Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২৪,

মহানায়কের জন্মদিনে সুন্দর আগামীর প্রত্যাশা

মোতাহার হোসেন

মোতাহার হোসেন

মার্চ ১৭, ২০২৩, ০১:৪৯ পিএম


মহানায়কের জন্মদিনে সুন্দর আগামীর প্রত্যাশা

টুঙ্গিপাড়ার রাখাল রাজা থেকে ধীরে ধীরে বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর তথা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম মানেই একটি নতুন জাতিরাষ্ট্রের জন্ম। এবং জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে, স্বাধীনতা সঙ্গে, জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের সঙ্গে তার নাম একাকার হয়ে মিশে আছে। এ তো শুধু একটি নাম নয় বাঙালির জাতীয় মুক্তির ইতিহাস। যে জন্য বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ আমাদের জাতীয় জীবনে এক ঐতিহাসিক দিবস।

দিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবে প্রতিবছর পালিত হয়ে থাকে। জাতির পিতার শুভ জন্মদিনে সমগ্র জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করে। ইতোমধ্যে জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ দেশব্যাপী ‘মুজিববর্ষ’ সগৌরবে পালিত করার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের আলোয় জাতীয় দিগন্ত উদ্ভাসিত হলো। দিন যতই অতিবাহিত হচ্ছে ততই বঙ্গবন্ধু আমাদের জন্য জাতির জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠছেন। মূলত তার দেখানো দর্শন ও পথই বাঙালির মুক্তি অর্জন ও বিশ্বে একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার আলোকবর্তিকা।

বঙ্গবন্ধু জীবনব্যাপী একটিই সাধনা করেছেন, বাঙালির মুক্তির জন্য নিজকে উৎসর্গ করা। এ জন্য জাতিকে তার অভিষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যেতে ধাপে ধাপে প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। ’৪৮ থেকে ’৫২ অন্যতম রাষ্ট্রভাষা মায়ের ভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন, ’৫০ থেকে ’৫৪ জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ, ’৫৪ থেকে ’৫৬ সাংবিধানিক স্বায়ত্তশাসন, ’৬৪-তে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িকতা, ’৬৬-তে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার তথা স্বাধিকার আন্দোলনে ৬ দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মৃত্যুকূপ থেকে মুক্তমানব হয়ে বেরিয়ে এসে সার্বজনীন ভোটাধিকারের দাবি আদায় ও সংখ্যাগুরুর অধিকার আদায় এবং ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ভূমিধস বিজয় অর্জন ও পরিশেষে ’৭১-এ স্বাধীনতার ডাক দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ঐতিহাসিক এই পর্বগুলো সংঘটনে তাকে জীবনের প্রায় ১৩টি বছর কারান্তরালে কাটাতে হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তিকামী মানুষের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার একটি উক্তি এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য।

ছাত্র থাকাকালীন তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লিগ গঠন করা হলে বঙ্গবন্ধু দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ১৯৫৩ সালে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয় এবং ১৯৬৩ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে তিনি বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফা দাবি পেশ করেন। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগকে এদেশের গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে পরিণত করেন। পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলে ষাটের দশক থেকেই তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের অগ্রনায়কে পরিণত হন। বাংলা বাঙালি আর বাংলাদেশের অধিকার মর্যাদা ও স্বীকৃতির প্রশ্নে আপসহীন শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতি ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। টুঙ্গিপাড়ার খোকা হয়ে ওঠেন বাঙালির স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার অর্জনে পথনির্দেশক উজ্জ্বল বাতিঘর। ‘৬৯-এর রক্তঝরা মহান গণঅভ্যুত্থানের পথ পেরিয়ে ‘৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামী ইতিহাসের একেকটি মাইলফলক। আর যার মূলে ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

তিনি বলেছিলেন, ‘বলা হয়ে থাকে যে, সত্যিকার অর্থে কেউ একটি জাতিকে জানতে পারে না, যতক্ষণ না কেউ একজন এর কারাগারে বন্দি থাকে।’ কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তার যে প্রেরণা, তা হলো দেশপ্রেমের প্রেরণা; বাংলাদেশ পাওয়ার যে সংগ্রাম, তা হলো আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হওয়ার চেতনা; সর্বোপরি সঠিক সময়ে যথাযথ নির্দেশনায় সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা। অন্যদিকে, ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থটি পড়ে জেনেছি কারারুদ্ধ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর সম্বল ছিল একটি থালা, বাটি, গ্লাস আর কম্বল। প্রকৃতপক্ষে ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থটির শিরোনাম তিনি দিয়েছিলেন ‘জেলখানার সম্বল থালা বাটি কম্বল।’ এখানে গিয়েই বারবার আমাদের কেন্দ্রীয় কারাগার এবং পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগারের কথা ভেবেছি- যে কারাগারে বঙ্গবন্ধু দীর্ঘকাল বন্দিজীবন অতিবাহিত করেছেন।

আরও বলেছিলেন, ‘আমার দলের নেতাকর্মীরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে, তবে আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছাবই।’ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই বঙ্গবন্ধু লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। বারবার ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছেন। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেয়ার সব ষড়যন্ত্র আইয়ুব খান গ্রহণ করেছিল। আজন্মই বাঙালির ভালোবাসার কাঙাল মানুষটি বলেছিলেন, সাত কোটি বাঙালির ভালোবাসার কাঙাল আমি। আমি সব হারাতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারব না। বাঙালির ভালোবাসার ঋণ বুকের রক্ত দিয়ে শোধ করব ইনশাআল্লাহ।’

বাংলার মাটি ও মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামের সংশপ্তক এই মানুষটি নিজের জীবন দিয়েই তার কথা ঋণ শোধ করেছেন। এতগুলো বছর ধরে আমরা আমাদের পিতা হারানোর শোক বয়ে বেড়াচ্ছি। শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছি আমরা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পিতা হারানোর শোকের শক্তি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পিতার আদর্শের পথ ধরে আজ বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম সম্ভাবনাময় একটি দেশে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সরকারি নাম ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ মামলা। স্বৈরশাসক তাকে প্রধান আসামি করে ফাঁসিতে দাঁড় করিয়েছিল। কিন্তু মাথানত করেননি।

এ দেশের সংগ্রামী ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতির পিতার মুক্তির জন্য আন্দোলন করেছিল। সেই গণআন্দোলন প্রবল গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়। ফাঁসির মঞ্চ থেকে মুক্ত করে এবং কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি কৃতজ্ঞ চিত্তে রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) গণসংবর্ধনায় জাতির পিতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই বাঙালির বন্ধু তথা ‘বঙ্গবন্ধু’। বঙ্গবন্ধুকে তুলনা করা যায় ভারতের মহাত্মা গান্ধী, আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, ভিয়েতনামের হো চি মিন, তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটোর সঙ্গে। পৃথিবীতে অনেক দেশ স্বাধীন হয়েছে আলোচনার টেবিলে বসে। আর বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করেছেন রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। তার জীবনকে বাঙালি জাতির জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন।

নেলসন ম্যান্ডেলা যেমন বলেছিলেন, ‘যে মরতে চায়, তাকে কেউ মারতে পারে না।’ বঙ্গবন্ু্লও বলেছিলেন, ‘যে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত, তার মৃত্যু নাই।’ ‘বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা ছিল বঙ্গবন্ধুর হূদয়ের লালিত স্বপ্ন। ’৬৯-এর ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীতে স্বকণ্ঠে স্লোগান দেন, ‘আমার দেশ তোমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ।’ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় যা কিছু সংঘটিত হয়েছে সবকিছু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে হয়েছে। নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৫২ সালে বলেছিলেন, ‘একদিন আমি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হবো।’ আর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘একদিন আমি এই দেশকে স্বাধীন করব। কিন্তু প্রধানমন্ত্রিত্ব আমার কাছে তুচ্ছ।’ সেই লক্ষ্যে উপনীত হতে ধাপে ধাপে তার আরাধ্য কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

’৭১-এর ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে ’৭০-এর নির্বাচনে নবনির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। শপথগ্রহণ করাবেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। সেদিন বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘৬ দফা ও ১১ দফা আজ আমার নয়, আমার দলেরও নয়। এ আজ বাংলার জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। কেউ যদি এর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে বাংলার মানুষ তাকে জ্যান্ত সমাধিস্থ করবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও।’

’৭১-এর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের কথা; যে ভাষণ আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে আসীন। সেদিন তিনি একটি ভাষণের মধ্য দিয়ে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করেছেন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে জাতীয় মুক্তির মোহনায় দাঁড় করিয়েছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই ৭ মার্চের ভাষণই ছিল আমাদের প্রেরণার উৎস। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণার প্রারম্ভে বলেছিলেন, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ তার এই শেষ বার্তা স্বাধীনতার ঘোষণা হূদয়ে ধারণ করে হাতিয়ার তুলে নিয়ে ৯ মাস যুদ্ধ করে ১৬ ডিসেম্বর দেশকে হানাদারমুক্ত করেও আমরা স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করতে পারিনি। ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি যেদিন তিনি স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন, সেদিন মনে হয়েছে আজ আমরা প্রকৃতই স্বাধীন।

দুটি মহান লক্ষ্য সামনে নিয়ে জাতির পিতা রাজনীতি করেছেন। এর একটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, অপরটি অর্থনৈতিক মুক্তি। প্রথম লক্ষ্য পূরণ করে যখন দ্বিতীয় লক্ষ্য পূরণের দ্বারপ্রান্তে ঠিক তখনই ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা তাকে সপরিবারে হত্যা করে। জাতির পিতার দুই কন্যা তখন বিদেশে অবস্থান করায় রক্ষা পান। জাতির পিতার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক পিতার রক্তে ভেজা সংগ্রামী পতাকা হাতে নিয়ে নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় অভিষিক্ত করে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ দ্রুততার সঙ্গে সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে একের পর এক লক্ষ্যপূরণ করে চলেছে। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ হবে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা। তিনি বাঙালি জাতির সত্যিকারের মুক্তি চেয়েছিলেন। একটি অসামপ্রদায়িক জাতি হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন আমাদের। আমরা তার দেখানো পথেই হাঁটব। তৈরি করব সোনার বাংলাদেশ। মহানায়কের জন্মদিনে এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক : সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম
 

Link copied!