাধিকারী রেজবিন বেগম। তিনি চামড়াজাত পণ্য জুতা, ব্যাগ, মানিব্যাগ ও বেল্ট উৎপাদন করে বাজারজাত করছেন। সফল এই উদ্যোক্তা ২০২০ সালে পেয়েছেন এসএমই ফাউন্ডেশনের বর্ষসেরা পুরস্কার। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের প্রভাবে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। কারখানা সচল রাখা নিয়ে বড় ধরনের সংকটের মধ্যে আছেন বলে জানান এই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, গ্যাস ও বিদ্যুতের দামের সঙ্গে সব কিছুই সম্পৃক্ত। প্রতিটি কাঁচামালের দাম ২০-২৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। যার ফলে আমাদের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। সেই তুলনায় বাজারে আমাদের পণ্যের মূল্য পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে। কারণ সাধারণ মানুষের বিষয়টি মাথায় নিয়েই আমাদের পণ্য উৎপাদন করতে হয়। প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়েনি। তাই আমরা চাইলেই পণ্যের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করতে পারছি না। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশনের (এসএমইএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. মফিজুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, চলমান বিদ্যৎ সংকটে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে একটু প্রভাব পড়ছে। তিনি বলেন, অবশ্য এখন তেমন একটা লোডশেডিং দেখা যাচ্ছে না। তিনি উদ্যোক্তাদের বরাত দিয়ে বলেন, টানা কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকলে উৎপাদনে খারাপ প্রভাব পড়ে। ‘বিদ্যুৎ গ্যাস এখন জাতীয় সমস্য হয়ে দাঁড়িয়েছে’ যুক্ত করেন তিনি।