মার্চ ২২, ২০২৩, ০২:৪৩ এএম
মার্কিন সরকারের সঙ্গে আমাদের বহুমাত্রিক সম্পর্ক। সামরিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রচুক্তি, রেমিট্যান্সসহ অনেক কিছু যুক্ত। তাই পর্যবেক্ষণ নেগেটিভ না নিয়ে ঘাটতিগুলো পূরণ করতে হবে
—মে. জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার
নিরাপত্তা বিশ্লেষক
বািবতণ্ডায় জড়ানো যাবে না, সমাধানের দিকে যাওয়াই দেশের জন্য ভালো হবে। প্রতিটি পয়েন্টের একটি অগ্রগতি দাঁড় করাতে হবে
—এম হুমায়ুন কবীর
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিক
এখানে জিও পলিটিক্স রয়েছে। চীন, রাশিয়া ও আমেরিকা যদি আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো নিয়ে স্নায়ুযুদ্ধে জড়ায়, তাহলে ভয়ের বিষয় আছে
—ড. ইমতিয়াজ আহমেদ
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি ২০১৮ সালের ভোট। বিরোধী দলের প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দিয়ে ভোটারদের ভয় দেখিয়ে হুমকি দিয়ে সিল মেরে ব্যালটবাক্স ভর্তি করা হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, নির্যাতন, কারাবন্দিদের সঙ্গে খারাপ আচরণ, বিচারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ, মানবাধিকারকর্মী-নাগরিক সমাজ ও সরকারসমালোচকদের প্রতি হুমকি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকা, দুর্নীতি, সরকারি কাজকর্মে অস্বচ্ছতা ও দেশের অধিকাংশ ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত বলে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে গত সোমবার এ প্রতিবেদন প্রকাশ করার পর দেশের কূটনীতিকরাও নড়েচড়ে বসেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের এমন পর্যবেক্ষণকে সহজভাবে নিচ্ছেন না তারা।
তারা বলছেন, মার্কিন সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের বহুমাত্রিক সম্পর্ক রয়েছে। সামরিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রচুক্তি, রেমিট্যান্স ও দেশের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের গভীর সম্পর্ক দীর্ঘ সময় ধরে। তাই সুপার পাওয়ার দেশটির দেয়া পর্যবেক্ষণ অবশ্যই আমলে নিতে হবে। তাদের দেয়া দৃষ্টিভঙ্গিগুলো ও দেখানো ঘাটতিগুলো পূরণ করতে হবে। বিষয়টি নেগেটিভ না নিয়ে রাজনৈতিক বিতণ্ডায় না জড়িয়ে দেশের স্বার্থে ঠাণ্ডা মাথায় মোকাবিলা করার জন্য পরামর্শ কূটনীতিকদের। বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে আত্মসমালোচনায় না আনলে দেশের কিছু ক্ষতির সম্ভাবনাও দেখছেন তারা।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের পর্যবেক্ষণ বিষয়ে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.) আমার সংবাদকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এটি তাদের নিজস্ব প্রতিবেদন। এখানে বৈশ্বিক পলিসির প্রতিফলন হয়েছে। সুতরাং তারা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে। এর প্রভাব এখানে কতটুকু পড়বে সেটি দেখার বিষয় রয়েছে। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় যুক্ত সরকারসহ কাউকে এ বিষয়টি নেগেটিভ হিসেবে নেয়া যাবে না। কারণ, আমাদের মনে রাখতে হবে, আমেরিকা সুপার পাওয়ার দেশ। তাদের সঙ্গে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। এমন কোনো ঘটনা বা ইস্যুতে পালটা প্রতিক্রিয়া দেখালে বৈদেশিক মুদ্রায় নেতিবাচক প্রভাব পড়া আশঙ্কা তৈরি হয়। আমাদের আরো মনে রাখতে হবে আমেরিকার সঙ্গে আমাদের নিরাপত্তা, সামরিক চুক্তি ও নানা সম্পর্ক রয়েছে। জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমনে গোয়েন্দা তৎপরতার অংশ হিসেবে তথ্য আদান-প্রদানে একটি গভীর যোগসূত্র রয়েছে। তাই তাদের দেয়া পর্যবেক্ষণ যদি নেগেটিভভাবে নিয়ে বসে থাকি তাহলে কিছু ক্ষতির দিক থেকেই থাকে বলে মন্তব্য এই নিরাপত্তা বিশ্লেষকের।
তিনি আরো বলেন, এটিকে নেগেটিভ না নিয়ে ঘাটতিগুলো ইমপ্রুভ (অগ্রগতি) করতে হবে। যে পর্যবেক্ষণ তারা দিয়েছে সেগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে আত্মসমালোচনা করে ঘাটতিগুলো পূরণ করতে হবে। এখানে দেশের অনেক সতর্কতার বিষয় রয়েছে। এ বিষয়গুলো যদি নেগেটিভ নেয়া হয়, তাহলে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিতে পারে।’ সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক এম হুমায়ুন কবীর আমার সংবাদকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সম্পর্কে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এটিকে নেগেটিভ না নিয়ে পজিটিভ হিসেবে দেখে যে ঘাটতিগুলো রয়েছে সেগুলোতে উন্নতি করতে হবে। আমি বাংলাদেশ সরকারকে বলব, এ প্রতিবেদনকে যাতে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। অবশ্যই সচেতনতা অবলম্বন করে সমাধান খুঁজতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে বাগবিতণ্ডায় জড়ানো যাবে না। সমাধানের দিকে যাওয়াটাই দেশের জন্য ভালো হবে।
প্রতিটি পয়েন্টের একটি অগ্রগতি দাঁড় করাতে হবে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এটি নতুন কিছু নয়। আমাদের ঘাটতিগুলো বাইরের শক্তি থেকে এসেছে। আসলে সেখানে কতটা যৌক্তিকতা বিষয় সেটি দেখতে হবে। তাই জাতীয় স্বার্থরক্ষার জন্য সরকারকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়গুলো দেখতে হবে। কারণ, আমেরিকার সঙ্গে আমাদের বহুমাত্রিক সম্পর্ক রয়েছে। আমেরিকা যে ঘাটতিগুলো বলেছে সেটি এখন বললেই ঠিক হয়ে যাবে না বা কেউ করেও দিয়ে যাবে না। আমাদের দেশের জনগণকে সেটি ঠিক করতে হবে। এ দেশের জনগণ অতীতে সেক্রিফাইস (ত্যাগ স্বীকার) করে রক্ত দিয়ে এতদূরে এসেছে।
এখন চায়না, রাশিয়া, আমেরিকা যদি অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো নিয়ে একে অন্যে স্নায়ুযুদ্ধে জড়ায় সেটিও আমাদের জন্য ভয়ের বিষয়। আমাদের সমস্যা কেউ ঠিক করে দেবে না, আমাদের নিজস্ব প্রয়োজনে দেশের জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। এখানে যেহেতু জিও পলিটিক্স রয়েছে তাই বািবতণ্ডায় না গিয়ে সমাধানের পথ দেখাই শ্রেয় হবে। ঘাটতি পূরণ করা দেশের জন্য, সার্বভৌমত্বের জন্য কল্যাণকর হবে। এ সমস্ত বিষয় সামনে চলে আসলে অতীতেও দেখা গেছে জনগণ সামনে এসে সমাধান করেছে, এবারও জনগণ সামনে এসে অবশ্যই সমাধান খুঁজে নেবে বলে আমি মনে করছি।’ এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘গত নির্বাচন যে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি, এ নিয়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে কারও সন্দেহ নেই।
ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে সত্য কথাই উঠে এসেছে।’ অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের অভিযোগকে যুক্তি হিসেবে গ্রহণ করে, তার ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করে তাহলে এর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে। তিনি বলেন, গত নির্বাচন দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হয়েছে, এটি প্রমাণিত।’