Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষাই চ্যালেঞ্জ

সৈয়দ সাইফুল ইসলাম

সৈয়দ সাইফুল ইসলাম

ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৩, ০৮:০৫ এএম


ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষাই চ্যালেঞ্জ
  • ঢাকা নিয়ে মার্কিন-রুশ পালটাপালটি অবস্থান

 

চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে ওঠা নির্ভর করবে কূটনীতিকদের পেশাদারিত্বের ওপর

—ইমতিয়াজ আহমেদ

অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাবি

 

বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরবরাহকারীর ওপর নিষেধাজ্ঞা এলে মুশকিল হবে

 

—সাহাব এনাম খান

অধ্যাপক , আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাবি

 

ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে অব্যাহত যুদ্ধের কারণে ক্রমেই ‘জটিল’ হয়ে উঠছে ‘গ্লোবাল পলিটিক্স’। চলমান এ যুদ্ধে শান্তিপ্রিয় দেশগুলোর কোনো সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও তারা ভুক্তভোগী হচ্ছে ঠিকই। কেননা, এখন আর কোনো দেশ একা চলতে পারছে না। অন্তত বাণিজ্যিক কারণে হলেও একে অন্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সে কারণে ইউক্রেন ও রাশিয়া যুদ্ধে ধাক্কা এসে পৌঁছেছে দক্ষিণ এশিয়ায়ও। বিশেষ করে বাংলাদেশে পণ্যের বাজারে এ যুদ্ধের ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। শুধু তা-ই নয়, বিশ্লেষকদের ধারণা, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষায় ‘ক্রিটিক্যাল’ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে ঢাকা। অভ্যন্তরীণ নানা জটিলতা মোকাবিলার পাশাপাশি ঢাকাকে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন ও ভারতের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া সব সময়ই একে অন্যের প্রতিপক্ষ। এই শক্তিমান দুই প্রতিপক্ষের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করা খুবই চ্যালেঞ্জিং। সেই জটিল ও চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে খুবই সতর্কভাবে পথ চলতে হচ্ছে ঢাকাকে। খুবই দক্ষতা ও কূটনৈতিক পেশাদারিত্বের সঙ্গে পরিস্থিতির মোকাবিলার বিকল্প নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে ওয়াশিংটন ও মস্কোর মধ্যে বিরোধ আরও বৃদ্ধি পায়। এই বিরোধের কারণে একে অপরকে নানা নিষেধাজ্ঞা দেয়। এর দৃশ্যমান প্রভাব বাংলাদেশে পড়ে গত ডিসেম্বরে। ‘উরসা মেজর’ নামের একটি জাহাজ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরঞ্জাম নিয়ে এসেছিল গত ডিসেম্বরে। কিন্তু ওই জাহাজটিতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ছিল। জাহাজটি গত ২৪ ডিসেম্বর মোংলা বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল। এর আগেই (২০ ডিসেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে জানানো হয়, জাহাজটি আসলে উরসা মেজর নয়— এটি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা জাহাজ ‘স্পার্টা-৩’। বিষয়টি যাচাই করার পর বাংলাদেশ জাহাজটিকে বন্দরে ভিড়তে নিষেধ করে। অবশ্য পরবর্তীতে ওই জাহাজটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া বন্দরে যায়। সেখানে রূপপুরের সরঞ্জাম খালাসের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু ভারত সরকারও জাহাজটিকে পণ্য খালাসের অনুমতি দেয়নি। ফলে ১৬ জানুয়ারি ভারতের জলসীমা ছেড়ে যায় ওই জাহাজটি। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকায় রাশিয়ার ৬৯টি জাহাজকে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় প্রবেশে গত ১৬ জানুয়ারি নিষেধাজ্ঞা দেয় সরকার। এরই প্রেক্ষাপটে মস্কোয় নিয়োজিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসানকে তলব করে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা রাশিয়ার জাহাজগুলো বাংলাদেশের বন্দরে ভিড়তে না দেয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তাকে তলব করা হয়েছে। গত ২১ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তলবের ঘটনার পর বিষয়টি নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে। সরকারের পক্ষ থেকে গত বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র  মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলী সাবরীন কথা বলেছেন। তিনি জানান, ‘রাশিয়া বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে ডেকেছিল। সেখানে নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এটাকে ‘তলব’ বলা ঠিক হবে না; কারণ রাশিয়ার জাহাজ ভিড়তে না দেয়ার ঘটনাটি ছয় সপ্তাহ আগের। আমরা মনে করি না, শুধু একটি জাহাজের জন্য বা সুনির্দিষ্ট একটি কারণে রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে।’

এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহাব এনাম খান বলেন, মস্কোয় নিয়োজিত রাষ্ট্রদূতকে তলব একটি নিয়মিত ব্যাপার। এতে শঙ্কা বা উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। তবে মুশকিল হচ্ছে অন্য যায়গায়। তিনি এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের যারা সরঞ্জাম সরবরাহকারী, যদি তাদের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আসে, তাহলে এতে বাংলাদেশের জন্য নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি হবে। এমন নিষেধাজ্ঞার শঙ্কার কথাও জানালেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপক। তিনি বলেন, সম্ভাব্য এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগেই বাংলাদেশকে আগাম প্রস্তুত থাকতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, পৃথিবী এখন বহুমাত্রিক মেরুকরণের দিকে যাচ্ছে। বহুমাত্রিক কাঠামোর সঙ্গে কী ধরনের কূটনীতি হবে— সে বিষয়টি এখনও পরিষ্কার হয়নি। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট কূটনীতিকদের অবশ্যই পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ নীতিতে সম্পর্ক চালিয়ে এসেছে। ফলে বহুমাত্রিক কাঠামোতে বাংলাদেশের বড় ধরনের সমস্যা হবে না। বাংলাদেশের সঙ্গে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর  সঙ্গে সম্পর্কের প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে দেয়া মতামতে তিনি উল্লেখ করেন, বর্তমান কাঠামোয় যে চ্যালেঞ্জগুলো সামনে এসেছে, তা কাটিয়ে ওঠার বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করবে বাংলাদেশের কূটনীতিকদের পেশাদারিত্বের ওপর। তারা কতটুকু পেশাদার এবং কতটুকু তা ব্যবহার করতে পারবেন— বিষয়টি তার ওপর নির্ভর করছে। আগে থেকে  নিজেদের পেশাদারিত্ব বাড়ানোর তাগিদ দেন এ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।

এদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলী সাবরীন বলেছেন, গত ২১ ফেব্রুয়ারি মস্কোয় অবস্থিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসানকে তলব করেছিল রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা রুশ জাহাজগুলো বাংলাদেশের বন্দরে ভিড়তে না দেয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তাকে তলব করা হয় বলে দেশটির সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মস্কোর বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। মস্কো থেকে পাঠানো প্রতিবেদনকে উদ্ধৃত করে সেহেলী সাবরীন বলেন, রাশিয়ার পক্ষ থেকে জাহাজকে বাংলাদেশে ভিড়তে না দেয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে কোনো নির্দিষ্ট জাহাজ বা সংখ্যা নিয়ে আলোচনা হয়নি। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী নিষেধাজ্ঞার বাইরেও রাশিয়ার এক হাজার ১০০ জাহাজ রয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, ‘বাংলাদেশ বাণিজ্যনির্ভর দেশ। এ কারণেই আমাদের দেশের স্বার্থ বিবেচনায় ভেবেচিন্তে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যের পরিমাণ অনেক বড়, প্রায় ৮০ শতাংশ।’

রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে এ বিষয়ে বলা হয়, ‘বাংলাদেশি বন্দরে বাংলাদেশের জন্য পণ্যবাহী রুশ জাহাজ ভেড়ার ক্ষেত্রে তার দেশের কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞাবিষয়ক প্রতিবেদন কূটনৈতিক মিশন প্রধানের নজরে এনেছি আমরা। দেশটি মনে করে, এ পদক্ষেপ ‘ঐতিহ্যগতভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিপরীতে হয়েছে’। বহুমাত্রিক পর্যায়ে আমাদের সহযোগিতার জন্য এটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।’ এ দিকে গত মঙ্গলবার রুশ বার্তা সংস্থা তাসের খবরে বলা হয়, ৬৯টি রুশ জাহাজ বাংলাদেশের বন্দরে ভিড়তে না দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা তাসকে গত সপ্তাহে নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশে রুশ দূতাবাস। দূতাবাস এও জানিয়েছে, এই পদক্ষেপের মানে এই নয় যে, রাশিয়ার মালামাল আমদানির ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৭ ফেব্রুয়ারি রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ নিষেধাজ্ঞার হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ

Link copied!