Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

নোট খাতায় এজেন্ট ব্যাংকিং!

কোটি টাকা নিয়ে উধাও অগ্রণী ব্যাংকের এজেন্ট

রেদওয়ানুল হক

মে ১৭, ২০২৩, ০৭:৪৮ এএম


কোটি টাকা নিয়ে উধাও অগ্রণী ব্যাংকের এজেন্ট

গ্রাহকের টাকা ব্যাংক হিসাবে জমা না দিয়ে নোটখাতায় হিসাব রাখতেন অগ্রণী ব্যাংকের বগুড়া আড়োলা বাজার ইউনিট এজেন্ট মাসুদুর রহমান। আবার ফিঙ্গার জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকের অজান্তেই হিসাব থেকে টাকা তুলে নিতেন। টাকা জমার বিপরীতে দিতেন না কোনো রসিদ। কখনো দিতেন হাতে লেখা রসিদ আর গ্রাহককে মেসেজ দিতেন নিজ মোবাইল থেকে। এভাবে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেছেন এই ধুরন্ধর ব্যক্তি। এমন জালিয়াতির বিষয়টি জানতে পেরেও চুপ ছিল অগ্রণী ব্যাংকের মাস্টার এজেন্ট দুয়ার সার্ভিস লিমিটেড। ব্যাংক বা প্রশাসনকে না জানিয়ে বিষয়টি নিজেরাই ধামাচাপা দিতে চেয়েছে তারা। এ সুযোগে পালিয়ে যায় এজেন্ট মাসুদ। অসহায় গ্রাহক অভিযোগ করেছেন, স্থানীয় ব্রাঞ্চে, আবার কেউ থানায় অভিযোগ দিয়েছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, বগুড়া জেলার কাহালু থানাধীন অগ্রণী ব্যাংকের আড়োলা বাজার ইউনিটটি তালাবদ্ধ রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, ব্যাংকটির এজেন্ট মাসুদুর রহমান ডিপোজিট স্লিপ ও ফিঙ্গার জালিয়াতির মাধ্যমে অনেক গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়েছেন। উচ্চ সুদের প্রলোভন দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিতেন এই এজেন্ট। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হওয়ায় প্রতারণার বিষয়টি মাথায়ই আসেনি কারো। একজন গ্রাহক এজেন্টের কাছে টাকা জমা দিয়ে ব্রাঞ্চে গিয়ে দেখেন তার টাকা জমা হয়নি। এরপর বিষয়টি জানাজানি হলে ভুক্তভোগীরা ব্রাঞ্চে অভিযোগ করেন।

অগ্রণী ব্যাংকের বগুড়া সপ্তপদি শাখায় করা ছয়টি লিখিত অভিযোগের তথ্য দৈনিক আমার সংবাদের কাছে এসেছে। এর মধ্যে পাঁচ গ্রাহকের মোট ৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা ব্যাংক হিসাবে জমা না দিয়ে ভুয়া রসিদ দেয়া হয়েছে। রত্না খাতুন অভিযোগ করেন, গত ১৮ জানুয়ারি তার হিসাব নং ০২০০০১৯০৪২৮৬০-তে তিন লাখ টাকা জমা দিলেও তা জমা হয়নি। গ্রাহক আকবর কাজি (হিসাব নং ০২০০০১৭৯৩৯৫৫৯) এফডিআর বাবদ সাড়ে সাত লাখ টাকা জমা দিয়েছেন; কিন্তু তা জমা হয়নি। রকেন চন্দ্র অভিযোগ করেন, গত বছরের ২৪ আগস্ট এজেন্টের কাছে দুই লাখ টাকা জমা দিলেও তার হিসাবে (নং ০২০০০১৯০৩৬৭৯৭) জমা হয়নি। মলিনা রানী এক লাখ টাকা জমা দিয়েছেন গত বছরের ১৩ জুন; কিন্তু তার হিসাবে (নং ০২০০০১৬৭২৯৭৭৫) জমা হয়নি। ধলী বালার ০২০০০১৬৭৭৫৩১২ নং হিসাবে ৪ এপ্রিল, ২০২১ তারিখে ৫০ হাজার এবং ২৭ এপ্রিল, ২০২২ তারিখে ২৫ হাজার টাকা জমা দিলেও তা জমা হয়নি। অর্থাৎ দুই বছর যাবৎ চলছিল এমন প্রতারণা। অন্য একটি অভিযোগে দেখা যায়, মোছা. মহিদা বেগমের হিসাব নং ০২০০০১৫৭৩৫১৭৭ থেকে গত ৩১ জানুয়ারি দুই লাখ টাকা এবং পরে আরও ৫০ হাজার টাকা ফিঙ্গার জালিয়াতির মাধ্যমে তুলে নেয় এজেন্ট। কিন্তু তিনি এর কিছুই জানতেন না। এছাড়া মৌখিকভাবে অভিযোগ করেছেন অনেক ভুক্তভোগী। ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, আত্মসাৎকৃত অর্থের পরািমাণ কোটি টাকারও বেশি।

স্থানীয় বাসিন্দা বেলাল হোসেন জানান, সাধারণত ব্যাংকের এজেন্ট স্থানীয় লোকজনই নেন। কিন্তু দুয়ার সার্ভিস লিমিটেড মাসুদুর রহমান নামের এই ব্যক্তিকে এজেন্ট নিয়োগ করেছে, তার বাড়ি এজেন্ট পয়েন্ট থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে। ওই ব্যক্তি দুয়ারের সঙ্গে সখ্যের সুযোগ নিয়ে দীর্ঘদিন প্রতারণা করে আসছিলেন। গ্রামের নিরক্ষর মানুষ, বিশেষ করে নারীদের টার্গেট করে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেয়া হতো। এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের বগুরা সপ্তপদী শাখার ব্যবস্থাপক মাহফুজ দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, ‘কয়েকজন গ্রাহক আমাদের কাছে অভিযোগ করেছেন। তখন আমরা বিষয়টি তদন্ত করে সত্যতা পাই। এরপর বিষয়টি প্রধান কার্যালয়কে অবহিত করেছি।’ বিষয়টি আমলে নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুরশেদুল কবীর। আমার সংবাদকে তিনি বলেন, ‘স্পেশাল টিম পাঠিয়ে বিষয়টি তদন্ত করা হবে। যাদের গাফিলতি পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ বিষয়টি নিয়ে আমার সংবাদের সঙ্গে কথা বলেন দুয়ার সার্ভিস লিমিটেডের কমপ্ল্লায়েন্স বিভাগের প্রধান গাফফার খান। তিনি জানান, বিষয়টি জানার পরই এজেন্টকে চাপ দিয়ে টাকা উত্তোলনের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু একজন গ্রাহক থানায় অভিযোগ দিলে ভয়ে পালিয়ে যায় এজেন্ট। দুয়ারের অন্য একটি এজেন্ট পয়েন্টে ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করার সুবাদে মাসুদুর রহমানকেও এজেন্ট নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। তবে যাবতীয় শর্ত পূরণ করেই তিনি এজেন্ট হয়েছিলেন। নিয়মিত ফিল্ড অফিসারের তত্ত্বাবধান সত্ত্বেও প্রতারণার বিষয়টি ধরা পড়েনি দাবি করে তিনি বলেন, গ্রাহক ও এজেন্টের লোভের কারণেই এমন ঘটনা ঘটেছে। আলাদা খাতায় হিসাব রাখায় এটি বোঝা যায়নি। আমাদের সিস্টেমের মধ্যে জালিয়াতির কোনো সুযোগ ছিল না। কোনো গ্রাহকও ফিল্ড অফিসারের কাছে অভিযোগ দেয়নি। বরং কেউ কেউ টাকা রেখে উচ্চ সুদ নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন।

জানা গেছে, অন্য ব্যাংকগুলো তাদের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে এজেন্ট নিয়োগ করে। কিছু ব্যাংক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানকে মাস্টার এজেন্ট নিয়োগ দিলেও এককভাবে কাউকে দেয়নি। শুধুমাত্র অগ্রণী ব্যাংক দুয়ার সার্ভিস লিমিটেড নামের থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠানকে এককভাবে মাস্টার এজেন্ট নিয়োগ করেছে। দুয়ারের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কামরুজ্জামান অগ্রণী ব্যাংকে উপমহাব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সে সুবাদে ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস-উল ইসলামকে হাত করে এককভাবে মাস্টার এজেন্ট নেন তিনি। দুয়ারের অধীনে বর্তমানে ছয় শতাধিক এজেন্ট রয়েছে। তাই ব্যাংকটির সামগ্রিক পারফরম্যান্সে নির্ভরতা তৈরি হচ্ছে দুয়ারের ওপরে। কারণ নতুন হিসাব খোলা, টাকা জমা ও উত্তোলন, ক্লিয়ারিং চেক গ্রহণ, ঋণের আবেদন গ্রহণ, বিতরণ ও কিস্তি সংগ্রহ, রেমিট্যান্স বিতরণ, বিদ্যুৎ বিল জমা, ভাতা বিতরণসহ যে কোনো ব্যাংকের হিসাবে টাকা পাঠানোর কাজ করা যাচ্ছে এসব এজেন্ট পয়েন্টে। বিশেষ করে আমানত সংগ্রহের জন্য দুয়ারের নির্ভরতা তৈরি হচ্ছে অগ্রণী ব্যাংকের। এককভাবে দুয়ারকে মাস্টার এজেন্ট নিয়োগ করার বিষয়ে মুরশেদুল কবীর বলেন, ‘প্রতিটি বিষয়েরই ভালো ও খারাপ দিক থাকে। সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই তৎকালীন ম্যানেজমেন্ট দুয়ারের সঙ্গে চুক্তি করেছিল। এখন যেহেতু বিষয়টি নিয়ে কথা উঠেছে, তাই বোর্ডে এটি নিয়ে আলোচনা হবে। সবার মতামতের ভিত্তিতে যেটি ভালো হয়, সে মোতাবেক সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে বাংলাদেশে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের উদ্ভাবক হিসেবে পরিচিত ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী আমার সংবাদকে বলেন, ‘এ ঘটনার দায় দুয়ারের। কারণ তারা যাকে এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে, তার কার্যক্রম দেখা এবং গ্রাহকের সচেতনতা ও অর্থের নিরাপত্তা বিধান  তাদেরই দায়িত্ব। একইসঙ্গে অগ্রণী ব্যাংককেও দায় নিতে হবে। কারণ, উভয় পক্ষেরই যে কাজটি করা উচিত ছিল, তা হলো— অডিট, মনিটরিং ও কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা। তবে এক্ষেত্রে গ্রাহকের সতর্কতাও জরুরি। কারণ টাকা জমা দেয়ার পর রসিদ গ্রহণ করা, মোবাইলের মেসেজ চেক করে দেখা উচিত ছিল। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, কেউ বিশ্বস্ততার সুযোগ নেয়; আবার কেউ অধিক মুনাফার লোভে পড়ে। কারণ এখন ব্যাংক ইন্টারেস্ট রেট কম; প্রতারকরা সেটিই কাজে লাগায়।’ তৃতীয় পক্ষকে মাস্টার এজেন্ট নিয়োগ করার বিষয়ে তিনি বলেন, এ সিস্টেম অনেক দেশেই আছে। তবে এসব ক্ষেত্রে ব্যাংক মাস্টার এজেন্টের পারফরম্যান্সের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক আমার সংবাদকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুসরণ করে সবাইকে এজেন্ট ব্যাংকিং পরিচালনা করতে হবে। অগ্রণী ব্যাংক যদি মাস্টার এজেন্টের মাধ্যমে সাব-এজেন্ট দেয়; আর সেখানে যদি গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে এর দায়ভার অগ্রণী ব্যাংককে নিতে হবে এবং নীতিমালা অনুযায়ী গ্রাহকের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কারণ, এজেন্ট নিয়োগের সময় ব্যাংক জামানত নিয়েছে। এখন গ্রাহকের অর্থের সুরক্ষা দেয়াও ব্যাংকের দায়িত্ব। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে এজেন্ট নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, নীতিমালার অনুসরণ করেই অগ্রণী ব্যাংক এই মডেল নিয়ে কাজ করছে। তবে এখন যদি ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা অভিযোগ করেন, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি খতিয়ে দেখবে।

Link copied!