মার্চ ৩, ২০২৩, ০২:৫২ পিএম
দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে এটি শক্তিশালী হয়। জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণে গত এক যুগের প্রচেষ্টায় শতভাগ সাফল্য এসেছে। দেড় কোটি শ্রমিকের ঘামে অর্জিত রেমিট্যান্স ২০২১-২২ অর্থবছরে ২১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। যা ২০০৯-১০ অর্থবছরে ছিল মাত্র ১০ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার। যদিও করোনাকালে বিপুল রেমিট্যান্স প্রবাহের ফলে ইতিহাসের সর্বোচ্চ পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে আসে। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার ।
গতকাল প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের আট মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৪ বিলিয়ন ডলার। যা ২০০৯-১০ অর্থবছরের পুরো সময়ের তুলনায় তিন বিলিয়ন ডলার বেশি। অর্থাৎ গত এক যুগের রেমিট্যান্স প্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বর্তমানে রেমিট্যান্স দ্বিগুণে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে প্রায় প্রতি বছরই রেমিট্যান্স আহরণ বেড়েছে।
২০১০-১১ অর্থবছরে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ১১ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার, ২০১১-১২ অর্থবছরে ১২ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১৪ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৪ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১২ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৪ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৬ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে এসেছে ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলার।
আর চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) এসেছে ১৪ দশমিক শূন্য ১ বিলিয়ন ডলার। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিবাচক পদক্ষেপের ফলে রেমিট্যান্সে এমন সাফল্য এসেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া অর্থমন্ত্রণালয় ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় নীতি সহায়তাসহ প্রবাসী আয় বাড়াতে নিরলস কাজ করছে। অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাথে জনশক্তি রপ্তানি বাড়ানো ও প্রবাসীদের নিরাপত্তায় কাজ করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সর্বোপরি সরকারের সমন্বিত পদক্ষেপের ফলে প্রবাসী আয়ে এমন সাফল্য এসেছে বলে মনে করেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। গত বুধবার প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, সদ্য সমাপ্ত ফেব্রুয়ারি মাসে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় এসেছে ১৫৬ কোটি ১২ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার। দেশীয় মুদ্রায় (প্র?তি ডলার ১০৭ টাকা ধরে) যার পরিমাণ ১৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রবাসী আয় এ?সে?ছিল ১৪৯ কোটি ৪৫ লাখ মার্কিন ডলার। রেমিট্যান্স প্রবাহ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চল?তি বছ?রের জানুয়া?রিতে প্রবাসী আয় এ?সে?ছিল ১৯৫ কোটি ৮৮ লাখ মার্কিন ডলার। এ বছর জানুয়া?রির তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমলেও চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় দেশে রেমিট্যান্স বেশি এসেছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম (জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) আট মাসে মোট রেমিট্যান্স এসেছে এক হাজার ৪০১ কোটি ৩৩ লাখ মার্কিন ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল এক হাজার ৩৪৩ কেটি ৮৫ লাখ মার্কিন ডলার। আলোচ্য সময়ে ৫৭ কোটি ৪৮ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স বেশি এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, ফেব্রুয়ারি মাসে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ২৭ কোটি ৫৭ লাখ ১০ হাজার ডলার, বিশেষায়িত ব্যাংকের মাধ্যমে তিন কোটি ৮৮ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার, বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে ১২৪ কোটি পাঁচ লাখ ডলার এবং বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৬১ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স। আলোচিত সময়ে সাত ব্যাংক কোনো রেমিট্যান্স সংগ্রহ করতে পারেনি। এগুলো হলো— বিডিবিএল, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক বা রাকাব, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক, হাবিব ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান এবং স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া।
রেমিট্যান্স বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা উদ্যোগ নিয়েছে। বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে বিভিন্নভাবে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। রেমিট্যান্স বাড়াতে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সেগুলোর মধ্যে আছে— আড়াই শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা, রেমিট্যান্স প্রেরণকারীদের সিআইপি সম্মাননা প্রদান, রেমিট্যান্স বিতরণ প্রক্রিয়া সমপ্রসারণ ও সহজীকরণ, অনিবাসী বাংলাদেশিদের জন্য বিনিয়োগ ও গৃহায়ণ অর্থায়ন সুবিধা, ফিনটেক পদ্ধতির আওতায় আন্তর্জাতিক মানি ট্রান্সফার অপারেটরকে বাংলাদেশের ব্যাংকের সঙ্গে ড্রয়িং ব্যবস্থা স্থাপনে উদ্বুদ্ধকরণ এবং রেমিট্যান্স প্রেরণে ব্যাংক বা এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোর চার্জ ফি মওকুফ করা।
সর্বশেষ সেবার বিনিময়ে রেমিট্যান্স আয় আনার ক্ষেত্রে ফরম-সি পূরণ করার শর্ত শিথিল করা হয়েছে।সম্প্রতি রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়। রেমিট্যান্স পাঠাতে চার্জ মওকুফ ও ছুটির দিনে অর্থ পাঠানোর সুবিধা এর মধ্যে অন্যতম। এ ছাড়া সম্প্রতি হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো রেমিট্যান্সের ২৩০ জন বেনিফিশিয়ারির হিসেবে সাময়িকভাবে উত্তোলন স্থগিত করে বিএফআইইউ। বলা হয়, ভবিষ্যতে বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠাবে— এমন প্রতিশ্রুতি দিলে হিসাবগুলো খুলে দেয়া হবে। হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রতিরোধে এমন কিছু নতুন কৌশল নিয়েছে বিএফআইইউ।