Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪,

ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান: ঋণেরও বেশি খেলাপি প্রবৃদ্ধি

রেদওয়ানুল হক

এপ্রিল ২৯, ২০২৩, ১১:৫১ পিএম


ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান: ঋণেরও বেশি খেলাপি প্রবৃদ্ধি
  • ঋণস্থিতি বেড়েছে তিন হাজার ৯৫ কোটি টাকা
  • খেলাপি ঋণ বেড়েছে তিন হাজার ৮০৪ কোটি টাকা
  • শতকরা হিসাবে খেলাপি বৃদ্ধির হার ২৯ শতাংশ

ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে (এনবিএফআই) খেলাপি ঋণ আশঙ্কজনক হারে বাড়ছে। গত এক বছরে ঋণস্থিতি প্রবৃদ্ধির পরিমাণকেও ছাড়িয়ে গেছে খেলাপি ঋণ। এমনিতেই আমানতকারীর অর্থ ঠিকমতো ফেরত দিতে না পারাসহ নানা কারণে খারাপ অবস্থায় রয়েছে বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। পিপলস লিজিংসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের খারাপ অবস্থা পুরো খাতে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করেছে। এসব সমস্যা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে তেমন কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। তবে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ক্ষমতাচর্চার মাধ্যমে মোটা অঙ্কের ঋণ বাগিয়ে নেয়ার ঘটনা কমতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৮২১ কোটি টাকায়। যা মোট ঋণের ২৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এ সময় পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট ঋণস্থিতি ৭০ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা। এক বছর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে মোট ৬৭ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে খেলাপি ছিল ১৩ হাজার ১৭ কোটি টাকা। যা ছিল মোট ঋণের ১৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়েছে তিন হাজার ৮০৪ কোটি টাকা বা ২৯ শতাংশ। আর ঋণস্থিতি বেড়ছে তিন হাজার ৯৫ কোটি টাকা। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এর তিন মাস আগে গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা। যা ছিল মোট ঋণের ২৪ দশমিক ৬১ শতাংশ। আলোচিত সময়ে ঋণস্থিতি ছিল ৭০ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা। এর মানে শেষ তিন মাসে ঋণ বেড়েছে মাত্র ১৯ কোটি টাকা। এ সময়ে খেলাপি ঋণ কমেছে ৫০৬ কোটি টাকা। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেষ তিন মাসে খেলাপি কমার কারণ হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ সুবিধা। এতে কাগজে কলমে পরিমাণ কমলেও ঋণ আদায় বাড়েনি; বরং খেলাপির তালিকা থেকে নাম মুছে পুণরায় মোটা অঙ্কের ঋণ বাগিয়ে নিতে তৎপর রয়েছে সুবিধাবাদি চক্র। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, তহবিল সংকটসহ নানা কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণ তেমন বাড়ছে না। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ কমার মূল কারণ গত বছরের শেষ সময়ের ঋণ আদায়ে নীতি শিথিলতা। গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়, অক্টোবর-ডিসেম্বর ত্রৈমাসিকে একজন ঋণগ্রহীতার যে পরিমাণ পরিশোধ করার কথা, কেউ ৫০ শতাংশ পরিশোধ করলে আর খেলাপি হবে না। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিয়মিত ঋণের ক্ষেত্রে এ সুবিধা দেয়া হয়। অবশ্য কেউ যথানিয়মে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে আবার খেলাপি হবে। এ শিথিলতার ফলে শেষ সময়ে কিছু ঋণ আদায় হওয়ায় ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকা খেলাপি ঋণ সামান্য কমেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোতেও খেলাপি বেড়েছে। বছর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা। যা মোট ঋণস্থিতির ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। একবছর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ তিন হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত বেশ আগে থেকেই খারাপ অবস্থায় পড়েছে। তবে আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে না পারাসহ বিভিন্ন কারণে ২০১৯ সালে পিপলস লিজিং অবসায়নের উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে প্রশান্ত কুমার হালদারের (পিকে হালদার) একসময়কার নিয়ন্ত্রণে থাকা আরও তিন প্রতিষ্ঠান তথা বিআইএফসি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস ফাইন্যান্সের নানা জালিয়াতির বিষয় সামনে আসে। তহবিল সংকট চলছে এসব প্রতিষ্ঠানে। জানা গেছে, জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ সরিয়ে নেয়ার প্রতিটি ঘটনার অন্তরালে ছিল ক্ষমতাচর্চা। দীর্ঘ সময় ধরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে চলে আসছে স্বৈরতন্ত্র। এসব প্রতিষ্ঠানে ঘুরেফিরে এক ব্যক্তির ঘনিষ্ট লোকজন পরিচালক হন। এভাবে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে একতরফা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এতে সহজেই লুটপাট চালায় একটি চক্র। অবৈধ সুবিধা নিয়ে মুখ বুজে থাকে নিযুক্ত পরিচালকরা। সম্প্রতি এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিনিধি পরিচালক নিয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে রাখার কৌশল ভেস্তে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে একটি কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের একজনের বেশি ব্যক্তি প্রতিনিধি পরিচালক হিসেবে থাকতে পারবেন না। থাকতে পারবেন না স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিও।

নাম প্রকাশ না করে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমার সংবাদকে বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতো ইতোপূর্বে যত অনিয়ম হয়েছে; তার প্রতিটিতে ক্ষমতা চর্চা প্রধান কারণ ছিল। এমন পরিস্থিতিতে এমডিদের করার কিছুই থাকে না। কিন্তু দিন শেষে দায়টা তাদের ওপরই বর্তায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা হবে। ফলে এ খাতের অনিয়ম অকেটাই কমে যাবে। জানা গেছে, আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনায় কারা আছেন এমন তথ্য চেয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ। একই সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশকে পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। এটি আইএমএফের দেয়া ঋণ সহায়তার শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম। এরপরই প্রস্তাবিত নতুন ব্যাংক আইনে একই পরিবারে ব্যাংক পরিচালকের সংখ্যা কমানো হয়েছে। নতুন আইনে এক পরিবার থেকে তিন জনের বেশি পরিচালক না থাকার বিধান রাখা হয়েছে। প্রচলিত আইনে এক পরিবার থেকে থাকতে পারছেন চার পরিচালক। এখন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও পরিচালক নিযুক্ত করণে কঠোরতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
 

Link copied!