এপ্রিল ৪, ২০২৩, ০৭:৪৮ এএম
রমজানের জোয়ারেও জুলাইয়ের চেয়ে কম আয়
আট মাসে বিদেশে গেছেন এক লাখ নতুন কর্মী
বছরজুড়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস বিশ্ব ব্যাংকের
চলমান ডলার সংকট মোকাবিলায় আসছে না কাঙ্ক্ষিত প্রবাসী আয়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে গত অর্থবছরে আগের বছরের তুলনায় রেমিট্যান্স অনেক কম এসেছে। এ বছর ইউরোপ ও আমেরিকা থেকেও কম রেমিট্যান্স আসছে। চলতি অর্থবছরের প্রতি মাসেই এসব দেশ থেকে প্রবাসী আয়ের ধারা নিম্নমুখী রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের বিভিন্নমুখী উদ্যোগের পরও সুফল মিলছে না। ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে দামের বড় পার্থক্য হওয়ায় অবৈধ হুন্ডিতে অর্থ আসছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কষ্টার্জিত বৈদশিক মুদ্রা দেশে আসার আগেই পাচার হয়ে যাচ্ছে অন্য দেশে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রকাশিত হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, প্রবাসী শ্রমিকদের বেশিরভাগই অবস্থান করেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। বার্ষিক রেমিট্যান্সের অর্ধেকই আসে সেখান থেকে। রেমিট্যান্স সংগ্রহে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, বাহরাইন, লিবিয়া ও ইরান উল্লেখযোগ্য। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশগুলো থেকে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমতে শুরু করেছে।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠান সৌদি আরবের প্রবাসীরা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ওই দেশ থেকে এসেছে ৪৫৪ কোটি ডলারের প্রবাসী আয়। কিন্তু এক বছর আগেও এর পরিমাণটা ছিল অনেক বেশি। তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫৭২ কোটি ডলার এসেছে দেশটি থেকে। সুতরাং এক বছরের ব্যবধানে ১১৮ কোটি ডলারের পার্থক্য তৈরি হয়েছে। চলতি অর্থবছরেও রেমিট্যান্স কম আসছে। প্রথম মাস জুলাইয়ে ৩৪ কোটি ডলার আসলেও গত ফেব্রুয়ারি মাসে এসেছে ২৬ কোটি ডলার। অর্থাৎ এ মাসে দেশটি থেকে রেমিট্যান্সের পরিমাণ আট কোটি ডলার কমে গেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে গত অর্থবছরে ২০৭ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। তবে ২০২০-২১ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ২৫৪ কোটি ডলার। অর্থাৎ দেশটি থেকে বছরের ব্যবধানে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ৪৭ কোটি ডলার কমে গেছে। চলতি অর্থবছরেও দেশটি থেকে আসা প্রবাসী আয় অনেক কমে গেছে। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে এসেছিল ৩০ কোটি ডলার। কমতে কমতে ফেব্রুয়ারিতে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১ কোটি ডলারে। এ ছাড়া কুয়েত থেকে এক বছরের ব্যবধানে রেমিট্যান্স কমেছে ৫৪ কোটি ডলার, ওমান থেকে ৪৮ কোটি, কাতার থেকে ৪৫ কোটি এবং বাহরাইন থেকে কমেছে ২০ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসের তুলনায় চতুর্থ মাসে এসব দেশ থেকে প্রবাসী আয় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কমেছে।
একই চিত্র যুক্তরাজ্যে। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে দেশটি থেকে এসেছিল ১৯ কোটি ডলার। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ কোটি ডলারে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা প্রবাসী আয় আগের অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছরে সামান্য কমেছে। তবে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ ধারা নিম্নমুখী। প্রতিমাসেই কমছে দেশটি থেকে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৩৬ কোটি ডলার আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। অষ্টম মাসে এসে এর পরিমাণ ১৩ কোটি ডলার কমে গেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে দেশটি থেকে এসেছে মাত্র ২৩ কোটি ডলার।
খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, মালয়েশিয়া, কানাডা, সিঙ্গাপুরসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশে পাচারকারীরা বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতারাও রেমিট্যান্স পাচারের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। তাদের অনেকে এক দেশ থেকে রেমিট্যান্সের টাকা সংগ্রহের পর বিনিয়োগ করছেন আরেক দেশের বিভিন্ন খাতে। অনেক ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তি বর্তমানে বিদেশে পরিবারসহ বাস করছেন। তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহসহ ক্ষেত্রবিশেষে বিদেশে তাদের সম্পদ বা ব্যবসা-বাণিজ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন বা চাহিদা তৈরি হয়েছে। এই চাহিদা তারা পূরণ করছেন হুন্ডিচক্রের মাধ্যমে ডলার সংগ্রহ করে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক আমার সংবাদকে বলেন, ‘ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রা আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে ইতোমধ্যে ডলারের যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে বাফেদা। এ ছাড়া আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। ব্যাংকগুলোও বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। একইসাথে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে সব ধরনের অনিয়ম ও কারসাজি বন্ধে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ করছে।’
এর আগে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়াতে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) যৌথভাবে ব্যাংকগুলোকে রেমিট্যান্স কেনার জন্য দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। বর্তমানে ১০৭ টাকায় রেমিট্যান্স ও ১০৫ টাকায় রপ্তানি বিলের মাধ্যমে আসা ডলার সংগ্রহ করছে ব্যাংক। তবে এসব উদ্যোগের পরও অবৈধ চ্যানেলগুলো বন্ধ হয়নি। কারণ ব্যাংকের চেয়ে অনেক বেশি দামে ডলার লেনদেন হচ্ছে মানিএক্সচেঞ্জ ও হুন্ডিতে। এমন প্রেক্ষাপটে ডলারের বাজারভিত্তিক দাম নির্ধারণের চাপ থাকলেও দেশীয় মুদ্রা টাকার অবনমন ঠেকাতে এখনই বাজারের হাতে ডলারের দাম ছেড়ে না দিয়ে কৌশলী অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এমন প্রেক্ষাপটে কাগজপত্রে ছাড়, ডলারের দাম বৃদ্ধি ও প্রণোদনাসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েও যখন গতি ফিরছিল না তখন রেমিট্যান্স পাঠানোর চার্জ মওকুফ করে দেয় ব্যাংকগুলো। প্রবাসীদের টাকা পাঠাতে সুবিধার কথা বিবেচনা করে ছুটির দিনেও বিদেশে এক্সচেঞ্জ হাউজ খোলা রাখা হচ্ছে। সবশেষ সরাসরি মোবাইলে ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা আনার সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবুও কাঙ্ক্ষিত রেমিট্যান্স আসছে না।
সদ্য শেষ হওয়া মার্চ মাসে আগের মাসের তুলনায় রেমিট্যান্স অনেকটা বেড়েছে। পবিত্র মাহে রমজানে প্রিয়জনের প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা করে বেশি পরিমাণে অর্থ পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। এতে প্রবাসী আয় দুই বিলিয়ন ডলার ছায়িয়ে গেছে। তবে তা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স আসে। জুলাইয়ে ২০৯ কোটি ডলার এবং আগস্টে আসে ২০৩ কোটি ডলার। গত আট মাসে এক লাখেরও বেশি নতুন কর্মী প্রবাসে গেছেন। এদের অধিকাংশ এমন ওইসব দেশে গেছেন; যেসব দেশের মুদ্রার মান অনেক বেশি। সে বিবেচনায় অন্তত ২৩০ থেকে ২৪০ কোটি ডলার আসার কথা। কিন্তু রমজান মাস হওয়া সত্ত্বেও মার্চে এসেছে মাত্র ২০১ কোটি ডলার; যা জুলাইয়ের চেয়েও কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, মার্চ মাসে ২০১ কোটি ৭৭ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। আগের দুই মাস জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে যথাক্রমে ১৯৫ কোটি ৮৯ লাখ এবং ১৫৬ কোটি পাঁচ লাখ ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। অন্যদিকে বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স নিয়ে হতাশার কথা জানিয়েছে বিশ্ব আর্থিক খাতের মোড়ল সংস্থা বিশ্ব ব্যাংক। ওয়াশিংটনভিত্তিক এই উন্নয়ন সংস্থাটি বলেছে, রেমিট্যান্সের নেতিবাচক প্রবণতা ২০২৩ সালেও অব্যাহত থাকবে। এর আগে গত ২০২২ সালে সংস্থাটির ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২১ বিলিয়ন (দুই হাজার ১০০ কোটি) ডলার দেশে এসেছিল। যা আগের বছরের চেয়ে ৫ দশমিক ৪০ শতাংশ কম। ২০২১ সালে দেশের প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২ দশমিক ২ শতাংশ।
বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তথা মজুতের বড় উৎস রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। তবে গত অর্থবছরের তুলনায় রপ্তানি আয় ৩৫ শতাংশ বাড়লেও প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে। এর ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ এখন ৩১ বিলিয়ন ডলারে অবস্থান করছে। বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগকৃত অর্থ বাদ দিলে নিট রিজার্ভের পরিমাণ আরও আট বিলিয়ন কম হবে। সদ্য সমাপ্ত মার্চে রপ্তানিতেও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, ‘অবৈধ হুন্ডি বন্ধ না হলে প্রবাসী আয় বাড়ানো সম্ভব নয়। ডলারের দামে বড় পার্থক্যের কারণে প্রবাসীরা অবৈধ চ্যানেলে অর্থ পাঠাচ্ছেন। ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে আশানুরূপ রেমিট্যান্স আসছে না।’