Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ০৬ নভেম্বর, ২০২৪,

নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন

মহিউদ্দিন রাব্বানি

ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২৩, ০৬:৩৯ পিএম


নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন
  • সবপণ্যের দাম বেড়েছে ৮০ ভাগ
  • সবজিতে হাত পুড়ছে মধ্যবিত্তের

বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। দুই মাসের মাথায় নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে প্রায় ৮০ শতাংশ। সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। এখনও রমজানের প্রায় এক মাস বাকি। এরই মধ্যে কাঁচাবাজার ও মুদিদোকানিরা হাঁকছে উচ্চমূল্য। রমজানের আগেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সংকট, ব্যাংকে এলসি খোলা নিয়ে জটিলতাসহ নানা অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়িয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এ ধরনের সিন্ডিকেটের হাতেই জিম্মি সাধারণ ক্রেতা। রমজানের পণ্য আনতে যাতে সমস্যা না হয়, সেজন্য সরকার বাকিতে পণ্য আমদানির সুযোগ করে দিয়েছে। যদিও সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেছেন, আসন্ন রমজান মাসে দেশের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এবার কমবে, বাড়বে না। মাসটিতে নিত্যপণ্যের মূল্য এবং সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ী, আড়তদার এবং মিল মালিকদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। 

কিন্তু বাজার ঘুরে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। উল্লম্ফন গতিতে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে দিশাহারা ক্রেতাসাধারণ। বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দুই মাসের ব্যবধানে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে আট থেকে ৮৭ শতাংশ। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দুই মাসে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। এতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসনির্ভর নিত্যপণ্যের দামও বেড়েছে। বেপরোয়া বাজার যেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বাস্তব কিছু সমস্যা থাকলেও বড় সমস্যা হলো ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডেকেটের টুটি চেপে ধরার যেন কেউ নেই। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সামান্য লোকবল নিয়ে কাজ করে থাকে। 

মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন অভিযানে দেখা যায় ভোক্তা অধিদপ্তরকে। নিত্যপণ্যের বাজার তদারকির বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে আমাদের অভিযান চলমান। আসন্ন রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগামী রোববার আমদানিকারকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নিয়ে বড় পরিসরে একটি সভার আয়োজন করা হয়েছে। শীতের মৌসুম শেষ এবং সবজি সরবরাহ ক— এ দুই অজুহাতে বাজারে প্রায় সব ধরনের সবজির দাম এখন বাড়তির দিকে। বাড়তি দামে সবজি কিনতে গিয়ে ক্রেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করলেও বিক্রেতারা নির্বিকার। আগামীতে আরও বাড়তে পারে বলেও ক্রেতাদের সতর্ক করে দিচ্ছেন তারা।

রাজধানীর মীরহাজিরবাগ কাঁচাবাজারের সবজি বিক্রেতা মোহাম্মদ আলী আমার সংবাদকে বলেন, আমরা প্রতিটি সবজিতে প্রতি কেজিতে পাঁচ থেকে ১০ টাকা লাভ করি। এখন যেমন লাভ করছি, কিছুদিন আগে যখন দাম কম ছিল, তখনও একই হারে লাভ করে বিক্রি করেছি। কিন্তু পাইকারি বাজারে প্রতিটি সবজির দাম দ্বিগুণ হয়েছে। এ জন্য আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। যাত্রবাড়ীর বউবাজারের সবজি বিক্রেতা রহিমা আমার সংবাদকে বলেন, মৌসুমের শেষদিকে বাজারে শীতকালীন সবজির সরবরাহ কমে গেছে। পাইকারি বাজারে দু-একটি সবজি ছাড়া সব সবজির দাম বেড়েছে এ সপ্তাহে। সবজির ভরা মৌসুমে এভাবে দ্বিগুণ মূল্য বৃদ্ধিতে ক্ষুব্ধ ক্রেতারা।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নাজমুল আলম আমার সংবাদকে বলেন, বাজারে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। কিন্তু আমার বেতন বাড়েনি। বাজার করতে এসে সবজির দোকানগুলোতে দামদর করছি। কিন্তু বিক্রেতারা যেভাবে দাম হাঁকাচ্ছে, তাতে কেনার সামর্থ্য নেই। এমন মূল্যবৃদ্ধি কীভাবে সম্ভব আমার বুঝে আসছে না। তিনি বলেন, শুধু সবজি নয়, মুদি দোকানেও প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে। শহরে পরিবার নিয়ে টিকে থাকা এখন কঠিন হয়ে গেছে। মাছ-মুরগি থেকে শুরু করে বাজারের প্রায় সব পণ্যের দাম ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে গেছে। একটু কম দামের আশায় নিত্যপণ্যের বাজারে নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রেতারা এক দোকান থেকে আরেক দোকানে ছোটাছুটি করছেন। 

তবে তাতে মিলছে না কোনো স্বস্তির খোঁজ। ক্ষুব্ধ ক্রেতাদের অভিযোগ, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে সরকারের দায়িত্বশীলদের মুখে কথার ফুলঝুরি ফুটলেও বাজার নিয়ন্ত্রণে তাদের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়েছে সব পণ্যের। তবে আগের সপ্তাহের বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের দাম। প্রতি কেজি কাঁচামরিচ বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকায়। দুই সপ্তাহ আগে কাঁচামরিচের কেজি ছিল ১২০ থেকে ১৫০ টাকা। 

এছাড়া প্রতি কেজি গরুর মাংস ৭৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হতো ৬৮০ থেকে ৭০০ টাকায়। ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৩০ টাকা। দুই সপ্তাহ আগে ছিল ১৯০ থেকে ২০০ টাকা। সোনালি মুরগির দাম কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩১০ থেকে ৩২০ টাকা। লেয়ার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৮০-২৯০ টাকায়। বাজারে ফার্মের মুরগির ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়। হাঁসের ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকা। দেশি মুরগির ডিমের ডজন ১৯০ টাকা। আকারভেদে বাঁধাকপি ও ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৩০-৩৫ টাকায়। মিষ্টিকুমড়ার কেজি ৪০-৫০ টাকা, চালকুমড়ার পিস ৪০-৫০ টাকা। লম্বা ও গোল বেগুনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০-৮০ টাকা কেজি। টমেটো বিক্রি হচ্ছে ৩০-৪০ টাকায়। শিম ৫০-৬০, ঢেঁড়স ৬০, করলা ১২০-১৪০ এবং প্রতি কেজি আলু ২৭-৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

স্থানভেদে বিভিন্ন বাজারে বরবটি বিক্রি হচ্ছে ৬৫-৮০ টাকা কেজি, চিচিঙ্গা ৫৫-৬০, ঝিঙ্গা ৭০-৯০, পেঁপে ৩০-৪০, কচুর লতি ৬০-৭০, ধুন্দুল ৫০-৬০, ধনেপাতা ১২০ ও গাজর ৪০-৫০,  প্রতি পিস লাউ ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া পেঁয়াজ ৩৫-৪০,  প্রতি কেজি বড় রসুনের দাম ২০০, ছোট রসুন ১২০-১৩০ টাকা। বাজারে কমেছে আদার দাম। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকায়। বাজারে খোলা চিনি প্রতি কেজি ১১৫ থেকে ১২০ টাকা। খোলা আটার কেজি ৬০ টাকা। প্যাকেট আটা ৬৫ টাকা। আগে ছিল ৭০ টাকা। দুই কেজির প্যাকেট আটা বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকায়। বাজারে সয়াবিন তেলের লিটার বিক্রি হচ্ছে ১৮৭ টাকায়। লবণের প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩৮-৪০ টাকায়। মশলার বাজারে দাম অনেকটা গত সপ্তাহের মতোই রয়েছে।  অপরদিকে বাজারে খাসির মাংসের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০০ টাকা করে। আগে বিক্রি হতো ৯০০ থেকে এক হাজার টাকায়। রুই, কাতল, মৃগেল কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩৪০-৩৬০ টাকায়। পাঙাশের কেজি ১৫০-১৬০, তেলাপিয়া ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বাজারে নিত্যপণের্য বেপরোয়া দামের ব্যাপারে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমরা খেয়েপরে ভালো নেই। বাজার যথাযথ নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে সরকার। অর্থ ও মুদ্রানীতিতে ধস নেমেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাজার নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বড় ধরনের অবক্ষয় নেমে আসবে। নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে ভোক্তারা খুব কষ্টে আছে। সাধারণ মানুষের জীবনমানে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারকে জোরালো চেষ্টা চালাতে হবে এবং বাজার তদারকি জোরদার করতে হবে।’

Link copied!