Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

পরিচ্ছন্নতায় অনিয়ম

স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে নগরবাসী

আবু ছালেহ আতিফ

আবু ছালেহ আতিফ

এপ্রিল ১৩, ২০২৩, ১২:২৯ পিএম


স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে নগরবাসী
  • ভোর রাতে ঝাড়ু দেয়ার নিয়ম থাকলেও দেয়া হচ্ছে সন্ধ্যায়
  • পানি ছিটানো কার্যক্রমে তৎপরতা নেই  
  • হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, এলার্জি রোগীদের দুর্ভোগ চরমে

স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে, সিটি কর্পোরেশনের মনিটরিং দরকার —ডা. বেনজির আহমেদ, জনস্বাস্থ্যবিদ
সত্যতা যাচাই করে ব্যবস্থা নেয়া হবে —হায়দর আলী, প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা, ডিএসসিসি
সময়মত ঝাড়ু দিক পরিচ্ছন্নকর্মীরা —দাবি ভুক্তভোগীদের

নগর পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে নিয়ম মানছেন না এ কাজে নিয়োজিত কর্মীরা। জনভোগান্তির কথা চিন্তা করে শেষ রাতে যখন রাস্তা ফাঁকা থাকে তখন পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের সময় বেঁধে দিয়েছে সিটি কর্পোরেশন। প্রথম থেকেই এ নিয়ম চালু থাকলেও সম্প্রতি পরিচ্ছন্নতার কাজ করা হচ্ছে সন্ধ্যায়। যখন রাস্তায় মানুষের চলাচল সবচেয়ে বেশি থাকে। এতে চরম ভোগান্তিতে রয়েছে নগরবাসী। চলাচলে বিঘ্ন তৈরি, ধুলাবালিতে জামাকাপড় ও গাড়ি নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, এলার্জি রোগীদের দুর্ভোগ এখন চরমে। নজরদারি না থাকায় পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের এমন খামখেয়ালি আচরণের কাছে অসহায় নাগরিকরা। জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি এমন কর্মকাণ্ড বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।  

সরেজমিন দেখা যায়, সকাল, বিকাল আর সন্ধ্যা নেই; যখন তখন ঝাড়ু দিচ্ছে সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। যদিও ঝাড়ু বা অন্যান্য পরিষ্কার কাজের জন্য রয়েছে  নির্ধারিত সময়। কিন্তু নিয়মের তোয়াক্কা নেই পরিচ্ছন্ন কর্মীদের মধ্যে। বড় সড়ক, অলিগলির ছোট রাস্তা, মানুষের ব্যস্ততম জায়গাগুলোতে যখন তখন ঝাড়ুর কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছেন রাজধানীবাসী। তাদের অভিযোগ এমন অপরিকল্পিত ও বিশৃঙ্খলভাবে ঝাড়ু দেয়ায় নাক-মুখ ঢেকেও ধুলো থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না।

ফলে সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট এবং এলার্জিজনিত সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে অধিকাংশ মানুষকে। আবার ঝাড়ু দেয়ার সময় পরিচ্ছন্নকর্মীদের মধ্যে ন্যূনতম শৃঙ্খলা দেখা যায় না; বলছেন ভুক্তভোগীরা। খুব তাড়াহুড়ো করে পথচারীদের দিকে লক্ষ্য না রেখেই এলোপাতাড়ি ঝাড়ু দিতে থাকেন তারা। কোনোরকম দায়িত্ব শেষ করে বাসায় যাওয়ার খুব তারা থাকে তাদের। গত কয়েকদিন ঢাকার গুলিস্তান, তাঁতীবাজার, নবাবপুর, সদরঘাট, গেন্ডারিয়া, ধুপখোলা, রায়সাহেব বাজার, লক্ষ্মীবাজার ও সূত্রাপুর এলাকার বিভিন্ন বড় সড়ক ও গলি ঘুরে নগরবাসীর সাথে কথা বলে সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নকর্মীদের এমন বেখেয়ালি ও জনভোগান্তিমূলক দায়িত্ব পালনের চিত্র পাওয়া গেছে।

বিশেষ করে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এমন অনিয়ম নিত্যদিনের। গত সোমবার সকাল ৯টায় পুরান ঢাকার কলতাবাজার থেকে জজকোর্টের দিকে যাচ্ছিলেন অ্যাডভোকেট রাশেদুর রহমান। এ সময় রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছিলেন এক পরিচ্ছন্নকর্মী। এ সময় কোর্টগামী রাশেদকে নাক চেপে রাস্তার অপর পাশ দিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে দেখা যায়। এ সময় এ অ্যাডভোকেট বিরক্ত প্রকাশ করে বলেন, ‘নাক-মুখ আটকে যায় ধুলোর কারণে। কেন যে এদের সিটি কর্পোরেশন নিয়মে আনতে পারে না। এমনিতেই ঢাকা শহরের দূষণের পরিস্থিতি ভয়াবহ। তারপর যদি ঝাড়ুদাররা এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন দায়সারা কাজ করে। তাহলে ভোগান্তির পাশাপাশি স্বাস্থ্য ঝুঁকি তো হবেই।’

সিটি কর্পোরেশনের নিয়ম অনুযায়ী ঝাড়ু দেয়ার কথা ভোর রাত থেকে শুরু করে সকাল ৬টার আগ পর্যন্ত। আর রমজান মাসে তারাবির পর মধ্য রাতে ঝাড়ু দেয়ার নিয়ম রয়েছে। নগরবাসীর চলাচলের বিঘ্নতা ও স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনা করে এমন নিয়ম করা হয়েছে বলে আমার সংবাদকে জানিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। গত শনিবার মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে রাত ৮টায় ঝাড়ু দিচ্ছিলেন সিটি কর্পোরেশনের পোশাক পরিহিত আরেক পরিচ্ছন্নতাকর্মী। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় ভোর রাতের পরিবর্তে সন্ধ্যায় কেন ঝাড়ু দেয়া হচ্ছে। বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘মেয়রকে জিজ্ঞেস করেন, আমরা জানি না। আমরা কাজ করি, যখন দিতে বলে তখনই দেই।’

আমার সংবাদ প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় আরও কয়েকজন পরিচ্ছন্নকর্মীর সাথে। ইফতারের পরপরই সূত্রাপুরের ৪৪নং ওয়ার্ড সংলগ্ন কাঠেরপুল ও সূত্রাপুর ডাইলপট্টির কয়েকটি গলিতে তাড়াহুড়ো করে ঝাড়ু দিচ্ছিলেন ময়না আক্তার ও শাওন নামে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ড্রেস পরিহিত দুই পরিচ্ছন্নকর্মী। খুব তাড়াহুড়ো করে প্রচণ্ড ধুলো উড়িয়ে ঝাড়ু দিচ্ছিলেন তারা। যখন সেখানকার পথচারীদের মধ্যে মারাত্মক বিরক্তি দেখা যায়। এমনকি ধুলোর কারণে চলমান রিকশা, মোটরবাইক থামিয়ে রাখতে হয়, যার কারণে গলিতে যানজট লেগে যায়। এমনভাবে তাড়াহুড়ো করে ঝাড়ু দিয়ে ধুলো ওড়ানো এবং নির্দিষ্ট সময়ে ঝাড়ু না দিয়ে সন্ধায় দেয়ার ব্যপারে জানতে চাইলে পরিচ্ছন্নকর্মীরা খুব বিরক্তি প্রকাশ করে। তারা জানায়, ‘এভাবেই দিই সবসময়। কেউ তো কিছু বলে না। আর ঝাড়ু দেয়ার সময়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে শাওন নামক দক্ষিণ সিটির ঝাড়ুদার বলেন, ঝাড়ু দিতে দিতে তারাবির সময় হয়ে যাবে এজন্য এখন শুরু করছি।’

মানুষের চলাচলের দিকে লক্ষ্য না রেখে বেখেয়ালিভাবে ঝাড়ু দিয়ে ধুলো ওড়ানো সম্পর্কে জানতে চাইলে ময়না আক্তার নামক ঝাড়ুদার কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ থাকেন। এবং এতে যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তিনি তা স্বীকার করেন। তবে এরপরও কেন দিচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন বাসায় অনেক কাজ, বাসায় যেতে হবে।

এদিকে, গত মাসের ৮ তারিখে বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান প্রথম। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার দূষিত বাতাসের শহরের তালিকা প্রকাশ করে। গবেষণা থেকে জানা যায়, প্রতিদিনের ঢাকায় চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক দিন দুর্যোগপূর্ণ বায়ুর মধ্যে কাটিয়েছে নগরবাসী। জানুয়ারি মাসে মোট ৯ দিন রাজধানীর বায়ুর মান দুর্যোগপূর্ণ ছিল, যা গত ৭ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ ধারা এখনো অব্যাহত।

প্রতিদিনের বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা একিউআই সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বায়ু কতটুকু নির্মল বা দূষিত, সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয় এবং তাদের কোনো ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে কি না, তা জানায়। একিউআই স্কোর শূন্য থেকে ৫০ ভালো হিসেবে বিবেচিত হয়। ৫১ থেকে ১০০ মাঝারি হিসেবে গণ্য করা হয়। আর সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয় ১০১ থেকে ১৫০ স্কোর। ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয়। একইভাবে একিউআই স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে খুবই অস্বাস্থ্যকর বলে বিবেচনা করা হয়। আর ৩০১-এর বেশি হলে তা দুর্যোগপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। বায়ুদূষণ গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। এটা সব বয়সি মানুষের জন্য ক্ষতিকর। তবে শিশু, অসুস্থ ব্যক্তি, প্রবীণ ও অন্তঃসত্ত্বাদের জন্য বায়ুদূষণ খুবই ক্ষতিকর। আর এ বায়ুদূষণের জন্য অন্যতম একটা দৈনন্দিন কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে, পরিচ্ছন্নকর্মীদের এমন বিশৃঙ্খল, এলোমেলোভাবে ধুলো উড়িয়ে ঝাড়ু দেয়া।

এ ছাড়া সরেজমিন পরিদর্শনকালে রাজধানীতে পানি ছিটানো কার্যক্রম চোখে পড়েনি। কয়েকজনের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, মাঝেমধ্যে ভিআইপি সড়কে এমন কার্যক্রম দেখা যায়। এ ব্যপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ আমার সংবাদকে বলেন, প্রথমত রাস্তা ধুলিহীন হলে গাড়ির চাকায় ধুলো উড়বে না। মূলত ধুলোর কারণে স্বাস্থ্যের নানাবিধ অসুখ হয় এটা সবাই জানে। এটা রাজধানী ঢাকাতে মারাত্মক আকার ধারণ করে শুকনো মৌসুমে।

তিনি বলেন, পরিচ্ছন্নকর্মীদের যে অনিয়ম তা নতুন কিছু নয়। তাদের ব্যপারে সবচেয়ে বড় অভিযোগ তারা খুব তাড়াহুড়ো করে পথচারীদের দিকে লক্ষ্য না করেই ঝাড়ু দেয়। ফলে রাস্তা দিয়ে হাঁটা কষ্ট হয়ে যায় পথচারীদের। বিশেষ করে যারা হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, এলার্জি রোগী, তাদের জন্য প্রতিদিন এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করা খুব কঠিন। এজন্য সিটি কর্পোরেশনের উচিত পরিচ্ছন্নকর্মীদেরকে যথাসময়ে ঝাড়ু দেয়ার ব্যপারে জোরালোভাবে মনিটরিং করা। পাশাপাশি তাদের কিছু প্রশিক্ষণ দেওয়া খুব জরুরি যেন তারা শৃঙ্খলভাবে নগরীকে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতে পারে।

এ ব্যপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. হায়দার আলী আমার সংবাদকে বলেন, যেকোনো অনিয়মের ব্যপারে আমরা অভিযোগ পেলে সত্যতা যাচাই করে ব্যবস্থা নেব। এ ব্যাপারেও তদন্ত করে নির্দিষ্ট এরিয়ায় আমরা ব্যবস্থা নিবো। কিন্তু এমন অনিয়ম প্রায় সব জায়গায় করছে পরিচ্ছন্নকর্মীরা, সিটি কর্পোরেশন থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না এমন প্রশ্নে তিনি উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যান।

Link copied!