Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪,

শিশুদের জন্য নতুন অধিদপ্তর এখন সময়ের দাবি

মো. তানজিমুল ইসলাম

মো. তানজিমুল ইসলাম

এপ্রিল ১০, ২০২৩, ১১:৩৮ এএম


শিশুদের জন্য নতুন অধিদপ্তর এখন সময়ের দাবি

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ। এখানে প্রায় ১৭ কোটি লোক বাস করে। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশ, অর্থাৎ ৬ কোটিরও বেশি জনসংখ্যা কেবল শিশু। স্বাধীনতা পরবর্তী ৫০ বছরে নিঃসন্দেহে এদেশে অনেক উন্নয়ন ঘটেছে। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজ আমরা শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অর্থনীতিতে অনেকাংশেই এগিয়ে গেছি বৈকি! উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে ইতোমধ্যে অনেক মেগা প্রকল্প যেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশকে আজ নতুনভাবে সু-পরিচিত করেছে! সব মিলিয়ে, একজন বাংলাদেশি হিসেবে নিশ্চয়ই আমরা গর্বিত! কিন্তু পুরো দেশের এই আঠারো কোটি জনতার আর্থ-সামাজিক ও মানবাধিকারের কথা বিশেষ করে শিশুর অধিকারের কথা ভাবলে কী সত্যিই আমরা গর্বিত হতে পারি?

ডিজিটাল বাংলাদেশের তকমা গায়ে লাগিয়ে এ বিশাল জনগোষ্ঠী বিশেষ করে আপাত-দৃষ্টিতে যুবসমাজ যেন বেশ ফুরফুরে মেজাজে! ইদানীং আবার আকাশে-বাতাসে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা শোনা যাচ্ছে বেশ জোরেশোরে! এ সবই যেন, উন্নয়নেরই নামান্তর! কিন্তু অবচেতন মনেই প্রশ্ন জাগে, আপামর জনগোষ্ঠীর বিশেষ করে প্রান্তিক শিশু সন্তানরা আসলে কেমন আছে? কোথায় কিভাবে দিনানিপাত করছে? বিনামূল্যে বই পেয়ে নিশ্চয়ই তারা খুশি! স্কুলের অবকাঠামোগত সুবিধা, পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধাসহ সার্বিক পরিবেশে আসলেই কী তারা খুশি? স্কুল শেষে বাড়িতে, এমনকি অনেকে আবার নিদেন পক্ষে কর্মক্ষেত্রে তারা আসলে কেমন থাকে? দারিদ্র্যতার কষাঘাতে জর্জরিত কোমলমতি শিশুরা তাদের নিজ বাড়িতে বা বস্তি এলাকায় কিভাবে কাটে তাদের দৈনন্দিন? এমনকি ইট পাথরে গড়া ইমারত এমনকি অট্টালিকায় আবদ্ধ শিশুরাই কী আসলে অনেক বেশি সুখি যাপন করছে?

ইতোপূর্বে এদেশের অনেক শিশু মা-বাবার প্রাত্যহিক কাজের সহযোগী হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত করলেও, আজ তারা নতুন করে উপার্জনকারী ‘শ্রমিক’ হিসেবে প্রমাণ করছে। আজকাল নতুন করে গৃহকর্মে, ইটের ভাটায়, কলকারখানায়, হোটেলে, ভ্যানে, এমনকি মাদক-জুয়ার আসরেও তাদের শ্রম বিক্রি হচ্ছে হরহামেশাই! এসব নতুন কোনো ঘটনা নয় এদেশে! এই ছোট্ট দেশটিতে যেখানে ছয় কোটিরও বেশি কেবল শিশু, সেখানে শিশুদের নিয়ে ভাববার মতো সঠিক স্থান কি আসলে আছে? এই ছয় কোটির মধ্যে আবার প্রায় ১০ লাখই ‘পথশিশু’, যাদের অনেকেই জনশুমারিভুক্ত (আদমশুমারি) কি না এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে!

এক জাতীয় দৈনিকের তথ্য অনুযায়ী পথশিশুদের ৮৫ শতাংশই  মাদকাসক্ত! যারা ভবিষ্যতে দিকভ্রম হয়ে বিপথে পা বাড়ায়! নিজেদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পাশাপাশি পুরো জাতির আগামীর স্বপ্নকে ভেঙেচুরে চুরমার করে তোলে! সারা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পাই, নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব-কর্তব্য কতখানি সুদৃঢ়! পক্ষান্তরে, রাষ্ট্রের প্রতি সাধারণ নাগরিকদের দায়িত্ব-কর্তব্য কতটা সমুন্নত! পাবলিক হেলথের তথ্যমতে উন্নত দেশগুলোর উন্নয়নের নেপথ্যে কাজ করে প্রতিটি শিশুকে উন্নত ব্যবস্থায় গড়ে তোলার নীতি! প্রতিটি শিশুর প্রতি অভিভাবকরা যেমনটি যত্নশীল; রাষ্ট্রকাঠামোও যেন তাদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। সেক্ষেত্রে মধ্যম আয়ের দেশ তথা স্মার্ট বাংলাদেশের কাছে এদেশের শিশুদের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে যৌক্তিক প্রত্যাশাটি কি অন্যায় কিছু?  

ডিজিটাল বাংলাদেশের মোক্ষম সময়ে বাংলাদেশ শ্রম আইনের বিষয়টিকে তোয়াক্কা না করে আজ শিশুশ্রম চলছে দেশের আনাচে-কানাচে সর্বত্রই! যা শিশু সুরক্ষা তথা শিশু অধিকারের পরিপন্থি! আমরা যখন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার আনন্দে পুলকিত; ঠিক সেই মুহূর্তে এই শিশু তথা আগামীর ভবিষ্যতের ভয়াবহতার কথা ভাবলে কী আর ভালো থাকা যায়।
বাংলাদেশ সরকার ছাড়াও দেশি-বিদেশি উন্নয়ন সংস্থাসমূহ শিশুশ্রম রোধে নানাবিধ কাজ অব্যাহত রাখলেও শিশুশ্রম কমছে না কিছুতেই! ক্রমশ: শিশুশ্রম বন্ধের লড়াইয়ে আমরা যেন হারতে বসেছি। গণিত বইয়ের বানরের তৈলাক্ত বাঁশে উঠানামার মতো ক্রমশ : আমাদের যেন অনেক পেছনে ঠেলে দিচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে বাংলাদেশে ৩২ লাখ শিশু শ্রমিক রয়েছে, যার মধ্যে ১৩ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত যা তাদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও নৈতিকতার জন্য ক্ষতিকারক।

সারা পৃথিবীজুড়েই শিশুর সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনা করতে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক কর্মসূচি গৃহীত হলেও শিশু নির্যাতন তথা শিশু অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি থেমে নেই একটি মুহূর্তের জন্যও! চোখের সামনেই এমন অজস্র ঘটনার সাক্ষী আমরা সবাই! নির্বাক দর্শক-শ্রোতা হয়ে কেবল হজম করে ফেলি সবকিছুই! আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শিশু অধিকার সনদে মূলনীতি হিসেবে (১) বৈষম্যহীনতা, (২) শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষা, (৩), শিশুর অধিকার সমুন্নত রাখতে অভিভাবকদের দায়িত্ব ও (৪) ‘শিশুদের মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন’ এর কথা উল্লেখ থাকলেও বাংলাদেশের মতো এই বৈচিত্র্যময় দেশটিতে বিশেষ করে বর্তমান পরিস্থিতিতে এর যথাযথ প্রয়োগ খুবই বিরল!  

’শিশুশ্রম’ ছাড়াও ’শিশুর প্রতি সহিংসতা’ কেবল একটি শিশু বা তার পরিবারকেই ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে না বরং অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে ফেলে একটি জাতির অপার সম্ভাবনা! মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম একটি হলো সু-শিক্ষা (প্রাতিষ্ঠানিক ও বাস্তবভিত্তিক)। কিন্তু অনুকূল পরিবেশের অভাবে অন্য আরেকটি মৌলিক চাহিদা অর্থাৎ অন্ন জোগাড় করতে তখন তাকে শৈশবেই যুবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয় এ দেশে! কাজ যতই হোক পারিশ্রমিকের বেলায় (অল্প টাকায়) কেবলমাত্র শৈশবকে বিবেচনা করা হয় এ সমাজে।

বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক শিশু তাদের মৌলিক মানবাধিকার বঞ্চিত। এমনকি বাড়িতে নিজেদের অধিকার নিয়ে কথা বলারও সুযোগ পায় না। শূন্য থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশুদের মধ্যে ৫০ শতাংশেরও বেশি যেকোনো ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। অথচ ৪৯.৮ শতাংশ অভিভাবক মনে করে, তাদের কমিউনিটি এবং ৫৬.৮ শতাংশ অভিভাবক মনে করে, তাদের বিদ্যালয়গুলো শিশুদের জন্য নিরাপদ। আসলেই কী তারা নিরাপদ নাকি এটি একটি বদ্ধমূল ধারণা মাত্র! দৈনিক খবরের কাগজ, টেলিভিশন ছাড়াও সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটু চোখ রাখলেই এর বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় খুব সহজেই!

শিশুর প্রতি শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক যৌন সহিংসতা রোধে সামাজিক প্রথা, দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ পরিবর্তনের পাশাপাশি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার কোনো বিকল্প নেই। শিশুর সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার যেমন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ৮.৭ ও ১৬.২ বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর, একই সাথে শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ বিবেচনা করে শিশুদের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান যেন এখন সময়ের দাবি! শিশু সুরক্ষা ও শিশু অধিকারের বিষয়টি আমাদের মনে নিশ্চয়ই অনেক বেশি নাড়া দেয়! সত্যিই তাই!

বাস্তবতা হলো— সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করতে না পারলে শিশুর ও অধিকার সুরক্ষা  কখনোই নিশ্চিত হবে না। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। সুন্দর আগামীর জন্য সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা যেমন জরুরি, ঠিক তেমনি প্রয়োজন, প্রতিটি শিশুর জন্য আমজনতার আন্তরিক ভালোবাসা! নয়তো, এই শিশুরাই আগামীতে গর্বিত নাগরিক না হয়ে ভিক্ষাবৃত্তিসহ নানান অপকর্মে জড়িয়ে যাবে! রাগ-ক্ষোভ-অভিমানে এদেশের মানচিত্রকেও হয়তো তারা চিবিয়ে খেতে চাইবে একদিন!

ছোট্ট একটি দেশে বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে তাদের নাগরিক সুবিধা ও রাষ্ট্রীয় অধিকার নিশ্চিত করতে ৪৩টি মন্ত্রণালয় কাজ করছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, আইন, যোগাযোগ, খাদ্য, ধর্ম, রেলপথ, নৌ-পরিবহন, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, কৃষি, তথ্য, শিল্প, প্রতিরক্ষা, মহিলা ও শিশু, ইত্যাদিসহ মোট ৪৩টি মন্ত্রণালয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিরা এদেশের জনগণের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। ৪৩টি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে  কাগজে-কলমে ২৩টি মন্ত্রণালয়ের শিশু সুরক্ষা ও অধিকার নিয়ে কাজ করার কথা থাকলেও পরস্পরের মধ্যে যেন সমন্বয়হীনতার শেষ নেই! যার ফলশ্রুতিতে শিশুদের অধিকার নিশ্চিত তো দূরের কথা, তারা যেন প্রতিনিয়ত বলির পাঁঠাতে পরিণত হচ্ছে! এদেশে অনেক নতুন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।

অথচ আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, গরু-ছাগল (পশু সম্পদ), মাছ (মৎস্য), বন্যপ্রাণীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় থাকলেও শিশুদের জন্য পৃথক কোনো মন্ত্রণালয় এমনকি অধিদপ্তরও নেই! তবে কী শিশুরা বরাবরের মতো অবহেলিতই থেকে যাবে। এ মুহূর্তে শিশুদের জন্য পৃথক কোনো অধিদপ্তরের দাবিটি সত্যিই যৌক্তিক! এ প্রসঙ্গে ২০২২ সালের ১১ আগস্ট রাজধানীর একটি হোটেলে বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে শিশুদের জন্য আলাদা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া কিছুটা ব্যাহত হয়েছে।

তবে  জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থমন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে যত দ্রুত সম্ভব, শিশুদের জন্য আলাদা অধিদপ্তর করা হবে’। এ ছাড়া আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, শিশুদের সুরক্ষা ও উন্নয়নের জন্য সরকারের বিদ্যমান আইনে শিশুদের বয়স সংক্রান্ত যা যা পরিবর্তন প্রয়োজন, সরকার তার বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। তবে তো আমরা আশা করতেই পারি, অনতিবিলম্বে শিশুদের জন্য নতুন এক অধিদপ্তর করা হবে। যার মাধ্যমে শিশুরা তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারবে; এমনকি তাদের প্রাপ্য অধিকার পেতে আর কোনো অদৃশ্যমান কারণের প্রয়োজন পড়বে না! শিশুরা যদি জাতির ভবিষ্যৎ হয়েই থাকে, তবে শিশুর বাসযোগ্য সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবী গড়ার দায়িত্ব আপনার, আমার, সবার। এ দেশে শিশুদের তুলনায় মৎস্য ও পশুসম্পদের ব্যাপক গুরুত্ব দিয়ে পৃথক পৃথক মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা থাকে অথচ শিশুদের বেলায় নতুন মন্ত্রণালয় নয় বরং একটি স্বতন্ত্র অধিদপ্তরের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয় বছরের পরে বছর, বিশ্বায়নের এই যুগে সে দেশের শিশুরা তাল মিলিয়ে চলবে কি করে? তাই, সার্বিক বিবেচনায় শিশুদের জন্য নতুন অধিদপ্তর এখন সময়ের দাবি।’

লেখক : কো-অর্ডিনেটর, অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড সোশ্যাল একাউন্টিবিলিটি ওয়ার্ল্ড ভিশন, বাংলাদেশ।

Link copied!