মাসুদুল হাসান অলড্রিন
মার্চ ৯, ২০২৩, ১২:৫২ এএম
মাসুদুল হাসান অলড্রিন
মার্চ ৯, ২০২৩, ১২:৫২ এএম
‘পোশাক খাতে ৮০ শতাংশের বেশি নারী বেতন পাচ্ছেন মোবাইলের মাধ্যমে’
—মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা ইন্দিরা
অমর্ত্য সেনও স্বীকার করেছেন ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের নারীরা এগিয়ে গেছেন
—অধ্যাপক জিনাত হুদা
সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে
—কোহেলী কুদ্দুস মুক্তি, নারী নেত্রী
বিগত দেড় দশক আগে থেকে বাংলাদেশের নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন। শুরু করেছেন দীপ্ত পদচারণা। সব ক্ষেত্রে এ দেশের নারীরা প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে শুরু করেছেন। বিভিন্ন চ্যালেঞ্জিং পেশাতেও তারা একের পর এক নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনী, জনপ্রশাসন থেকে আকাশ প্রতিরক্ষা বাহিনী, সাফ জয় থেকে সর্বোচ্চ পর্বত জয় করেছেন বাংলাদেশি নারীরা। উচ্চ আদালতের বিচারকের মতো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদেও আসীন হয়েছেন নারীরা। ইউপি সদস্য থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, সংসদের স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী, সংসদে সরকার দলীয় নেতা, উপনেতা, এমনকি বিরোধী দলীয় নেতাও নারী। নারীরা এখন আর শুধু গৃহকর্মে সীমাবদ্ধ নেই, তারা থেকে রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর পদেও রয়েছেন।
প্রতি বছরের মতো এবারো গতকাল ৮ মার্চ সারা বিশ্বে পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। দিবসটির মূল লক্ষ্য ছিল নারীর অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা। এবার নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন।’ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের বিভিন্ন নীতিমালা ও উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে নারী ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা ইন্দিরা বলেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মার্ট বাংলাদেশের অভিযাত্রা শুরু করেন। এই নতুন অভিযানের আওতায় প্রযুক্তির সমর্থনে পরিচালিত হবে বাংলাদেশের সব অর্থনৈতিক কার্যক্রম।’
বাংলাদেশের এই প্রযুক্তি নির্ভর উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় নারীরা নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করার সমান সুযোগ পাবে, যা তাদেরকে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সহায়তা করবে। নারীর জন্য সরকারের নানা উদ্যোগ নিয়ে ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা বলেন, ‘সারা দেশে প্রায় পাঁচ হাজার ডিজিটাল সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে অর্ধেকেরও বেশি নারী কর্মী নিয়োজিত রয়েছেন। বাংলাদেশের পোশাক খাতে কর্মরত শ্রমিকের ৮০ শতাংশের বেশি নারী, যারা মোবাইলের মাধ্যমে তাদের মাসিক বেতন পেয়ে থাকেন।’ প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, ‘বর্তমান সরকার আরেকটি প্রযুক্তিভিত্তিক প্রকল্প ইনফো লেডি চালু করেছে, যার মাধ্যমে সারা দেশের প্রায় ১০ দশমিক ২৫ মিলিয়ন গ্রামীণ নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব হয়েছে।’
এ ছাড়া নারীদের সহিংসতা ও যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সুরক্ষার জন্য ‘জয়’ নামে একটি মোবাইল অ্যাপ চালু করা হয়েছে এবং দুটি সার্বক্ষণিক হটলাইন সার্ভিস ১০৯ এবং ৯৯৯ প্রবর্তন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। প্রতিমন্ত্রী ইন্দিরা বলেন, বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে আইসিটিতে নারীর অংশগ্রহণ ৩০ শতাংশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা প্রণয়ন করেছে। এসব লক্ষ্য অর্জনে জাতিসংঘ ও উন্নয়ন সহযোগিদের সহায়তা ও অংশীদারিত্ব কামনা করেন তিনি। নারীর অগ্রগতি ও প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জানতে চাইলে সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিনাত হুদা বলেন, ‘বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বে নারীর ক্ষমতায়নে একটি রোলমডেল।
অমর্ত্য সেনও স্বীকার করেছেন, ভারতের নারীদের পিছিয়ে দিয়ে বাংলাদের নারীরা এগিয়ে গেছে। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সব সেক্টরে আমরা নারীদের সুসংহত অবস্থান দেখতে পাচ্ছি। উদারহণস্বরূপ নারীর ক্ষমতায়ন, প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নারীর অবস্থান প্রভৃতিসহ নানা চ্যালেঞ্জিং পেশায় নারী প্রবেশ করেছে। ক্রিকেটের বিজয়ে ও ফুটবলের বিজয়ে, এমনকি হিমালয়ও জয় করেছেন আমাদের নারীরা। এখন গ্রামের মেয়েরাও সড়কে সাইকেল ও স্কুটি চালাচ্ছেন। সবদিক থেকে নারীদের উন্নয়ত-অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে। সমাজে বিরাজমান প্রতিবন্ধকতা মাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তারা। বর্তমান সরকার প্রধান সন্তানের পরিচয়ে বাবার পাশাপাশি মায়ের নাম সংযুক্ত করে দিয়েছেন। বীরঙ্গনা নারীদের বীর মুক্তিযোদ্ধা খেতাব দিয়ে দিয়েছেন।
বিশেষ করে ইতিহাসে যেসব নারী অদৃশ্য তাদেরকে সামনে নিয়ে এসেছেন। এ ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।’ তিনি বলেন, ‘তবে এই অগ্রগতির সাথে সাথে কিছু নেতিবাচক চিত্রও আছে। বিরোধী একটি শক্তি নারীকে যাতে থামিয়ে দেয়া যায়; এমন অত্যন্ত রক্ষনশীল একটি ধারা সমাজে এখনো বিরাজমান আছে। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও আছে এবং নারীর প্রগতিবিরোধী ধারাটি নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকেন, ধর্মের নানা ধরনের অপব্যাখ্যা দেন। নান কুসংস্কার এখনো সমাজে রয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, পরিবারের মধ্যেই এগুলো আছে। পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক একটি দিকও রয়ে গেছে, নারীকে এখনো আমরা সেকেন্ড জেন্ডার চিন্তা করি। যদিও এ নিয়ে বিতর্ক আছে কে কাকে ‘ফার্স্ট জেন্ডারের’ তকমা দেয়। নারীও এখনো পরিবার থেকে কর্মক্ষেত্রে অবহেলায় রয়ে গেছে। নারীর নিরাপত্তা নিয়ে এখনো একটি নাজুক অবস্থায় আছি আমরা।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী জানতে চাইলে অধ্যাপক জিনাত আমার সংবাদকে বলেন, ‘সারা বিশ্বটাই এখনো পুরুষতান্ত্রিক, বাংলাদেশ তো বটেই। এই অবস্থা থেকে বের হওয়ার জন্য নারীবান্ধব সমাজ ও লিঙ্গ সমতার সমাজ গঠনে কাজ করতে হবে। নারীর মানবাধিকার আছে, এই বিষয়গুলোকে আমাদের পরিবার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত আনতে হবে। মা বাবা সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আমরা এই শিক্ষাটিকে ছড়িয়ে দিতে পারি। ব্যক্তিগতভাবে আমার একটি কন্যা সন্তান নিয়ে আমি অত্যন্ত গর্বিত।
নারী পুরুষের ভেতর পার্থক্য আছে বলে, আমি বিশ্বাস করি না। এই দৃষ্টি ভঙ্গি কিন্তু অনেকের মধ্যে এসে গেছে। এখানে সরকারের একটি ভূমিকা থাকবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমেরও একটা ভূমিকা আছে। আমরা বিভিন্ন সেক্টরে যদি একসাথে কাজ করি তাহলে, নারী পুরুষের সমন্বিত যুগযাত্রা সফল হবে, আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।’ নারীর ক্ষমতায়ন কতটা হয়েছে আরো কি প্রয়োজন জানতে চাইলে রাজনীতিক ও নারী উন্নয়ন কর্মী কোহেলী কুদ্দুস মুক্তি বলেন, ‘সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক; এই তিন ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালত কলকারখানা স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল ক্লিনিক এবং বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো আনুষ্ঠানিক কর্মস্থলেও নারীর কর্মক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে।
তবে আমাদের বেশির ভাগ নারীই এখনো মূল স্রোতের বাইরে। নারীর পরিপূর্ণ ক্ষমতায়নের জন্য তার নিজস্ব যোগ্যতা, দক্ষতা ও শক্তি কাজে লাগানোর অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে।’ এই নারী উন্নয়নকর্মী বলেন, ‘পুরুষের মানসিকতা পরবির্তন হওয়া উচিত। পরিবারের পুরুষরা যদি নারীর প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করেন, তাহলে নারীর পথচলা অনেকাংশেই সহজ হবে।’