মার্চ ৭, ২০২৩, ১২:৩৮ এএম
- ১৪ বছরে ১৩ বার বেড়েছে বিদ্যুতের দাম
- চলতি বছরের প্রথম দুই মাসেই বেড়েছে তিন বার
- বিদ্যুতের আগুনে জ্বলছে নিত্যপণ্যের বাজার
ভুল পরিকল্পনা ও নানা অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত
—এম শামসুল আলম
জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, ক্যাব
সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় ঘাটতি আছে এতে চাপ পড়ছে গ্রাহকের ওপর
—ম. তামিম, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
দেশে প্রতি মাসেই বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। গত দুই মাসে দাম বাড়ে তিনবার। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সরকার নির্বাহী আদেশে সমন্বয়ের নামে এ দাম বৃদ্ধি করে আসছে। সর্বশেষ ২৮ ফেব্রুয়ারি ৫ শতাংশ বাড়ে বিদ্যুতের মূল্য। এ নিয়ে গত ১৪ বছরে পাইকারি পর্যায়ে ১১ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১৩ বার বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। অবশ্য ২০০৯ সালের তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা পাঁচগুণের বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ৮২৬ মেগাওয়াটে। নিত্যপণ্যের আকাশছোঁয়া দামে এমনিতেই হাঁসফাঁস জনজীবন। তার ওপর প্রতি মাসে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম। অবশ্য রান্নার কাজে ব্যবহূত তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) সম্প্রতি ১৪ কেজি সিলিন্ডারে ২৬৬ টাকা বেড়ে কমেছে ৭৬ টাকা। যা কমল তার থেকে ৩.৫ গুণ বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউক্রেন-রশিয়ার যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে বিশ্বব্যাপী। ফলে বৈশ্বিক এই ক্ষতির মুখোমুখি হয় বাংলাদেশও। অর্থ সংকটে পড়ে দেশ। যার কারণে সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ঋণ প্রস্তাব করে। এতে আইএমএফ শর্ত দিয়েছে সরকারের ভর্তুকি কমানোর। বাংলাদেশ আলোচনা পর্যায় থেকে এই শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে মাসে মাসে বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। ইতোমধ্যে আইএমএফ পিডিবি ও বিদ্যুৎ বিভাগের সাথে বৈঠকে মিলিত হয়। সংস্থাটি বিইআরসির সাথেও আলোচনায় বসে।
এই অসম মূল্যবৃদ্ধিতে ভোক্তা সংশ্লিষ্টরা একে জনগণের সাথে মশকরা করছে বলে মন্তব্য করেছে। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পালে হাওয়া দিচ্ছে বিদ্যুতের নিয়মিত মূল্যবৃদ্ধি। ইতোমধ্যে তিন মাসে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ আর পাইকারিতে ২৮ শতাংশ। সরকার দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ালেও সংকট কাটছে না। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সমস্যা সামাল দিতে অগ্রিম টাকাও নিচ্ছে বিতরণ কোম্পানিগুলো থেকে। এমন পরিস্থিতিতে গ্রাহকের প্রশ্ন— আর কত বাড়বে বিদ্যুতের দাম।
আগে গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করত এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। আইন সংশোধন করে এ ক্ষমতা হাতে নিয়েছে সরকার। এরপর থেকে নির্বাহী আদেশে দাম বাড়ানো হচ্ছে। বিদ্যুতের নতুন দাম অনুযায়ী, আবাসিকের লাইফ লাইন (৫০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী) গ্রাহকদের প্রতি ইউনিটের জন্য চার টাকা ১৪ পয়সার পরিবর্তে চার টাকা ৩৫ পয়সা দিতে হবে। এ দফায় আবাসিক গ্রাহকদের ক্ষেত্রে শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিটের দাম চার টাকা ৬২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে চার টাকা ৮৫ পয়সা, ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিটের দাম ছয় টাকা ৩১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ছয় টাকা ৬৩ পয়সা, ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিটের দাম ছয় টাকা ৬২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ছয় টাকা ৯৫ পয়সা, ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিটের দাম ছয় টাকা ৯৯ পয়সা থেকে বাড়িয়ে সাত টাকা ৩৪ পয়সা, ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিটের দাম ১০ টাকা ৯৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১১ টাকা ৫১ পয়সা এবং ৬০০ ইউনিটের উপরে দাম ১২ টাকা ৬৩ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৩ টাকা ২৬ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এদিকে বর্তমান সরকারের টানা ১৪ বছরের মেয়াদে গ্রাহক পর্যায়ে ১৩ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। আর পাইকারি পর্যায়ে বৃদ্ধি করেছে ১১ বার। যদিও মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতাও বেড়েছে। ২০০৯ সালের তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা পাঁচ গুণের বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ৮২৬ মেগাওয়াটে।
গত ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের গড় মূল্য ছিল ৩ টাকা ৭৩ পয়সা। ২০১০ সালের মার্চে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। তখন গড় বিদ্যুৎ বিল বেড়ে দাঁড়ায় তিন টাকা ৯২ পয়সা। পরের বছর (২০১১ সাল) গ্রাহক পর্যায়ে দুই দফায় ৫ শতাংশ ও ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। এতে বিদ্যুতের গড় দাম বেড়ে দাঁড়ায় চার টাকা ৬৭ পয়সা। এভাবে ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কয়েক দফা বাড়ে বিদ্যুতের দাম। মাঝে ২০১৮-১৯ এ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়নি। এরপর ফের ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিদ্যুতের দাম সব পর্যায়ে বাড়ানো হয়। তখন পাইকারিতে দাম ৮ দশমিক ৪ শতাংশ বৃদ্ধির পাশাপাশি সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে (খুচরা) বাড়ানো হয় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। তাতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম সাত টাকা ১৩ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। সবমিলে ২০১০ সাল থেকে ২০২৩ সালের প্রথম দুই মাস পর্যন্ত ১৪ বছরে বিদ্যুতের দাম ১৩ বার বাড়ানো হয়।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, ‘যেভাবে দাম বাড়ছে এতে সব কিছুর উপর প্রভাব পড়ছে। চাপ পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর। সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় ঘাটতি রয়েছে। সরকার যদি আগে থেকেই পরিকল্পিতভাবে কাজ করত, কয়লার বিষয়টা আগে থেকেই চিন্তা করে রাখত, তবে এখন এই অবস্থার সম্মুখীন হতে হতো না।’
বারবার দাম বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভোক্তা সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. শামসুল আলম আমার সংবাদকে বলেন, জনগণের ওপর অন্যায়-অবিচার করা হচ্ছে। সরকারের ভুল নীতির মাসুল জনগণের ওপর অযৌক্তিকভাবে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।
আমরা কেউ ভালো নেই। ভুল পরিকল্পনা এবং নানা অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। ফলে বারবার দাম বাড়ানো হচ্ছে। মানুষের ওপর বোঝা চাপানো হচ্ছে। পিডিবি বারবার লোকসানের অজুহাতে দাম বাড়াচ্ছে।