Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিষ্কার সংস্কৃতি

মো. নাঈমুল হক

মার্চ ২৫, ২০২৩, ০৪:৪৫ এএম


বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিষ্কার সংস্কৃতি

নির্দোষ দাবি করা শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে পুনরায় তদন্ত করা উচিত

—ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক

সাবেক ভিসি, ঢাবি

 শক্ষার্থীদের মধ্যে সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করা উচিত

 —অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান

সাবেক ভিসি, জবি

 সম্প্রতি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বল্পমেয়াদি ও আজীবন বহিষ্কারের হার বেড়েছে। চলতি বছরের শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত দুই শতাধিক শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। র্যাগিং, চাঁদাবাজি, মারামারি-হাতাহাতি, পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন, সিট দখল, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন কারণে শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারের কথা জানাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কিন্তু বহিষ্কৃতরা সবাই সমান অপরাধী নন। তাদের অভিযোগ, লঘু পাপে গুরুদণ্ড পেয়েছেন তারা। শিক্ষাবিদরা মনে করেন, ফৌজদারি অপরাধ হলে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এ ছাড়া, সপ্তাহে এক দিন হলেও হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য মোটিভেশন চালাতে হবে। বিশেষ করে, নবীন শিক্ষার্থী এলে হল প্রশাসনের উচিত সিনিয়র-জুনিয়রদের সম্পর্ক বৃদ্ধিতে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা।

গত ২৩ মার্চ জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) সাভারের এক রেস্টুরেন্টে বসা নিয়ে বাগবিতণ্ডার জেরে সংঘর্ষের ঘটনায় পাঁচ ছাত্রলীগ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের মধ্যকার এই মারপিটের ঘটনায় রবীন্দ্রনাথ হলের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল হাসান বলেন, ‘বাদলের মাথা ফাটানোর অভিযোগের প্রেক্ষিতে অভিযুক্ত পাঁচ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ছাড়া এ ঘটনাসহ গতকালের সাংবাদিক হেনস্তার ঘটনা তদন্তের জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি ১০ কার্য দিবসের মধ্যে চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা দেবে। 

সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ বহিষ্কৃতদের মধ্যে এ ঘটনায় তানভিরুল ইসলাম, কাইয়ুম হাসান ও ইমরুল হাসান অমি আমার সংবাদের কাছে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। তানভিরুল ইসলাম বলেন, বটতলার ঘটনায় আমি ভাইদের সঙ্গে ছিলাম। কিন্তু মাথা ফাটানোর ঘটনায় আমি জড়িত ছিলাম না। আমি তখন ঢাকায় ছিলাম। বটলার ঘটনার কারণে ধারণা করে আমাকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। কাইয়ুম বলেন, ঘটনার দিন অডিটোরিয়ামের অনুষ্ঠানে গিয়েছি। অনুষ্ঠান শেষে বেরিয়ে আসার সময় হট্টগোলের কথা শুনি। কিন্তু আমি এ ঘটনার সাথে জড়িত না। ইমরুল হাসান অমিও একই কথা বলেন। তিনি এর সাথে যুক্ত করে বলেন, আহত যদি আমার নাম বলে তাহলে আমি শাস্তি মেনে নেবো। আমাকে মূলত রাজনৈতিকভাবে ফাঁসানো হয়েছে। 

একই দিন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ১৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্য ১৬ র্যাগিংয়ের অপরাধে হল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। যৌনহয়রানির অভিযোগে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের তাসফিকুল হক নামের এক শিক্ষার্থীকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ছাড়া শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী জীবন চন্দ্র সেনকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে। এ সময় পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে  আরো ১২ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মো. ফজলুর রহমান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২৭তম সিন্ডিকেট সভায় গ্রহণ করা সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। এদের মধ্যে র্যাগিংয়ের অভিযোগে ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের ১৬ জন শিক্ষার্থীকে আবাসিক হল থেকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে।’

এ মাসের শুরুতেই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে ফুলপরীকে নির্যাতনের ঘটনায় ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা চৌধুরীসহ পাঁচ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বহিষ্কৃত পাঁচ শিক্ষার্থী হলেন শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা, ছাত্রলীগ কর্মী ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষার্থী তাবাসসুম ইসলাম, আইন বিভাগের ইসরাত জাহান মিম, ফাইন আর্টস বিভাগের হালিমা খাতুন উর্মি ও ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের মোয়াবিয়া জাহান। তাবাসসুম ইসলাম নির্দোষ দাবি করে বলেন, সংগঠন করার কারণে বড় আপু কথা আমাদের শুনতে হয়। ফুলপরীকে আমি শুধু ডেকে এনেছি। তাকে কোনো ধরনের নির্যাতন করিনি। অথচ অন্তরা আপুর সমান শাস্তি আমাকে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও বছরের শুরু থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বহিষ্কার করা হয়েছে। গত ১১ জানুয়ারি সংঘর্ষ, সাংবাদিক হেনস্তা, আবাসিক হলে ভাঙচুর, ছাত্রী হলে মারামারিসহ আলাদা ছয়টি ঘটনায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ১৮ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

 এদের মধ্যে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও ১৭ জন একজন ছাত্র অধিকার পরিষদের কর্মী। ২৩ জানুয়ারি বিভিন্ন পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ও বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ২৫ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও এর অধিভুক্ত কলেজের ১০৯ শিক্ষার্থীকে স্থায়ী, সাময়িক ও বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা হয়েছে। এর মধ্যে স্থায়ী বহিষ্কার হয়েছেন একজন। অন্য ১০৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে ও সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। স্থায়ী বহিষ্কার হওয়া জীম নাজমুল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার দা সূর্যসেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলেন। ইভটিজিংয়ের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক এ ব্যবস্থা নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটি। অন্যদিকে বিভিন্ন মেয়াদে ও সাময়িক বহিষ্কার ১০৮ জনের বিরুদ্ধে পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন, ইভটিজিং, বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যবোধবিরোধী আচরণ ও অ্যালকোহল গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে। ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন, অসদাচরণ ও শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে তিন শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কর্তৃপক্ষ।

এ ব্যাপারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সাধারণত দু’ধরনের অপরাধে জড়িত হয়। এক. ফৌজদারি দুই. সামাজিক অপরাধ। ফৌজদারি অপরাধগুলো হলো— চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, যৌনহয়রানি, শিক্ষার্থীদের শারীরিক নির্যাতন ইত্যাদি। এ ধরনের অপরাধে যুক্ত শিক্ষার্থীদের পুলিশের হাতে দিতে হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের স্থায়ী বহিষ্কার করতে হবে। আর র্যাগিং দেয়া, জুনিয়রদের মানসিক ভাবে হেয় করা, সিট দখলের চেষ্টা ইত্যাদি অপরাধের ক্ষেত্রে তাদের কাউন্সিলিংয়ের আওতায় আনতে হবে। সিনিয়র-জুনিয়রদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরিতে গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষ করে, নবীনরা এলে প্রতি সপ্তাহে একদিন হলেও তাদের সাথে সিনিয়রদের সম্পর্ক উন্নয়নের কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।’ 

নিদোর্ষ দাবি করা শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে পুনরায় তদন্তের কথা জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে যেকোনো ঘটনা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এতে নিদোর্ষের ফেঁসে যাওয়ার  সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে নির্দোষ দাবি করা শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে পুনরায় তদন্ত করা প্রয়োজন। ঘটনার মূল হোতাদের সমান শাস্তি পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা আছে। তারা যদি ইচ্ছাকৃত ঘটনায় জড়িত হয় তাহলে সবার সমান শাস্তি হওয়া উচিত।’

 

 

Link copied!