মাসুদুল হাসান অলড্রিন
মার্চ ১৭, ২০২৩, ০২:২৪ এএম
মাসুদুল হাসান অলড্রিন
মার্চ ১৭, ২০২৩, ০২:২৪ এএম
এতদিন একটি ক্যাম্পাসে কমিটি না থাকা অস্বাভাবিক। আশা করি নতুন কমিটি দ্রুত এই জটিলতা নিরসন করবে
— আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম
দীর্ঘদিন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি না থাকাটা দুঃখজনক, দ্রুত এই ইউনিটের কমিটি হওয়া প্রয়োজন
—বিএম মোজাম্মেল হক
দিন মাস বছর গড়িয়ে প্রায় সাত বছর হলো ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনটি কমিটি হয়। এর মধ্যে ২০১২ সালে একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয় এবং ২০১১ ও ২০১৬ সালে একটি করে আহ্বায়ক কমিটি হয়। সর্বশেষ ২০১২ সালের অক্টোবরে একটি কমিটি গঠন করে পরবর্তী বছর নভেম্বর মাসে ভেঙে দেয়া হয়। দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে ফারুক নামের একজন কলেজছাত্র নিহত হন। এর জেরে কেন্দ্র থেকে কমিটি ভেঙে দেয়া হয়। ২০১৬ সালে নভেম্বরে ১২৭ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। ২০১৭ সালে বছরের শুরুতেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কারণে আবারো কেন্দ্র থেকে এই কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় নেতারা। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাস থেকে আক্ষরিক অর্থে ঢাকা কলেজের কোনো কমিটি নেই।
ফলে নানা রকম অনিয়ম ও বিশৃঙ্খল ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। ২০২২ সালে এপ্রিল মাসে ব্যবসায়ীদের সাথে ছাত্রদের একটি বড় রকমের সংঘর্ষ বাধে, তখন দুজনের প্রাণহানি ঘটে। সর্বশেষ গত বছর বেশ কয়েকটি সংর্ঘষের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে একটি হলো— ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। অনিয়ন্ত্রিত দোকান কর্মচারী ও ছাত্রদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘটিত এই সংঘর্ষে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নেহায়েত কম ছিল না। দু’পক্ষেই বেশ কিছু লোক আহত হন এবং দুজন পথচারী নিহত হয়। একই বছর সেপ্টেম্বর মাসে কলেজের দুই গ্রুপ ছাত্রদের মধ্যে আরেকটি সংঘর্ষ হয়, এতে একাধিক ছাত্রকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। আবার নতুন বছরের মার্চ মাসে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতেও হতাহত হয় কয়েকজন। সারা বছর এরকম ছোট বড় সংঘর্ষের ঘটনা লেগেই থাকে। কখনো সেটি নিজেদের মধ্যে কখনো বাইরের লোকজন বা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এসব বিরোধী ও সংঘর্ষ হয়। তাৎক্ষণিকভাবে শিক্ষকরা এসব মীমাংসা করলেও মাঝে মধ্যে ছাত্রনেতাদের ভূমিকার অনুপস্থিতি টের পাওয়া যায় প্রকটভাবে।
অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা কলেজের কমিটি ভেঙে যাওয়ার অন্যতম কারণ অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের একাধিক গ্রুপের মধ্যে নানা কারণে মূলত সংঘর্ষ হয়। ২০০৮ সালের পর গত ১৫ বছরে মাত্র তিনটি কমিটি করা হয়। সবগুলো কমিটি সংঘর্ষের কারণেই ভেঙে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ২০১২ সালে ৫৬ সদসদ্যের একটি ঢাউস কমিটি করা হয়। কেন্দ্র থেকে এত বড় কমিটি দেয়ার কারণে চেইন অব কমান্ডের ঘাটতি দেখা গেছে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে ২০১৬ সালে। গঠনতন্ত্রের নিয়ম ভেঙে ১২৬ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি দেয়া হয়। এতে নানা দল, উপ-দলে বিভক্ত হয় সংগঠন। ফলে এবারও চেইন অব কমান্ডের ঘাটতি দেখা দেয়। তুচ্ছ কারণে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ সংঘর্ষ জড়িয়ে পড়ে নেতাকর্মীরা। ফলে তৃতীয়বারে কমিটি ভেঙে যায়। ছাত্রলীগের সাবেক একজন নেতা জালালউদ্দিন বলেন, নির্দিষ্ট সময়ে কমিটি পূর্ণাঙ্গ না করা, কমিটি হওয়ার পরই একক আধিপত্য বিস্তার করার চেষ্টার এসব কিছু, কমিটি ভেঙে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
মূলত কেউ ঢাকা কলেজের দায়িত্ব নিতে চান না। দায়িত্বশীলদের অবহেলার কারণে কমিটি জট ও বদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, কয়েকজন ছাত্রনেতার সাথে কথা বললে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন আমার সংবাদকে জানান, ‘আমরা ছাত্রলীগের রাজনীতি করে খুব অস্বস্তিতে আছি। ওপর মহলের কেউ আমাদের জন্য আন্তরিকভাবে ভাবছেন না। দীর্ঘদিন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি না থাকায় আমাদের ইউনিটের শতশত নেতাকর্মী পরিচয় সংকটে ভুগছেন এবং ক্যাম্পাসের ছাত্রলীগের ঐতিহ্য এখন মৃতপায়। ঢাকা কলেজের ছাত্ররাজনীতির রুগ্ন অবস্থার এই দায়ভার কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা এড়াতে পারেন না।’ এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ঢাকা কলেজ একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান ও ছাত্ররাজনীতির অন্যতম চারণভূমি। এখানে মেধাবীরা পড়ে এবং এই মেধাবীরারই এক সময় জাতির হাল ধরে। এরা জাতির ক্রান্তিলগ্নে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করে। মেধাবীদের চারণ ভূমি এই বিদ্যাপিঠ। দীর্ঘদিন ছাত্রলীগের কমিটি না থাকার কারণে দেশের অন্যতম বৃহৎ এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ছাত্রলীগের রাজনীতি ধ্বংস হওয়ার পথে। এর পেছনে কারা দায়ী এটি খুঁজে বার করা হোক এবং দ্রুত এই ক্যাম্পাসটির ছাত্রলীগের অচল অবস্থা নিরসন হোক।
কমিটি প্রসঙ্গে কলেজটির ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এফ এইচ পল্লব বলেন, দীর্ঘদিন যাবত ঢাকা কলেজের মতো একটি বৃহৎ ক্যাম্পাসের ছাত্ররাজনীতির বন্ধ্যাত্ব কাম্য নয়। খুব তাড়াতাড়ি কমিটি হওয়া প্রয়োজন। এ বিষয়ে ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক নূরে আলম ভূইয়া রাজু বলেন, সাধারণত বড় সাইজের কমিটি দিলে সংগঠনের চেইন অব কমান্ড নষ্ট হয়, অতীতে এটি হয়েছে। এতে সংঘর্ষ হয় এবং কমিটি ভেঙে দিতে হয়। কেন্দ্র থেকে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের সাথে সমন্বয় করে কখনো কমিটি দেয়া হয়নি। কমিটি না থাকায় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। নানা অপশক্তি মাথাচাড়া দিচ্ছে। তুচ্ছ কারণে ক্যাম্পাসে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। ছাত্রলীগ যেহেতু বৃহৎ একটি ছাত্র সংঠন এবং সাধারণ ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করে। ছাত্রলীগের কমিটি না থাকায় তাদের পক্ষে কথা বলার সুযোগ থাকে না। বিগত সময়ের ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিগুলো দায় এড়াতে পারে না।
কমিটি সংক্রান্ত জটিলতার বিষয়ে কলেজটির ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক শিহাবুজ্জামান জানান, যারা বিগত দিনে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সাম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন, আজকের এই পরিস্থিতির জন্য তারাই দায়ী। নিজেদের ‘মাইম্যান’ খুঁজতে গিয়ে তারা মূলত সময় ক্ষেপণ করেছেন। দীর্ঘসূত্রতার শিকার হয়ে কমিটি করতে পারেননি এবং এখনো কি এক অদৃশ্য কারণে কমিটি হচ্ছে না। অথচ গুরুত্ব বিবেচনায় ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ হলো বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ডান হাত। ঢাকা কলেজের কমিটি সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্যতম নেতা আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম আমার সংবাদকে বলেন, এতদিন একটি ক্যাম্পাসে কমিটি না থাকা অস্বাভাবিক। আমি আশা করি নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি দ্রুত এই জটিলতা নিরসন করবে। তবে এটিও মনে রাখতে হবে, ব্যক্তির অনাকাঙ্ক্ষিত দায়ভার সংগঠন বহন করবে না। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের বিষয়ে তিনি বলেন, মার্কেটের সঙ্গে ছাত্রদের সম্পর্ক থাকবে কেন? তারা পড়াশোনা করবে। আদর্শিক রাজনীতির চর্চা করবে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা বিএম মোজাম্মেল হক এ বিষয়ে আমার সংবাদকে বলেন, দীর্ঘদিন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি না থাকাটা দুঃখজনক। দ্রুত এই ইউনিটের কমিটি হওয়া প্রয়োজন। আমি সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি বিষয়টি নিয়ে কথা বলব। আশাকরি কমিটি হবে। কেন্দ্রীয় কমিটিও যাতে তাড়াতাড়ি পূর্ণাঙ্গ করা হয় সে বিষয়টি নিয়েও কথা বলব। ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক শাহজাহান ভূইয়া শামীম বলেন, অবিলম্বে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি হওয়া প্রয়োজন। না হলে এখানে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে স্থায়ী শূন্যতা তৈরি হবে। এতে সাংগঠনিকভাবে সাধারণ ছাত্রদের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ কমে যাবে। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ফোন ও মেসেজ দিলেও তারা সাড়া দেননি।