Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪,

ধুঁকছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান

রেদওয়ানুল হক

জুন ৬, ২০২৩, ০৭:৪০ এএম


ধুঁকছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান
  • ঋণের ২৪ শতাংশই খেলাপি; মন্দঋণ খেলাপির ৭৯ শতাংশ
  • আট প্রতিষ্ঠানের প্রভিশন ঘাটতি এক হাজার ১৭৯ কোটি টাকা
     

ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের চিত্র
খেলাপির হার                 সংখ্যা
১-১০ শতাংশ                  ১২টি
১০-২৫ শতাংশ                 ৭টি
২৫-৫০ শতাংশ                 ৭টি
৫০-৯৯ শতাংশ                ৯টি

ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় খেলাপি ঋণ বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত হারে। খেলাপির কারণে প্রভিশন খাতে আটকে গেছে বিপুল অঙ্কের টাকা। এ টাকা থেকে কোনো আয় হচ্ছে না। বেড়ে গেছে অকার্যকর ঋণ। এতে একদিকে আয় কমেছে, অন্যদিকে বেড়েছে ব্যয়। খেলাপি ঋণ আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার প্রধান কারণ ঋণ জালিয়াতি। এ খাতের ৩৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৩টির অবস্থাই নাজুক। বিশেষত ৯টি প্রতিষ্ঠানের বড় অঙ্কের ঋণ জালিয়াতির কারণে সার্বিকভাবে পুরো খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট ঋণস্থিতি ৭০ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১৬ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। হিসাব অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের এই অঙ্ক বিতরণকৃত মোট ঋণের ২৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ। যা এ যাবৎকালের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এক বছর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) খেলাপি ঋণ ছিল ১৩ হাজার ১৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে তিন হাজার ৮০৪ কোটি টাকা। তবে এর তিন মাস আগে গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। এ অঙ্ক ছিল ইতিহাসের সর্বোচ্চ। আলোচিত সময়ে ঋণস্থিতি ছিল ৭০ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা। এর মানে বছরের শেষ তিন মাসে ঋণ বেড়েছে মাত্র ১৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণের সক্ষমতা নেই। সংশ্লিষ্টরা জানান, বছরের শেষ প্রান্তিকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো খেলাপি ঋণ কম দেখাতে বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। ফলে ডিসেম্বর প্রান্তিকে দুই খাতেই খেলাপি কিছুটা কমেছে। আর এটি কমাতে বিপুল ঋণ পুনঃতফসিল, অবলোপন ও সুদ মওকুফ করেছিল প্রতিষ্ঠানগুলো।  
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতি-জালিয়াতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আমানতকারীরা। এসব প্রতিষ্ঠান আমানত ফেরত দিতে না পারায় গ্রাহকদের আস্থা হারাচ্ছে। ঋণ গ্রহীতারাও চাহিদামতো ঋণ বা লিজ না পেয়ে ব্যবসা গুটিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে সব মিলে অর্থনীতিতে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের অবদান কমে যাচ্ছে। এটি দেশের অর্থনীতির জন্য একটি অশনিসংকেত।

তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দেশে কার্যরত ৩৫টি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৩টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে ১০ থেকে ২৫ শতাংশ খেলাপি ঋণ রয়েছে সাতটি প্রতিষ্ঠানে। ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ খেলাপি ঋণ আছে আরও সাতটিতে। বাকি ৯টি প্রতিষ্ঠান খুবই খারাপ অবস্থানে রয়েছে। এদের খেলাপি ঋণের হার বিতরণকৃত ঋণের ৫০ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি পিপলস লিজিংয়ের; খেলাপির হার ৯৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এর পরেই আছে বিআইএফসি; এটির খেলাপির হার ৯৬ দশমিক ২৭ শতাংশ। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ফারইস্ট ফাইন্যান্স। প্রতিষ্ঠানটির খেলাপির হার ৯৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এ ছাড়া এফএএস ফাইন্যান্সের ৯০ দশমিক ৪০ শতাংশ, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ৮৭ দশমিক ৩২ শতাংশ, ফার্স্ট ফাইন্যান্সের ৮৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ, ইউনিয়ন ক্যাপিটালের ৫২ দশমিক ৯০ শতাংশ, প্রিমিয়ার লিজিংয়ের ৫২ দশমিক ৮৭ শতাংশ এবং উত্তরা ফাইন্যান্সের খেলাপির পরিমাণ ৫০ দশমিক ৪০ শতাংশ। এ ৯টি প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১১ হাজার ৪০ কোটি টাকা।

অন্যদিকে এ খাতের আটটি প্রতিষ্ঠানের প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে এক হাজার ১৭৯ কোটি টাকা। তবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত প্রভিশন সংরক্ষণ করায় পুরো খাতের সমন্বিত প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৫৩ কোটি টাকা। বাস্তবতা হলো নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে চলে। বর্তমানে দেশে ৩৫টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম পরিচালনা করলেও জানা গেছে, এর মধ্যে গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের আস্থা অটুট রাখতে সক্ষম হয়েছে। বাকিদের অবস্থা কেন নড়বড়ে হলো, তা নিবিড়ভাবে পরিদর্শন ও পর্যালোচনা করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন খাত সংশ্লিষ্টরা। একইসঙ্গে গ্রাহকদের আমানত ফেরত দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা উচিত। তারা বলছেন, মানুষ সঞ্চয় করে মূলত লাভের আশায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, প্রত্যাশিত লাভ তো দূরের কথা, আমানতকারীদের আসলের ঘরেই টান পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে সরকার অনুমোদিত এসব নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে; একইসঙ্গে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি হবে ক্ষতিগ্রস্ত।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি অর্থনীতির এক দুষ্ট ক্ষত। এ ঋণের বড় অংশই ইচ্ছাকৃত। চিন্তার বিষয় হলো, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের টাকা আদায়ে আইনি সহায়তা পাওয়া যায় না। তাই অধিকতর যাচাই-বাছাই করে ঋণ দেয়া উচিত বলে মত দিচ্ছেন তারা। সেই সঙ্গে খেলাপি ঋণ আদায়ে আরও বেশি কঠোর হওয়া প্রয়োজন। নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরাতে হলে এসব প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ও জালিয়াতি রোধ করে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার তাগিদ সংশ্লিষ্টদের।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সম্প্রতি যে নীতিমালাগুলো হচ্ছে তা ঋণখেলাপিদের আরও উৎসাহিত করছে। অন্যদিকে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন ভালো গ্রাহক। তারা মনে করছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছাড় তো পাবই। এছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলোও খেলাপি ঋণ আদায়ে বিমুখ হয়ে পড়েছে। কারণ এর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তাদের জবাবদিহিতা করতে হয় না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দীর্ঘস্থায়ী নীতি গ্রহণ করতে হবে। যাতে খেলাপি ঋণ, পুনঃতফসিল, প্রভিশন ঘাটতি কমে আসে। এসব সমস্যা সমাধানে একটি কমিশন গঠন করা উচিত। এর আগেও খেলাপি সমস্যার সমাধান হয়েছে কমিশনের মাধ্যমে।
 

Link copied!