Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

বাড়লে আর কমে না

মো. মাসুম বিল্লাহ

মে ২৩, ২০২৩, ১০:০০ এএম


বাড়লে আর কমে না
  • জুটছে না আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যহ্রাসের সুফল 
  • আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মূল্যসমন্বয়ের টোপ

নানা ধরনের স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও গোষ্ঠীস্বার্থের কারণে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরাও ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করছেন না 

তেল-গ্যাসের মতো সরকার নিয়ন্ত্রিত খাতেও জনগণ আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যহ্রাসের সুবিধা পাচ্ছে না 

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিত না করলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও জ্বালানি বিক্রিতে ‘মূল্য সমন্বয়’-এর নামে বন্ধ হবে না জনগণের পকেট কাটা 

পরিবহন খরচ, আমদানি শুল্ক এবং অন্যান্য বাণিজ্য সম্পর্কিত খরচ বিবেচনার পরও দামের উচ্চ পার্থক্যকে ‘অস্বাভাবিক’ বলছে সিপিডি

আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেল, পাম তেল, চিনি, আটা তৈরির গম, পেঁয়াজ, মসুর ডাল, ছোলা ও মটর ডাল— আটটি পণ্যের দাম রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর সময়কার তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে কমলেও দেশের বাজারে এখন পর্যন্ত কমেনি চার আনাও। পেঁয়াজ কিংবা সয়াবিন তেলের দাম বিশ্ববাজারে কমলেও দেশে উল্টো বেড়েছে। বিশ্ববাজারে চিনির দাম যা বেড়েছে, তার দ্বিগুণ বেড়েছে দেশে। ডালের দাম বিশ্ববাজারে যে হারে কমেছে, দেশে সে হারে কমেনি এখনো। এরপরও নানা ধরনের স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও গোষ্ঠীস্বার্থের কারণে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফা নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে মূল্যহ্রাসের বিষয়ে কোনো কার্যকর উদ্যোগই গ্রহণ করছে না। এমনকি তেল-গ্যাসের মতো যেসব খাত সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, সেসব খাতেও জনগণকে দেয়া হচ্ছে না আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যহ্রাসের সুবিধা। যে কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো পণ্যের মূল্যহ্রাসের সুফলই জুটছে না দেশের মানুষের ভাগ্যে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে না পারলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও জ্বালানি বিক্রির ক্ষেত্রে ‘মূল্য সমন্বয়’-এর নামে জনগণের পকেট কাটা বন্ধ হবে না।

বাজারের তথ্যানুযায়ী, গত এক বছরের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম কমেছে যথাক্রমে ৪৪ শতাংশ ও ৫২ শতাংশ; কিন্তু দেশের বাজারে সম্প্রতি উল্টো লিটারপ্রতি সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে যথাক্রমে ১২ টাকা ও ১৮ টাকা। অথচ ২০ শতাংশ শুল্কসহ প্রতিটন সয়াবিন তেলের আমদানি মূল্য এক লাখ ৩৮ হাজার ৭৫০ টাকার সঙ্গে উৎপাদন পর্যায়ের ১৫ শতাংশ ভ্যাট, উৎপাদন খরচ, মোড়কজাতকরণ, অপচয় (প্রসেস লস), মুনাফা ও ডিলার কমিশন মিলিয়ে আরও ১৫ শতাংশ যুক্ত করে রক্ষণশীল হিসাবেও খুচরা পর্যায়ে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৮৩ টাকা ৫০ পয়সার বেশি হওয়ার কথা নয়। যদিও ট্যারিফ কমিশনের অনুমোদন নিয়ে বাজারে খুচরা পর্যায়ে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৯৯ টাকায়। সম্প্রতি সরকার কর্তৃক ভারত থেকে প্রতি লিটার ১৪৬ টাকা ১০ পয়সা দরে ১১ হাজার টন সয়াবিন তেল ও সিঙ্গাপুর থেকে ৮২ টাকা ৯৪ পয়সা কেজিতে সাড়ে ১২ হাজার টন চিনি আমদানি করা হয়। প্রশ্ন উঠেছে, সরকার যদি বিদেশ থেকে ১৪৬ টাকা লিটার দরে সয়াবিন ও ৮৩ টাকা কেজি দরে চিনি আমদানি করতে পারে, তাহলে কার স্বার্থে দেশের ব্যবসায়ীদের দেশের মানুষের কাছে ১৯৯ টাকা লিটার দরে তেল এবং ১৪০ টাকা কেজি দরে চিনি বিক্রি করতে দেয়া হচ্ছে! এ নিয়ে বিভিন্ন মহলের ভাষ্য, তেলের মতো চিনির বাজারেও সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দেশের সাধারণ মানুষকে ভারতীয়দের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি দামে চিনি কিনতে হচ্ছে। দেখা গেছে, সরকার যখন ব্যবসায়ীদের কথামতো চিনির দাম কেজিপ্রতি ১২০ টাকা ঘোষণা করে, তার আগে থেকেই দেশের বাজারে চিনি ১৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছিল। অভিযোগ রয়েছে, কৃত্রিম সংকট তৈরি করে চিনির এই অস্বাভাবিক দাম বাড়ানো হয়েছে। চিনি সংকটের পেছনে বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম বাড়ানোর কথা বলা হলেও কার্যত এর কারণ বেসরকারি আমদানিকারকদের ওপর একক নির্ভরশীলতা। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে দেশে চিনির চাহিদা ১৮ থেকে ২০ লাখ টন। রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো একসময় বছরে দেড় থেকে দুই লাখ টন চিনি উৎপাদন করত, যা বাজার নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করত। কিন্তু গত দুবছরে ১৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলের মধ্যে ছয়টির উৎপাদন বন্ধ রাখায় দেশীয় উৎপাদন কমে ২১ হাজার টনে নেমে এসেছে। এতে দেশের চিনি খাত প্রায় শতভাগ আমদানিভিত্তিক বেসরকারি কলগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এ কারণেই চিনির বাজারের ওপর সরকারের কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই— বলছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানিনির্ভরতা কমানোর কথা বলা হচ্ছে। অথচ যে খাতের বিকাশ হলে আমদানিনির্ভরতা হ্রাস করে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা যেত, সেই রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পই ধুঁকছে নিদারুণ অবহেলায়। যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হলে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো চাহিদার উল্লেখযোগ্য অংশ সরবরাহ করতে পারত, সে সঙ্গে হাজারো আখচাষি ও শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হতো। 
সম্প্রতি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) দেশের চারটি খাদ্যসামগ্রীর অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক মূল্যের পার্থক্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের দাম কমে না। উল্টো এও দেখা যায়, বেশকিছু প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর দাম আন্তর্জাতিক দামের তুলনায় ধারাবাহিকভাবে বেশি থাকছে। সিপিডি যে চারটি খাদ্যপণ্য নিয়ে গবেষণা করে, তার মধ্যে চাল ও গরুর মাংস অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত হয়, আর সয়াবিন তেল ও চিনি আমদানি করা হয় এবং দেশে এ চার সামগ্রীর দামই আন্তর্জাতিক মূল্যের তুলনায় ধারাবাহিকভাবে বেশি থাকছে। ইরি-বোরো, পাইজাম, নাজিরশাইল-মিনিকেট— এ ধরনের চালের দামই সমমানের থাই ও ভিয়েতনামি চালের দামের চেয়ে ধারাবাহিকভাবে বেশি। নভেম্বর ২০২২ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমলেও একই সময়ে স্থানীয় বাজারে দাম কমেনি। জুলাই থেকে ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত গরুর মাংসের আন্তর্জাতিক মূল্য হ্রাস পেলেও দেশে গরুর মাংসের দাম একই সময়ে বেড়েছে। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম বিশ্ববাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দামের চেয়ে ২২৫ টাকা বেশি ছিল। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে চিনির দাম দেশে প্রতি কেজি ছিল ১২২ টাকা; কিন্তু মার্কিন বাজারে প্রতি কেজি মাত্র ৮০ টাকা। বিশ্ববাজারে প্রতি কেজি ৪৪ টাকা এবং ইউরোপীয় বাজারে ছিল প্রতি কেজি ৩৫ টাকা। পরিবহন খরচ, আমদানি শুল্ক এবং অন্যান্য বাণিজ্য সম্পর্কিত খরচ বিবেচনা করার পরও দামের এ ধরনের উচ্চ পার্থক্যকে সিপিডি ‘অস্বাভাবিক’ বলে উল্লেখ করেছে।

দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের এই অস্বাভাবিক মূল্যের পেছনে একদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকারের ভুলনীতি এবং বারবার মূল্যবৃদ্ধি, অন্যদিকে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বাজারে অল্পকিছু কোম্পানির একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও সরকারের তদারকির অভাবকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিদেশ থেকে কাঁচা চিনি আমদানি করে পরিশোধন করে দেশে বিক্রি করে মাত্র পাঁচটি কোম্পানি। এসব প্রতিষ্ঠানই দেশের প্রধান চিনি সরবরাহকারী। দেশে ভোজ্যতেলের ৮৮ শতাংশই আমদানি করে চারটি কোম্পানি। দেশে পোলট্রি খাদ্য ও মুরগির বাচ্চার সিংহভাগ উৎপাদন করে অল্প কয়েকটি কোম্পানি, সে সঙ্গে ডিম ও মাংসের বাজারেরও বড় একটি অংশ তাদের দখলে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ধান-চালের বাজারে সবচেয়ে প্রভাবশালী পক্ষ হিসেবে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করছেন চালকল মালিকরা। কৃষক, ফড়িয়া, আড়তদার, চালকল মালিক ও চালের খুচরা বিক্রেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এবং অস্বাভাবিক মুনাফা করেন চালকল মালিকরা। তারা প্রতি কেজি চাল ও এর উপজাত বিক্রি করে আট থেকে ১৩ টাকা ৬৬ পয়সা পর্যন্ত মুনাফা করছেন।
এভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্যসামগ্রীর ওপর কতিপয় বৃহৎ গ্রুপ অব কোম্পানি ও মিল মালিকদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কারণে তারা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানান পরিস্থিতির অজুহাতে ইচ্ছামতো পণ্য আমদানি, উৎপাদনের পরিমাণ এবং এসবের মূল্য হ্রাস-বৃদ্ধি করতে পারে বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদারের কথাতেও পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেটের বিষয়টি উঠে এসেছে। অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) ও এসএমই ফাউন্ডেশন আয়োজিত এক কর্মশালায় তিনি বলেছেন, অর্থনীতি ও বাজার— এই দুই জায়গাতেই সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে, যে কারণে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ঝরে পড়ছেন এবং পণ্যের মূল্য বেড়ে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। মানুষ বাজার করতে গিয়ে এখন কাঁদছে। 

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের নিত্যপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেটের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। একদল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন উপলক্ষে বিভিন্ন সময় চাল, তেল, চিনি, মুরগি, পেঁয়াজ ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে। নানা ধরনের স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও গোষ্ঠীস্বার্থের কারণে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফা নিয়ন্ত্রণে কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করছেন না। এ সুযোগে জ্বালানি তেলেও মূল্যহ্রাস করা হয়নি আদৌ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়াকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে গত বছরের আগস্টে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম একলাফে ৪২ দশমিক পাঁচ শতাংশ থেকে ৫১ দশমিক পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয় সরকার। ওই সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বৈশ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকটা নিরুপায় হয়েই দাম ‘সমন্বয়’ করতে হয়েছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সে অনুযায়ী জ্বালানি তেলের দাম পুনর্বিবেচনা করা হবে। একবারে জ্বালানি তেলের নজিরবিহীন এমন মূল্যবৃদ্ধির কারণে পরিবহন খরচ বেড়েছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। এ কারণে সার্বিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে সাধারণ মানুষের জীবন আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়ে গেলেও ২০২২ সালের শেষদিকে এসে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলারের নিচে নেমে আসে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ৭৫ ডলারের নিচে নেমে এসেছে। অনেক দিন ধরেই তেলের দাম ৭০ থেকে ৮০ ডলারের মধ্যে ঘোরাফেরা করলেও সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দেশের বাজারে দাম কমানোর কোনো উদ্যোগই দেখা যাচ্ছে না।
 

Link copied!