Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৪,

তিন দলে ভোটের যত হিসাব

আবদুর রহিম

মার্চ ১৭, ২০২৩, ০২:২০ এএম


তিন দলে ভোটের যত হিসাব

বিএনপির গতিবিধি নজরে রাখছে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি ও  চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্তে অটল বিএনপি। গত রোববার ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) দৃঢ়ভাবে জানিয়েছে দলটি এবং গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জানিয়েছেন, শেখ হাসিনার অধীনে কোনো সংলাপেও বসবে না তারা। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি যদি শেষ পর্যন্ত ভোটে না যায় তাহলে দেশে ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে রাজনৈতিক দলগুলো আশঙ্কা করছে। অন্যদিকে এবার পশ্চিমা দেশগুলো কূটনীতির অন্দরে ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে টানা তিনবার ভোটে প্রকাশ্যে থাকা জাতীয় পার্টিও নানা হিসাব করছে।

পার্টির একটি অংশ বিএনপির সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে। ভোটের আগে দল ভেঙে জাতীয় পার্টির একটি অংশ বিএনপির সাথে যোগ দেয়ারও নানা গুঞ্জন উঠেছে। তারা ৮০টি আসনের খসড়া পৌঁছিয়েছে বড় দুই দলে। জয়ের বাতাস যে দিকে ভারী হতে পারে সে দিকেই জাপা পা বাড়াবে। অন্যদিকে বিএনপির জোট সঙ্গী জামায়াতে ইসলামীতে এবার ভিন্ন হিসাব চলছে। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি) নামে আবেদন করা দলটি নিবন্ধন পেলে তারা এককভাবে ভোটে যেতেও প্রস্তুতি নিচ্ছে। আবার সরকার পতনে এক দফায় চূড়ান্ত প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে। আন্দোলনে যদি বিএনপি প্রকাশ্যে মাঠে নামে তাহলে জামায়াত আন্দোলনেই বেশি মনোযোগী হবে। আর বিএনপি যদি শেষ বেলায় কৌশলী হয়ে উঠে তাহলে জামায়াত ভোটের মাঠ ও রাজনীতিকে প্রাধ্যন্য দেবে। এদিকে জামায়াতের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলনের সাথে সখ্য বাড়িয়েছে বিএনপি। দলের বার্তা নিয়ে চরমোনাইয়ের সাথে একটি বৈঠকও সেরেছে দলটি।

আ.লীগ-বিএনপি দুই শিবিরেই জাপার যোগাযোগ : আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি— দুই শিবিরেই যোগাযোগ রেখে চলছে জাতীয় পার্টি। বিএনপি যদি শেষ সময়ে এসে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন না করে তাহলে পরিস্থিতির শুভ লক্ষণ দেখছে না জাতীয় পার্টির ভোট পর্যবেক্ষদের একটি অংশ। চতুর্থবারও সরকারকে সমর্থন দিয়ে ভোটে যাবে কি-না এ নিয়ে পর্দার আড়ালে হিসাব বুঝে নিচ্ছে দলটি। ধারাবাহিক গত তিনটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভোটে থাকলেও দ্বাদশে হয়তো এবার প্রকাশ্যে নাও থাকতে পারে। অতীতে সারা দেশে দলটি ৩০০ আসনে নির্বাচন করার প্রার্থী থাকলেও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর তাতে ভাটা পড়েছে। বর্তমানে জাপার একটি অংশ বিএনপির সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে, তারা সরকারের বলয় থেকে বের হতে চাচ্ছে। 

আরেকটি অংশ সরকারের সঙ্গেই থাকতে চাচ্ছে বলে জাতীয় পার্টির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে। ইতোমধ্যে অনানুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগের কাছে ৮০টি আসন চেয়েছে জাপা। অন্যদিকে আসনের বিষয়ে একই ধারণা দিয়েছে বিএনপিওকেও। সমপ্রতি বনানীতে একটি অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন,         এ মুহূর্তে এককভাবেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের        প্রস্তুতি নিচ্ছি। এ জন্য ৩০০ আসনে প্রার্থী ঠিক করতে কাজ শুরু করেছি। এরই মধ্যে বেশ কিছু আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী চূড়ান্ত করে তাদের নির্বাচনি প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে।

এদিকে জাতীয় নির্বাচনের আগে দলীয় ঝামেলা নিয়ে এখনো ভুগছে দলটি। একটি পক্ষ দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের বাইরে বলয় তৈরির চেষ্টা করছে। তারা দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইছে। অন্যদিকে জি এম কাদের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দল পরিচালনা ও নেতাকর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে দলে নতুন বলয় তৈরি করেছেন। এ দূরত্বের মধ্যে নির্বাচনের আগে কোনো বিস্ফোরণও ঘটতে পারে। একাংশ ভেঙে বিএনপির সঙ্গেও যুক্ত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে চোখ রাখেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাজমুল হোসাইন। তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টি তত্ত্বাবধায়ক সরকারে বিশ্বাস করে না। তারা ভালো করেই জানে, এককভাবে নির্বাচন করলে জাতীয় পার্টি হয়তো রংপুরে কয়েকটি আসন পেতে পারে। আর জাতীয় পার্টির ১৩ বছরের ভূমিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিএনপি নির্বাচনে না এলেই জাতীয় পার্টির লাভ, সংসদে তারা বিরোধী দলে থাকার সুযোগ পাবে। নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির ভূমিকাই ছিল মুখ্য, তারা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে, বিএনপির কারণেই এরশাদের পতন হয়েছিল, আ.লীগ-জামায়াত তো তখন এরশাদের সংসদেই ছিল। সে কারণে বিএনপির প্রতি জাতীয় পার্টির প্রতিশোধপরায়ণতা এখনো বিদ্যমান। সুতরাং জাতীয় পার্টি এখন যা-ই বলুক তারা নিজেদেরই সৃষ্টি করা গণ্ডি থেকে বের হয়ে আসতে পারবে না।

এক দফার আন্দোলন না হয় বিডিপি ব্যানারে ভোটে যাবে জামায়াত : সরকার পতনে এক দফার আন্দোলনে প্রস্তুতি নিচ্ছে জামায়াত। কোনো আন্তর্জাতিক চাপ বা কৌশল নয়, বিএনপিকেও প্রকাশ্যে মাঠে চাইবে চলটি। আন্দোলনে যদি বিএনপি একমত হয় তাহলে জোরালো আন্দোলন নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবে। আর বিএনপি যদি পিছু হটে তাহলে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি) নামে আবেদন করা দলটি নিবন্ধন পেলে তারা এককভাবে ভোটে যেতেও প্রস্তুতি নিচ্ছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আবারও জোটবদ্ধ হলে দলটির তৃণমূলে প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে জামায়াতের নীতিনির্ধারণী ফোরাম। তাই আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে তারা বিএনপিকেও স্নায়ুচাপে রেখেছে আবার সরকারের সঙ্গেও পর্দার আড়ালে ডোন্ট ডিস্টার্ব নীতি গ্রহণ করে চলছে। 

জামায়াতের নির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি, জামায়াত বর্তমান সরকারের পরিবর্তনে বেশি মনোযোগী। আবার বিএনপির আন্দোলনের ধীর গতি দেখে ভোটের রাজনীতিতে টিকে থাকতে আওয়ামী লীগের সাথে সখ্য তৈরিতেও একটি অংশ আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে। আওয়ামী লীগ জামায়াতের সাথে দূরত্ব কমিয়ে আনতে পর্দার আড়ালে সঙ্গী হতে আহ্বান করে যাচ্ছে বলেও দলটির নেতারা দাবি করছেন। তবে ভোটে নামিয়ে দিয়ে শেষ সময় যদি আওয়ামী লীগ চুক্তি ভঙ্গ করে এবং ন্যূনতম আসনও না দেয়— যেমন একাদশে বিএনপির ভরাডুবি হয় যদি সেই দৃশ্যপট তৈরি হয় এমন আশঙ্কাও করছে। আওয়ামী লীগের কোনো ইঙ্গিতকেই বিশ্বাস করছে না দলটি। পরে তারা দুই কুলেই হারাতে পারে। হতে পারে বিএনপির চিরশত্রু আবার ভিন্ন নীতির কারণে নিজ দলেও ভাঙন হতে পারে।   

সমপ্রতি জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এক দফার আন্দোলনে রাজপথে সাহসিকতার সঙ্গে অগ্রণী ভূমিকা পালন করার জন্য সবাইকে প্রস্তুতি নিতে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘এক দফা আন্দোলনের মাধ্যমে কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে রাজপথের এক দফা আন্দোলনে সাহসিকতার সঙ্গে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।’

চরমোনাইয়ের সাথে সখ্য বাড়াল বিএনপি, ভাবছে জামায়াতের বিকল্প : রাজনীতি ও ভোটের পলিসিতে জামায়াতকে আর বিশ্বাস করছে না বিএনপি। রয়েছে দূরত্ব। ১০ ডিসেম্বর সমাবেশে ঘোষণা হওয়া ১০ দফার দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের প্রথম কর্মসূচি পালন করে পিছু হটে দলটি। মৌচাক এলাকায় জামায়াতের কর্মসূচিতে বাধা ও গ্রেপ্তার ইস্যুতে বিএনপি থেকে কোনো বিবৃতি না পেয়ে আন্দোলন থেকে একলা চলো নীতি গ্রহণ করে দলটি। সেই থেকে ভোটের আগে জামায়াত ইস্যুতে কোনো ভাটা তৈরি হলে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ দিয়ে তার ঘাটতি পূরণের চেষ্টা চলছে। বিএনপি যে আন্দোলন ঘোষণা করবে জোটসহ ধর্মীয় জোটকেও পাশে চায় বিএনপি। সমপ্রতি বরিশালে চরমোনাই পীরের সাথে সেখানকার মাহফিলের মেহমানখানায় বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল বৈঠকও করেছে। ওই বৈঠকে দলের ভাবনা ও চরমোনাইকে পাশে চাওয়ার বার্তা পৌঁছে দেয়া হয় বলে বিএনপি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

সমপ্রতি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম চরমোনাই পীরও তার বক্তব্যে নানা ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, চরমোনাই  নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের অধীন ছাড়া কোনো তামাশার নির্বাচনে অংশ নেবে না। দলীয় সরকারের অধীন সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। বিগত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচন ও স্থানীয় নির্বাচনে এটি বারবার প্রমাণিত হয়েছে। সরকারকে পদত্যাগ করে, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। 

দেশের উত্তপ্ত পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিকল্প নেই। রাজনীতির চলমান পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল আমার সংবাদকে বলেছেন,  ‘সুষ্ঠু নির্বাচন তখনই সম্ভব যখন জনগণের জন্য একটি সমান ক্ষেত্র বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকে। সাথে ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি থাকে। গত নির্বাচনগুলোর তুলনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচন অনেকটাই ভালো ও নিরপেক্ষ হয়েছিল। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা দেখা যাচ্ছে।  তাদের দূরদর্শী চিন্তা ও প্রস্তুতি সঙ্গে অনেক কিছুই নির্ভর করে।’

Link copied!