Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৪,

অর্থনীতিতে আঁধার দেখছেন বিরোধীরা

আবদুর রহিম

মার্চ ১, ২০২৩, ০১:১৭ এএম


অর্থনীতিতে আঁধার দেখছেন বিরোধীরা

বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সংকট কেটে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই বরং সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে বলে দাবি বিরোধী রাজনীতিতে। অসহনীয় মূল্যস্ফীতি, নজিরবিহীন ডলার সংকট, ডলারের বিনিময়ে টাকার অভূতপূর্ব অবমূল্যায়ন, ব্যাংকিং ও আর্থিক অব্যবস্থাপনা, বিদেশে অর্থপাচার, সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আয়বৈষম্য। চিরাচরিত ডেনিয়াল সিন্ড্রোম থেকে বেরিয়ে এসে আইএমএফের কাছে প্রেরিত চিঠিতে অবশেষে বিরাজমান অর্থনৈতিক দুর্যোগের কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে সরকার। পরিস্থিতি সামাল দিতে কঠিন শর্তে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। বলতে গেলে সরকার এখন ব্যাংক থেকে ধার করে এবং আইএমএফের ঋণের ওপর ভর করেই চলছে— এমন অভিযোগ বিএনপির।

বিএনপি বলছে, সরকার ব্যাংকগুলোকে ফোকলা করে  ফেলেছে। ক্ষমতাসীনরা অর্থপাচার করে বিদেশে গাড়ি-বাড়ি ও সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। সিঙ্গাপুরসহ দেশে দেশে শ্রেষ্ঠ ধনীর তালিকাভুক্ত হচ্ছে। দেশে-বিদেশে বিলাসী জীবনযাপন করছে। অন্যদিকে গরিব আরও গরিব হচ্ছে। মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, করোনা-উত্তরকালে প্রায় চার কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছে। বর্তমানে ৪২ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উচ্চমূল্যে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।

সরকার গত এক মাসে দুবার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করেছে। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের গড় মূল্য ছিল তিন টাকা ৭৩ পয়সা। নতুন মূল্যহার কার্যকরের ফলে বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে সাত টাকা ৪৯ পয়সা। অর্থাৎ ১৩ বছরে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১০০ দশমিক ৮০ শতাংশ।

এদিকে সরকার গত সাড়ে ১৩ বছরে গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে ৪০০ শতাংশ। বৃহৎ শিল্পে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করেছে। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরকারের রাজস্ব বেড়ে যাবে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। সরকার এখন যে কোনো মূল্যে রাজস্ব বৃদ্ধিতে বদ্ধপরিকর। গত আগস্টে সরকারি হিসাবেই মূল্যস্ফীতি দেখানো হয় ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি কমছে দেখানো হলেও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি এখনো প্রায় দুই অঙ্কের কাছাকাছি রয়েছে। জানুয়ারি মাসে এ হার ছিল ৯ দশমিক আট শতাংশ।

সরকারের নানা ব্যর্থতা তুলে ধরে গতকাল গণমাধ্যমে একটি প্রতিবেদন পাঠায় বিএনপি। ওই প্রতিবেদনে দলটি বলছে, মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ এখন দুই বেলা খেতে পারছে না। আওয়ামী লীগ একদিকে শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে, অন্যদিকে টাকা ছাপিয়ে দেশ চালানো হচ্ছে। গত দুই মাসে ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাপানো হয়েছে।

এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১১২ কোটি ডলার পরিশোধের পর সরকারি হিসাবমতে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছিল ৩২ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন বা তিন হাজার ২৫৭ কোটি ডলার। কিন্তু আইএমএফের হিসাবে এর মধ্যে আট বিলিয়ন বা ৮০০ কোটি ডলার ব্যবহারযোগ্য নয় বলে জানানো হয়। ফলে প্রকৃত অর্থে রিজার্ভ দাঁড়ায় ২৪ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন বা দুই হাজার ৪৫৭ কোটি ডলারে।

বিএনপি গতকাল পাঠানো ওই প্রতিবেদনে সূত্রের বরাত দিয়ে জানায়,  প্রতি মাসে এক বিলিয়ন ডলারের মতো রিজার্ভের পতন হচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ৯২০ কোটি বা ৯ দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশের ইতিহাসে পুরো অর্থবছরেও রিজার্ভ থেকে এত পরিমাণ ডলার বিক্রি হয়নি। ওই সময় ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যাকাউন্টসে ৩৩ শতাংশ ডেফিসিট দেখা দেয়। ২০১৯ সালের আমদানি ব্যয়ের চার হাজার ৯০০ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ২০২২ সালে আমদানি ব্যয় ৮৯০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। সরকার নিশ্চিন্ত মনে দলীয় ব্যবসায়ীদের ওভার ইনভয়েসিং করে আমদানির মাধ্যমে দেদার বিদেশে অর্থপাচারের সুযোগ করে দেয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে অর্থপাচার  অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। প্রবাসী আয়ও কমে যেতে থাকে। 

বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ, দেশে তীব্র ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপাচ্ছে। সরকার ডলার সংকটের কথা স্বীকারই করতে চায় না বরং ডলার সংকটকে আড়াল করতে ইতোমধ্যে নোট ছাপিয়ে বাজারে ছাড়া হয়েছে নতুন ৫০ হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঐতিহ্যগত রেগুলেটরি ভূমিকা থেকে পদস্খলন হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। একটি  রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকের লাখ লাখ কোটি টাকা লোপাট হয়ে যাওয়ায় যে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে, সেটা মোকাবিলায় ওই ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাপা হয়েছে বলে জানা যায়। এই টাকা থেকে ধার নিয়ে ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের সামাল দেয়ার চেষ্টা করলেও টাকা হাতবদলের এই প্রক্রিয়ায় মূল্যস্ফীতি আরেক দফা বাড়বে— সে তোয়াক্কাই করছে না সরকার। এটা চলতে দেয়া যায় না। 

ডলার সংকটে এক বছরে এক লাখ

৫০ হাজার ৬১৮ টাকা হজ প্যাকেজ বেড়েছে : দেশে চরম ডলার সংকট চলছে। বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের রোজা পালনের সময়ে ব্যাপক সরবরাহ ঘাটতি সৃষ্টি হবে বলে বাজার ব্যবস্থাপকরা আশঙ্কা করছেন। এবারের হজ পালনকারীদের ওপরও এর প্রভাব পড়ছে। হজ প্যাকেজের সর্বনিম্ন ব্যয় এক বছরে বেড়েছে এক লাখ ৫০ হাজার ৬১৮ টাকা। এদিকে ডলার সংকটে কয়লা আমদানি করতে না পারায় বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার মাত্র ২৭ দিনের মাথায় বন্ধ হয়ে গেছে বহুল আলোচিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। ডলার সংকটে এলসি খুলতে পারছে না পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। 

ব্যাংক সেক্টরে নৈরাজ্য : গত ছয় মাসে ব্যাংকের অতিরিক্ত ক্যাশ লিকিউডিটি কমেছে ৫৭ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা। ব্যাংক সেক্টরে নৈরাজ্য ও মালিকপক্ষের দৌরাত্ম্যের সঙ্গে না পেরে উঠে সম্প্রতি বড় বড় ব্যাংকের এমডিদের পদত্যাগের হিড়িক পড়েছে, যা আমানতকারীদের মনে আরও আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। 

খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে : খেলাপি ঋণ গত ১০ বছরে তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে। ২০০৯ সালে যেখানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা, তা ২০২২-২৩ সালের প্রথম তিন মাসে এসে দাঁড়িয়েছে ১৩৪৩.৯৬ বিলিয়ন বা এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। তবে পুনঃতফসিলকৃত ঋণ যোগ করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ চার লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

 বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী সংসদে যে শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির তালিকা দিয়েছেন, এ তালিকায় কুখ্যাত রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি হিসেবে পরিচিত একজনের নামও নেই। এরা এতই প্রভাবশালী যে, তারা ঋণ নিয়ে ফেরত না দিলেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বা সরকার বা দেশের বিচারব্যবস্থা তাদের শাস্তি দিতে পারে না। এসব ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি বহালতবিয়তে ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। আইএমএফের শর্ত পূরণে সরকার আন্তরিক নয় বলেও অভিযোগ বিএনপির। দলটি বলছে,  আইএমএফ চাচ্ছে সরকারি ব্যাংকগুলোতে ১০ শতাংশের নিচে ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে পাঁচ শতাংশের নিচে থাকুক খেলাপি ঋণের পরিমাণ এবং আগামী জুন থেকেই তা দৃশ্যমান করতে হবে। পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হবে ২০২৬-এর মধ্যে। কিন্তু সরকার খেলাপি ঋণ আদায়ে বাস্তব, কার্যকর ও ফলপ্রসূ পদক্ষেপ না নিয়ে যতসব ‘অদ্ভুত উপায়ে’ খেলাপি ঋণ কমানোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। এটা এক ধরনের ‘আই ওয়াশ’।

এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট একটি জাতীয় সংকটে পরিণত হয়েছে। এই দুর্বিষহ জাতীয় সংকট থেকে মুক্তি পেতে ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক  মতপার্থক্য ভুলে সরকারকে হটানোর জন্য জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।

অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘রিজার্ভ একবার কমতে শুরু করলে সামাল দেয়া কঠিন; এর প্রবণতাটা গুরুত্বপূর্ণ। একবার কমে যাওয়া শুরু করলে নিয়মনীতির মধ্য থেকে তা আর সামাল দেয়া আমাদের মতো আমদানিনির্ভর দেশের জন্য কঠিন হবে।’ বর্তমানে বাংলাদেশের রিজার্ভ দ্রুত কমে যাওয়ায় অর্থনীতি ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। রিজার্ভ একটু বাড়লে সরকার আত্মতুষ্টিতে নিয়মনীতি ভেঙে রিজার্ভের অর্থ বিভিন্ন প্রকল্পে খরচ করা শুরু করে। অথচ ভুলে যাওয়া হয়েছে যে, রিজার্ভের অর্থ বাজেটের কাজে লাগানো উচিত নয়। রিজার্ভ থেকে অনিয়মিতভাবে নানা নামে আট বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে ফেলেছে সরকার, এর মধ্যে ৭০০ কোটি ডলার বা সাত বিলিয়ন দিয়ে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) গঠন করে ওই টাকা ঋণের নামে সহজ সুদে দলীয় আশীর্বাদপুষ্টদের দেয়া হয়েছে, যা আর কখনো আদায় করা যাবে না বা আদায় হবে না বলে অনেকে ধারণা করেন।

Link copied!