মার্চ ২০, ২০২৩, ১১:৩৪ এএম
- আট মাসে একবার সমন্বয় করেই ক্ষান্ত সরকার
- ৫০ শতাংশ বেশি দাম বাড়ানো হয় দেশে
- দাম না কমায় জনমনে হাপিত্যেশ
বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলেও দেশে কমে না এটি অন্যায্য —ম তামিম, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে আমরা এখনও ঘাটতিতে আছি —হাবিবুর রহমান, সচিব, বিদ্যুৎ বিভাগ
জ্বালানি তেলের দাম কমানোর পরিস্থিতি হয়নি —এবিএম আজাদ, চেয়ারম্যান, বিপিসি
বিশ্ববাজারে কমলেও দেশে এখনো চড়া জ্বালানি তেলের দাম। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দরপতন অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি জ্বালানির দাম ব্যাপক কমেছে। গত ১৫ মাসের মধ্যে যা সবচেয়ে সস্তা। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বরাত দিয়ে সিএনবিসির এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। জ্বালানি বিভাগ বলছে, আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষণ করে দাম কমানো যায় কি-না, বিপিসির কাছে সে প্রস্তাব চেয়েছে মন্ত্রণালয়। গেল এক মাসে প্রতি ব্যারেলে দাম কমেছে ২২ শতাংশ। এ ধারা আরো কিছু দিন অব্যাহত থাকার পূর্বাভাসও দেন আন্তর্জাতিক বাজার সংশ্লিষ্টরা। তবে এখনি দেশে দাম না কমালে অর্থনীতি ও জনজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
করোনার চাপে পড়ে বৈশ্বিক অর্থনীতি। সংকট মোকাবিলায় সারা বিশ্বে বেড়েছে জ্বালানির চাহিদা। সেই সাথে বাড়ে দামও। এরপর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কবলে পড়ে দাম বাড়ে আরেক দফা। জিজেলে দাম ছাড়ায় বেরেল প্রতি ১২৭ ডলার। বিশ্ব বাজারের সাথে সমন্বয়ের নামে গত এক বছরে দুবার দেশেও তেলের দাম বাড়ানো হয়। ধারাবাহিকভাবে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমছে কিন্তু দেশের বাজারে দাম কমানোর কোনো খবর নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লেই দেশে বাড়ানো হয়। অথচ দাম কমলে দেশের বাজারে সমন্বয় করছে না সরকার। বিশ্বেবাজারে এখন জ্বালানি তেলের দাম অনেকাংশে কমেছে, কিন্তু দেশে এখনো দাম সমন্বয় না করা অন্যায্য। বিশেষজ্ঞরা মূল্য সমন্বয়ের বিষয়ে বলেন, যেই যুক্তিতে সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছিল, সেই যুক্তি এখন আর নেই। এরপরও দাম কমানো হচ্ছে না। আমরা কিছু বুঝতে পারছি না। যদি সরকার মনে করে, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল আগের সেই দামে ফিরে গেলে দেশে দাম কমাবে, তাহলে এটি অন্যায় হবে।
সম্প্রতি সিএনবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। তাতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। ফলে তেলের মূল্য হ্রাস পেয়েছে। আন্তর্জাতিক বেঞ্চমার্ক অপরিশোধিত ব্রেন্টের দাম কমেছে এক ডলার ৫৯ সেন্ট বা ২ দশমিক ১ শতাংশ। প্রতি ব্যারেলের দর স্থির হয়েছে ৭৩ ডলার ১১ সেন্টে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের বেঞ্চমার্ক অপরিশোধিত ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের (ডব্লিউটিআই) মূল্য নিম্নমুখী হয়েছে এক ডলার ৪৩ সেন্ট বা ১ দশমিক ১ শতাংশ। ব্যারেলপ্রতি দাম নিষ্পত্তি হয়েছে ৬৬ ডলার ৯২ সেন্টে। এ নিয়ে টানা চারদিন উভয় বেঞ্চমার্কের দর পড়ল। ২০২১ সালের ডিসেম্বরের পর তেলের দাম এত কমেনি।
নিউইয়র্কের এগেইন ক্যাপিটালের অংশীদার জন কিল্ডাফ বলেন, তেলের দাম কমছেই। এতে স্পষ্ট স্বর্ণ ও ডলারের মতো নিরাপদ আশ্রয় নয় জ্বালানি পণ্যটি। বর্তমানে, দিল্লিতে পেট্রল বিক্রি হচ্ছে ৯৬.৭২ টাকা প্রতি লিটার এবং ডিজেল বিক্রি হচ্ছে ৮৯.৬২ টাকা লিটারে। যেখানে মুম্বইতে পেট্রল ১০৬.৩১ টাকা এবং ডিজেল প্রতি লিটার ৯৪.২৭ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। কলকাতায় পেট্রল ১০৬.০৩ টাকা এবং ডিজেল প্রতি লিটার ৯২.৭৬ টাকা। অন্যদিকে, চেন্নাইতে পেট্রোল বিক্রি হচ্ছে ১০২.৬৩ টাকা এবং ডিজেল প্রতি লিটার ৯৪.২৪ টাকায়।
ইউক্রেন-রাশিয়া সঙ্ঘাতের ফলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে। দুদেশের সংকট শুরু হওয়ার ছয় মাসের মাথায় দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য এক লাফে ৫০ শতাংশ বাড়ানো হয়। সরকারের তরফ থেকে তখন বলা হয়েছে, বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে দেশে দাম সমন্বয় করা হয়েছে। বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশে আবার সমন্বয় করা হবে। কিন্তু সেই সমন্বয় আর দেখল না দেশবাসী। এদিকে বিশ্ববাজরে টানা ১৫ মাস ধরে জ্বালানির মূল্য নিম্নমুখী। এবার সর্বনিম্ন রেকর্ড গড়লেও দেশে জ্বালানির দাম সমন্বয় করার মুরোদ নেই সরকারে। মাত্রাতিরিক্ত হারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম। বেড়েছে উৎপাদন ও পরিবহন খরচ। জনদুর্ভোগ বেড়েছে চরম পর্যায়ে। সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাহত হচ্ছে নাগরিক জীবন। পরে গত আগস্ট মাসের শেষের দিকে সব ধরনের জ্বালানির মূল্য পাঁচ টাকা কমেছে।
নামমাত্র মূল্যহ্রাসে কোনো প্রভাব পড়েনি জনজীবনে। বিশ্ববাজারের দামের সাথে একবার সমন্বয় করেই ক্ষান্ত সরকার। এর আগে জ্বালানির দাম বাড়ানোর সময় জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, ‘বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমানো হলে আমরা আবার দাম সমন্বয় করব। এদিকে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম টানা তিন মাস ধারাবাহিক কমলেও দেশে দাম না কমাতে সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, বিশ্ববাজারে দাম কমছে, দেশে কমবে কবে? বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির দোহাই দিয়ে আগস্ট মাসে এক লাফে গড়ে প্রায় ৪৭ শতাংশ দাম বাড়ে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম। একই অজুহাতে গত বছর নভেম্বর মাসে জ্বালানি তেলের দাম ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি করে সরকার। সব মিলিয়ে ১০ মাসে দাম বাড়ানো হয় প্রায় ৭০ শতাংশ। আর ওই সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে গড় মূল্য বৃদ্ধি পায় ২০ শতাংশ। অর্থাৎ বিশ্ববাজারের তুলনায় দেশের বাজারে দাম ৫০ শতাংশ বেশি বাড়ানো হয়।
এদিকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমতির দিকে থাকলেও দেশে দাম কমানোর পরিস্থিতি হয়নি বলে মনে করছেন বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ। বিশ্ববাজারের সাথে মিলিয়ে দেশে দাম সমন্বয়ের কোনো চিন্তা আছে কি-না, সম্প্রতি সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ বলেন, জ্বালানি তেলের দাম কমানোর পরিস্থিতি হয়নি। ডিজেলে এখনো লোকসান করছে বিপিসি। গত মাসেও সব মিলে ৪৩ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।’
বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হাবিবুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কমছে তা ঠিক। দেশে ধারাবাহিকভাবে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি হলেও আমরা ঘটতিতে আছি এখনো। বিদ্যুতের দামের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আমার সংবাদকে বলেন, দেশে জ্বালানির দাম কমলে বিদ্যুতের দামও কমবে।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জ্বালানি তেলের সমন্বয়হীনতার বিষয়ে বলেন, ‘মূলত দুটি কারণে বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারের সাথে প্রতিনিয়ত সমন্বয় করা হয় না। প্রথমত, অভ্যন্তরীণ মার্কেটে মূল্য সরকার নিয়ন্ত্রিত দাম। এমনকি এলএনজি ছাড়া অন্য কিছুতে বেসরকারি খাত নেই বলে কোনো প্রতিযোগিতাও নেই। তেল আনাই হয় সরকারি প্রতিষ্ঠান বিপিসির মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত, সরকার সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে তেল ক্রয় করে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে। সরকার গণমানুষ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কথা চিন্তা করে আন্তর্জাতিক বাজারের ওঠানামা থেকে ভোক্তাদের বাইরে রাখতে চায়। কিন্তু মাঝে মধ্যে এটি ভোক্তার জন্য সমস্যাও হয়ে দাঁড়ায়। ফলে বিপিসি এফডিআর অক্ষত রেখে তেলের দাম বাড়িয়ে সমন্বয় করেছে আর ভোক্তাকে এখন নিজের এফডিআর ভেঙে সে তেল কিনতে হচ্ছে। এ জন্য ভোক্তাকে সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি তেল দিতে মাঝে মধ্যে যৌক্তিক সমন্বয়টাও দরকার।’
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম আমার সংবাদকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে দেশে কমে না এটি অন্যায্য। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলে দেশেও দেশের বাজারে কমা উচিত। যখন বিশ্ববাজারে দাম কমেছে কিন্তু দেশে কমানো হয়নি, সে ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মুনাফা হচ্ছে। এ বিষয়ক একটি তহবিল গঠন করে এই মুনাফা সেখানে রেখে দিতে হবে।’