Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী পাইপলাইন উদ্বোধন আসছে ডিজেল

১৬ জেলার জ্বালানি চাহিদা পূরণ

মো. মাসুম বিল্লাহ

মার্চ ১৯, ২০২৩, ০১:০৯ এএম


১৬ জেলার জ্বালানি চাহিদা পূরণ
  • দুই দেশের জন্য মাইলফলক অর্জন —বললেন শেখ হাসিনা
  •  শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করলেন নরেন্দ্র মোদি
  •  প্রতি ব্যারেলে ছয় ডলার প্রিমিয়াম সাশ্রয় হবে

 ১৩২ কিলোমিটার ‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী’ পাইপলাইনে ভারতের শিলিগুড়ি থেকে বাংলাদেশের পার্বতীপুরে আসবে ডিজেল। এতে দেশে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার চাহিদা পূরণ হবে। এ জন্য আমদানি খরচও আগের চেয়ে কমবে। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী এ পাইপলাইন গতকাল ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারত থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বোতাম টিপে ভারত-বাংলাদেশ এই মৈত্রী পাইপলাইন উদ্বোধন করেন। ঐতিহাসিক এ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এ পাইপলাইন দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে সহায়ক হবে। ডিজেল আমদানিতে সময় ও ব্যয় কমবে। এই অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নকে আরও গতিশীল করবে এ পাইপলাইন। এর আগে ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এর নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন। ২০২০ সালের মার্চে যা শুরু হয়। ভারতের লুমানিগড় রিফাইনারি লিমিটেড (এনআরএল) এবং বাংলাদেশের মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।

গতকাল বিকেলে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে যৌথভাবে এ পাইপলাইনের উদ্বোধন শেষে শেখ হাসিনা বলেন, ভারত থেকে জ্বালানি আনতে ‘ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন’কে দুই দেশের জন্য একটি মাইলফলক অর্জন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন আমাদের দুই বন্ধুপ্রতীম দেশের মধ্যে সহযোগিতা উন্নয়নের একটি মাইলফলক অর্জন। এটি বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তার পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করবে। আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ভারত-বাংলাদেশ পাইপলাইনের মতো আগামী দিনেও দুই দেশ আরও সফলতা উদযাপন করবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আমরা একই সঙ্গে কাজ করব। এই পাইপলাইনের সুফলের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন চালুর ফলে দুই দেশের জনগণ বিভিন্নভাবে উপকৃত হবে। 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে যখন বিশ্বের অনেক দেশ জ্বালানি সংকটের মুখোমুখি, এই পাইপলাইনটি আমাদের জনগণের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন, এই পাইপলাইনে ভারত থেকে ডিজেল আমদানিতে ব্যয় ও সময় উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে। উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় ডিজেলের স্থিতিশীল সরবরাহ নিশ্চিত করবে। শেখ হাসিনা বলেন, ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং আমি, আমরা ভার্চুয়ালি এই প্রকল্পের কাজ শুরু করি। ১৩১ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের অংশে পড়েছে ১২৬ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার, ভারতের অংশে পাঁচ কিলোমিটার। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ভারত আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু, ভাতৃপ্রতীম প্রতিবেশী রাষ্ট্র। আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অবাধ প্রবাহ। ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক সেতুবন্ধন দুই দেশের সম্পর্ককে আরও ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর করেছে। ক্রমাগত ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার সহযোগিতা আরও গভীর হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিগত বছরগুলোতে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক সম্ভাবনাকে আমরা বাস্তবে রূপ দিয়েছি। আমাদের দুই দেশের মধ্যে সমস্যাগুলো একে একে আমরা সমাধান করেছি। যোগাযোগ স্থাপন করেছি, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার আমরা ঘটিয়েছি।

শেখ হাসিনা বলেন, আমরা উন্নয়নে একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি এবং ভারতের কাছ থেকে বিভিন্ন সহযোগিতা পাচ্ছি। সেই সঙ্গে  সাংস্কৃতিক সহযোগিতা ও উভয় দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুই দেশের জনগণের কল্যাণে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে পারস্পরিক সহযোগিতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের দুই দেশের বন্ধুত্ব অটুট থাকুক সেটিই আমরা চাই। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে সেটিকে আমরা কার্যকর করতে চাই। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ঠিক রেখে দুই দেশের জনগণের সার্বিক উন্নয়নে আমরা কাজ করে যেতে চাই। আমরা চাই আমাদের উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হোক। ভারতীয় ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা বাংলাদেশে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছি। আমি চাই ভারতের বিনিয়োগকারীরাও এখানে বিনিয়োগ করুক। আমরা দুই দেশই তাতে লাভবান হবো। ভারত থেকে বাংলাদেশের এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে উপ-আঞ্চলিক পর্যায়সহ দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার আরও কয়েকটি উদ্যোগ বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে সহযোগিতা করার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা কৃতজ্ঞ, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সরকার এবং জনগণ অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিল। শুধু তাই না, এক কোটি বাঙালি শরণার্থীকে স্থান দেয়া, খাবারের ব্যবস্থা, চিকিৎসার ব্যবস্থা, আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেয়া এবং অস্ত্র দেয়া এসব সহযোগিতা ভারতের কাছ থেকে আমরা পেয়েছি। ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী বাহিনীর অভিযানে আমরা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করি। ১৯৭৫ সালের পর ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে ভারতের সরকার ও জনগণের কাছে ঋণী। আমরা দুই বোন তখন ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমাদের আরও আত্মীয়-স্বজন যারা বেঁচে গিয়েছিল তারাও ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। কাজেই আমি ভারতের কাছে, ভারতের জনগণের কাছে, সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ। যৌথ এ পাইপলাইন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ভারত প্রান্ত থেকে ভিডিও কনফারেন্সে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যে মোদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন। নরেন্দ্র মোদি বলেন, বিগত বছরগুলোতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। বাংলাদেশের এই উন্নতিতে পাশে থাকতে পেরে আমরা খুশি। এই পাইপলাইন (ডিজেলের) বাংলাদেশের উন্নতিতে আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি। দুই দেশের মধ্যে কানেকটিভিটি যত বাড়বে তত দুই দেশের লোকজনের মধ্যে সম্পর্ক জোরালো হবে বলেও উল্লেখ করেন মোদি।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রথম আন্তঃসীমান্ত জ্বালানি তেলের পাইপলাইন নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় ৩৭৭ কোটি রুপি। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশে ব্যয় প্রায় ২৮৫ কোটি রুপি। ভারত সরকার এ অর্থ বহন করেছে। ভারতের অভ্যন্তরে পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত পাইপলাইনটি বিস্তৃত। সেখানে খরচ হয়েছে বাকি অর্থ। বার্ষিক এক মিলিয়ন টন হাইস্পিড ডিজেল (এইচএসডি) পরিবহনের সক্ষমতা রয়েছে এ পাইপলাইনের। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সাত জেলায় প্রাথমিকভাবে উচ্চগতির ডিজেল সরবরাহ করবে এ পাইপলাইন। এ পাইপলাইনে ভারত থেকে বাংলাদেশে হাইস্পিড ডিজেল পরিবহন টেকসই, নির্ভরযোগ্য, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব করবে। এতে দুই দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় সহযোগিতা আরো বাড়বে। পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি থেকে দিনাজপুরের পার্বতীপুরের মেঘনা পেট্রোলিয়াম ডিপো পর্যন্ত বিস্তৃত পাইপলাইনে ডিজেল আসবে। ২০১৭ সালে এ চুক্তি সই হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত থেকে ডিজেল আমদানির জন্য তৈরি করা ‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী পাইপলাইন’ দিয়ে আমদানি করা ডিজেল দিয়ে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার চাহিদা পূরণ করবে এবং এ জন্য খরচও আগের চেয়ে কমবে। তবে যে চুক্তির আওতায় এই পাইপলাইন তৈরি ও ডিজেল আমদানি করা হবে তাতে (ওই চুক্তিতে) ঠিক কি আছে তা বিস্তারিত প্রকাশ না করায় এ পাইপলাইন বাংলাদেশকে জ্বালানির ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় ভারত নির্ভর করে তোলে কি-না তা নিয়েও উদ্বেগও আছে।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বা বিপিসি অবশ্য বলছে, এতদিন যে পদ্ধতিতে ভারত থেকে ডিজেল আনা হচ্ছিল সেটি আদর্শ ছিল না; বরং এখন নতুন পাইপলাইন হয়ে যাওয়ায় ‘তুলনামূলক কম খরচে’ এবং ‘রিয়েল টাইমে’ জ্বালানি পাওয়া যাবে। তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এজাজ হোসেন বলছেন, এখানে শুধু তেল আনাটা সহজ হচ্ছে আর কোনো কিছুই বাংলাদেশ পাচ্ছে না। একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন তিনি, ‘এই পাইপলাইনে আনা জ্বালানি তো কম বা সাশ্রয়ী দামে পাবে না। আবার এখানে কোনো গ্যারান্টেড সাপ্লাইয়ের বিষয়ও নেই। যে পরিমাণ তেল আসবে তা খুব বড় কিছু নয়।’ বপিসি চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ অবশ্য বলেছেন, নতুন পাইপলাইনের মাধ্যমে কম খরচে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ করতে সক্ষম হবেন তারা। যদিও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনের উপদেষ্টা শামসুল আলম বলছেন, কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে ভারতের আদানি গোষ্ঠীর সাথে যে অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের হয়েছে তাতে এই পাইপলাইন নিয়ে ভারতের সঙ্গে চুক্তির বিস্তারিত প্রকাশ না করলে বলা কঠিন যে এতে বাংলাদেশের লাভ হবেই। তনি বলেন, ‘ভারতের দুটি প্রতিষ্ঠান এই সীমান্ত পাইপলাইন দিয়ে ডিজেল পাঠাবে। তারাও যদিও আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে যখন তখন দাম বাড়িয়ে বাংলাদেশকে বিপাকে ফেলে তার থেকে সুরক্ষাকবচ কি? তা নিয়ে সংসদ বা মন্ত্রিসভা কোথাও কথা হয়েছে?’ প্রশ্ন এই বিশেষজ্ঞের।

বিপিসি চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে বলছেন এখন রেল ওয়াগনে করে তেল আনতে পরিবহন খরচ অনেক বেশি পড়ে যাচ্ছে। তার দাবি পাইপলাইনে এলে এ খরচ অনেক কমবে। রেল ওয়াগনে অপচয় যেমন হয় তেমনি প্রায়ই নানা দুর্ঘটনায় ক্ষতি হচ্ছে। তাই আমরা মনে করি পাইপলাইনে আনাটাই ‘বেস্ট স্মার্ট’ উপায়, বলছেন বিপিসির চেয়ারম্যান। অন্যদিকে গত ১০ মার্চ দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলায় ডিজেল রিসিভ টার্মিনাল পরিদর্শন শেষে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের বলেন যে বর্তমানে প্রতিটি ব্যারেল জ্বালানি পরিবহনে খরচ হয় প্রায় ১১ দশমিক ৫ মার্কিন ডলার। কিন্তু পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে জ্বালানি আমদানি শুরু হলে এই খরচ ছয় ডলার পর্যন্ত কমে যাবে বলে জানান তিনি। কর্তৃপক্ষের দাবি বছরে ১০ লাখ টন পর্যন্ত জ্বালানি ভবিষ্যতে এ পাইপলাইনে আনা সম্ভব হবে এবং তাতে করে সার্বিক জ্বালানি পরিবহন খরচ কমবে বলে মনে করেন তারা। কারণ এখন তেল চট্টগ্রামে এনে সেখান থেকে খুলনা হয়ে পার্বতীপুরে নিতে হয়। তবে পাইপলাইন আনার ফলে সত্যিকারভাবে কেমন অর্থ বাংলাদেশের সাশ্রয় হবে সেটি জানতে আসলে আমদানির পর নির্দিষ্ট সময় শেষেই বলা সম্ভব হবে।

তথ্যসূত্র বলছে, মূলত ভারতের নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড (এনআরএল) থেকে ডিজেল আনার পরিমাণ বাড়াতে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী পাইপলাইন নামের এই পাইপলাইনটি নির্মাণ করা হয়েছে। এনআরএল এবং পার্বতীপুর ডিপোর মধ্যে দূরত্ব প্রায় ১৩১ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে পাঁচ কিলোমিটার ভারতে এবং বাকি ১২৬ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার বাংলাদেশে পড়েছে। তবে নুমালিগড় থেকে শিলিগুড়ি রেল টার্মিনাল পর্যন্ত ৬০ কিলোমিটার পাইপলাইন আগে থেকেই ছিল। এ কারণে ভারত প্রান্তে নতুন করে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ করতে হয়েছে। পাইপলাইনে আনা জ্বালানি পার্বতীপুরের টার্মিনালেই রাখা হবে এবং পরে সেখান থেকে বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ হবে। সে জন্য এই টার্মিনালে ১৯ হাজার টন ধারণ ক্ষমতার ডিপো নির্মাণ করা হয়েছে। পাইপলাইনটির মাধ্যমে বছরে ১০ লাখ টন জ্বালানি আমদানি করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী।

 তবে এও জানিয়েছেন, এখন সরকার বছরে আড়াই লাখ টন জ্বালানি নতুন এই পাইপলাইন ব্যবহার করে ভারত থেকে আনতে চায়। ভারতের আসাম রাজ্যের নুমালিগড় রিফাইনারির শিলিগুড়ি মার্কেটিং টার্মিনাল থেকে সীমান্তের বর্ডার অতিক্রম করে বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার বাংলাবান্ধা সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে পঞ্চগড়, নীলফামারী, দিনাজপুর হয়ে পার্বতীপুর ডিপোতে সংযুক্ত হয়েছে পাইপটি। শিলিগুড়ির নুমালিগড় রিফাইনারি থেকে ইন্দো-বাংলা ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইনের মাধ্যমে ডিজেল আমদানির জন্য বিপিসির পার্বতীপুরের রিসিভ টার্মিনালটি এখন প্রস্তুত। এর আগে ১০ মার্চ শুক্রবার প্রকল্পের রিসিভ টার্মিনাল পরিদর্শন করেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. খায়ইরুজ্জামান মজুমদার, পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান জরেন্দ্র নাথ ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ। উত্তরের ১৬ জেলায় নিরবচ্ছিন্নভাবে ডিজেল সরবরাহ ও নীলফামারীর সৈয়দপুরের ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ এ অঞ্চলের অন্যান্য ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে ভারত থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল (ডিজেল) আমদানির রিসিভ টার্মিনাল স্থাপন করা হয়েছে।

বিপিসির সূত্র জনায়, চুক্তি অনুযায়ী ভারত ১৫ বছর ডিজেল সরবরাহ করবে। প্রথম তিন বছর দুই লাখ টন, পরবর্তী তিন বছর তিন লাখ টন ও এরপর চার বছর পাঁচ লাখ টন, অবশিষ্ট পাঁচ বছরে ১০ লাখ টন তেল সরবরাহ করবে। এরপর চুক্তি নবায়ন নবায়ন করা হবে। না হলে পাইপলাইনের মালিকানা বাংলাদেশের কাছে থাকবে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তেল আনতে প্রতি ব্যারেলের প্রিমিয়াম প্রাইস পড়ে ১১ ডলার। এ পাইপলাইনের মাধ্যমে খরচ পড়বে ৫ দশমিক ৫০ ডলার। অর্থাৎ প্রায় ছয় ডলারের মতো প্রিমিয়াম সাশ্রয় হবে। বর্তমান ব্যবস্থায় মধ্যপ্রাচ্য থেকে বড়বড় জাহাজে তেল চট্টগ্রাম বহিনোঙরে আসে। সেখান থেকে ছোট ছোট জাহাজে খুলনার দৌলতপুরে আসে। তারপর ব্রডগেজ রেলওয়াগনে আনা হয় পার্বতীপুর ডিপোতে। এখন সরাসরি আন্তঃসীমান্ত পাইপলাইন দিয়ে এসব ঝামেলা ছাড়াই তেল আসবে। 

বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ জানান, ভারত সরকার এই পাইপলাইনের অবকাঠামো নির্মাণ করে দিয়েছে। আমরা পাইপলাইনের জন্য ভূমি বরাদ্দ ও রিসিভ ট্যাংক নির্মাণ করেছি। পার্বতীপুর শহরের অদূরে রেল হেড ডিপোর পাশে ৬ দশমিক ৮০ একর জমিতে রিসিভ টার্মিনালটি (আরটি) নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মাণকাজ করেছে মেসার্স দীপন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড এবং ওয়েল ডিপোর কাজ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স পাইপ লাইনার্স লিমিটেড। ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকাধীন সংস্থা নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড এবং বাংলাদেশের মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড যৌথভাবে কাজটি বাস্তবায়ন করেছে। প্রকল্প সূত্র জানায়, এ প্রকল্পের নির্মাণকাজ প্রায় ৯৫ ভাগ শেষ হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্ধারিত সময়কাল ছিল ২০২০ থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করা সম্ভব না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। 

Link copied!