Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

২৮ বছর পর ফের পুড়ল বঙ্গবাজার

নুর মোহাম্মদ মিঠু

এপ্রিল ৫, ২০২৩, ১২:৫৪ এএম


২৮ বছর পর ফের পুড়ল বঙ্গবাজার
  • ফায়ার সার্ভিসের সতর্কতা উপেক্ষার ফল
  •  পুড়ল পাঁচ হাজার দোকান ৫০ হাজার কর্মচারী কর্মহীন
  •  বঙ্গবাজারের চেয়ে পুলিশ হেডকোয়াটার্স রক্ষার চেষ্টাই ছিল বেশি
  •  পুড়ে যাওয়া মার্কেটে দোকান বুঝে পাওয়া নিয়ে শঙ্কা
  •  হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি —মালিক সমিতি
  •  নাশকতা কি না তদন্তে বেরিয়ে আসবে —আইজিপি
  •  এটি দুর্ঘটনা, নাশকতা নয় —মেয়র তাপস
  •  তদন্তে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচ সদস্য ও ডিএসসিসির আট সদস্যের কমিটি গঠন

 হাজার হাজার মানুষের স্বপ্ন পুড়িয়ে সাড়ে ছয় ঘণ্টা পর নিভল বঙ্গবাজারের আগুন। ছিল ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সর্বাত্মক চেষ্টা। হেলিকপ্টারও ব্যবহার করতে হয়েছিল আগুন নিয়ন্ত্রণে। যদিও আগুন তার নিজস্ব গতিতেই নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে জানিয়েছেন বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা। তবে ফায়ার সার্ভিস বলছে, উৎসুক জনতাসহ তিন কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় লেগেছে। স্মরণকালের বড় এই অগ্নিদুর্ঘটনার কারণ হিসেবে অনেকেই দুষছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে। কারণ ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে এর আগে মার্কেটটিকে ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে ব্যানার টাঙ্গিয়ে ১০ বার নোটিসও দেয়া হয়েছিল। মার্কেটটি যেহেতু সিটি কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণে সেহেতু তাদেরই ব্যবস্থা নেয়ার কথা। 

তাদের উদাসীনতার কারণেই অগ্নিঝুঁকি নিয়ে চলা বঙ্গবাজারে অগ্নিদুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আবার এসবের দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল রাজউকেরও। তদারকি সংকটে ফের ২৮ বছর পর বঙ্গবাজারের অগ্নিদুর্ঘটনায় গতকাল পুড়েছে পাঁচ হাজার দোকান। কর্মহীন হয়ে পড়েছে ৫০ হাজারেরও বেশি কর্মচারী। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। দিশা হারিয়ে উত্তেজিত হয়ে ব্যবসায়ীরা গতকাল হামলাও করেছে ফায়ার সার্ভিস ভবনে। একই সময় পুলিশ সদস্যকেও করা হয়েছে মারধর। তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ফজলে নুর তাপস বলেছেন, চার বছর আগেই বঙ্গবাজার ঝুঁকিপুর্ণ ঘোষণা করা হয়েছিল। হাইকোর্টে মার্কেট সমিতির করা রিটের কারণে নতুন ভবন করতে পারেনি ডিএসসিসি।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, গতকাল ভোর ৬ টা ১০ মিনিটের দিকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। যদিও বলা হচ্ছে আগুনের শুরুটা ঘটেছিল বঙ্গবাজারের পাশের আদর্শ মার্কেট থেকে। ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, ভোরে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এ ফোনে জানা যায় আদর্শ মার্কেটে আগুন লেগেছে। সেই সূত্র ধরে ফায়ার সার্ভিস আগুন নিভাতে গিয়ে দেখে জ্বলছে বঙ্গবাজার। সময়মতো আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরু করা যায়নি মার্কেটটি তালাবদ্ধ থাকার কারণে। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল এই ভবনটিকে আমরা অত্যন্তঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছি এবং ব্যানার টাঙিয়েছি। এরপর ১০ বার নোটিস দিয়েছি। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে যা যা করা সম্ভব ছিল, আমরা করেছি। তারপরও এখানে ব্যবসা চলছে।’ এই মার্কেটটি সিটি কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণে। তাদেরকে ‘অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ’ জানিয়ে নোটিস দেয়া হয়েছে কি-না এবং তাদের গাফিলতির কারণেই এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলো কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। 

যে সংস্থার নাম উচ্চারণ করেছেন, তাদের জিজ্ঞাসা করেন।’ ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের এত কাছে আগুনের ঘটনা ঘটার পরও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ছয় ঘণ্টারও বেশি সময় কেন লাগল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এর প্রধান কারণ উৎসুক জনতা।’ এ সময় তিনি তার মোবাইলে ধারণকৃত একটি ভিডিও দেখান, যেখানে উৎসুক জনতার ভিড়ে রাস্তা প্রায় বন্ধ হয়ে আছে। এই অগ্নিকাণ্ড কীভাবে শুরু হলো সে বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের কারণ আমরা জানি না। তিনি বলেন, এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের আটজন আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে দুজন গুরুতর অবস্থায় বার্ন ইউনিটে আছেন।’ ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরে দোকানদারদের হামলার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসের সব পদবির কর্মচারী আপনাদের জন্য জীবন দেন। গত এক বছরে ১৩ জন ফায়ারফাইটার শহীদ হয়েছেন, যারা ‘অগ্নি বীর’ খেতাব পেয়েছেন। আহত হয়েছেন ২৯ জন। এমনকি আজকে আটজন আহত হয়েছেন।

তারপরও কেন বা কারা ফায়ার সার্ভিসের ওপর আঘাত হানল? এটি আমার বোধগম্য নয়। আমরা তো আপনাদের জন্যই জীবন দিচ্ছি।’ অগ্নিকাণ্ডের এ ঘটনার কারণ জানতে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিসের আট সদস্য ছাড়াও অগ্নিকাণ্ডে আহত হয়েছেন পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসের সদস্য, দোকান মালিক ও কর্মচারীসহ আর ১৩ জন। তবে অগ্নিকাণ্ডের এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের অবহেলাকেই দায়ী করছেন মার্কেটের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। তারা বলেন, শুরুতে এই অগ্নিকাণ্ডকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা। তাই দুটি আগুন নির্বাপক বোতল নিয়ে এসেছিলেন। পরে আগুন বাড়লে মার্কেটের চাইতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার রক্ষার চেষ্টাই বেশি করেন বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। এ ছাড়াও পুড়ে যাওয়া মার্কেটে নিজেদের দোকান বুঝে পাওয়া বিষয়েও শঙ্কায় রয়েছেন ব্যসায়ীরা। 

এদিকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে এক হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে রাজধানীর অন্যতম জনপ্রিয় পোশাকের এই বাজারে প্রায় আড়াই হাজার দোকান ছিল। ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে দোকানদাররা অনেক টাকার মালামাল তুলে ছিলেন। সেখানে শাড়ি, শার্ট, প্যান্ট, সালোয়ার কামিজসহ সব ধরনের পোশাক বিক্রি হয়। তিনি বলেন, বিক্রেতারা ঈদ উপলক্ষে কয়েকশ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। ‘অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকারও বেশি হবে।’ তবে বঙ্গবাজারের দোকান মালিকদের কাছ থেকে ক্ষয়ক্ষতির কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে দোকানিদের কয়েকজন বলছেন, তারা দোকানগুলোতে এক কোটি টাকা থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছেন।

আগুন নিয়ন্ত্রণকালে ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরে হামলার ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন কী অবস্থা, এখানে হাজার হাজার মানুষ। হামলার খবর পেয়ে আমরা সঙ্গে সঙ্গেই গেছি, এরপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছি। পরে জড়িতদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ আইজিপি বলেন, আমরা রাজারবাগ থেকে পাঁচটি ওয়াটার ক্যানন এনে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কাজ শুরু করি। আমাদের ওয়াটার রিজার্ভার থেকে প্রায় দুই লাখ লিটার পানি সাপ্লাই দিয়েছি। আমাদের পুলিশের প্রায় দুই হাজার ফোর্স এই এলাকায় দায়িত্ব পালন করছে। আল-মামুন বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা অত্যন্ত পরিশ্রম করেছেন। র্যাব-বিজিবিসহ তিন বাহিনীর সদস্যরা একযোগে দায়িত্ব পালন করেছেন। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। আমাদের একটি ব্যারাকে আগুন লেগেছে। আমাদের সব সদস্য নিরাপদে বের হতে পেরেছেন। মালামাল বের করতে পারিনি। ডকুমেন্টস ও মালামালের কী ক্ষতি হয়েছে তা পরে জানা যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। নাশকতার কোনো ঘটনা থাকলে কমিটির তদন্তে বেরিয়ে আসবে। আমরা সেই রিপোর্টের অপেক্ষায় থাকব। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।’

এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) বলছে, চার বছর আগেই বঙ্গবাজার ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছিল সংস্থাটি। মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস গতকাল এ কথা বলেন। তিনি বলেন, বঙ্গবাজার মার্কেট ২০১৯ সালে কর্পোরেশন ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে। তখন নতুন ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু সে সময় মার্কেট সমিতি নতুন ভবন নির্মাণে স্থগিতাদেশ চেয়ে হাইকোর্টে রিট করে এবং হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দেন। এতে সিটি কর্পোরেশনের কিছু করার ছিল না। এ ছাড়াও তিনি বলেছেন, এটি দুর্ঘটনা, নাশকতা নয়। এছাড়া ডিএসসিসির পক্ষ থেকে ঘটনা তদন্তে আট সদসেদ্যর কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এ সময় ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, আজ অগ্নিকাণ্ডে পাঁচ হাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই এই দুর্ঘটনা তদারকি করছেন।

Link copied!