Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

সহসাই কাটছে না ডলার সংকট

রেদওয়ানুল হক

জুন ৯, ২০২৩, ১২:০২ এএম


সহসাই কাটছে না ডলার সংকট

১০ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি এক লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা

  • চলতি হিসাবে ঘাটতি ৩৭৭ কোটি ডলার
  •  সামগ্রিক লেনদেনে ঘাটতি ৮৮০ কোটি ডলার

ডলারের দামে লুটপাট চালাচ্ছে ব্যাংক

—সভাপতি, এফবিসিসিআই

প্রমাণ থাকলে গভর্নরকে দেয়া উচিত

—চেয়ারম্যান, এবিবি

দেশে চলমান ডলার সংকট শিগগিরই কাটছে না। কারণ নানা বিধিনিষেধের পরও পণ্য আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয়ে বড় পার্থক্যের কারণে বাণিজ্য ঘাটতি ক্রমাগত বাড়ছে। আসছে না কাঙ্ক্ষিত রেমিট্যান্সও। ফলস্বরূপ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিন দিন কমে যাচ্ছে। সংকটের সুযোগে সক্রিয় কারসাজি চক্র। এতে খরচ বাড়ছে পণ্য আমদানিতে। ফলে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। বিপুল বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হলে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।

গতকাল প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেনে ব্যালান্স অব পেমেন্টের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) দেশের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৫৭৩ কোটি ডলার। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি এক ডলার ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা ধরে) এর পরিমাণ এক লাখ ৭০ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। প্রতিবেদন অনুসারে, চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) দেশ পাঁচ হাজার ৮৭৮ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে ছয় হাজার ৮৬৭ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল। সে হিসাবে গত বছরের একই সময়ের (প্রথম ১০ মাস) চেয়ে ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ কম আমদানি হয়েছে। কিন্তু আমদানির বকেয়া দায় পরিশোধ করতে হচ্ছে, তাই ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। অর্থবছরের একই সময়ে দেশ থেকে রপ্তানি হয়েছে চার হাজার ৩০৫ কোটি ডলারের পণ্য। যা এর আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ শতাংশ বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে চার হাজার ৯৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ১০ মাসে গড় আমদানি ব্যয় ৫৮৭ কোটি ডলার। এর বিপরীতে গড়ে রপ্তানি আয় এসেছে মাত্র ৪৩০ কোটি ডলার। 

অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে ১৫৭ কোটি বা দেড় বিলিয়ন ডলার ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশি মুদ্রার সংকট কাটাতে নানা শর্ত দেয়া হয়েছে আমদানিতে। এতে করে এলসির হার কমলেও আমদানি দায় পরিশোধ কমেনি। এখনো রপ্তানি আয়ের তুলনায় আমদানিতে বেশি খরচ করতে হচ্ছে। প্রবাসী আয়ও দিন দিন কমছে। উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণের ছাড় আশানুরূপ নয়। একই সময়ে প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়ার পরিবর্তে উল্টো কমছে বিদেশি বিনিয়োগ। যার কারণে বাণিজ্য ঘাটতি ও চলতি হিসাবের ঘাটতির পাশাপাশি সামগ্রিক বৈদেশিক লেনদেনেরও বিশাল ঘাটতি তৈরি হয়েছে। প্রতিবেদন বলছে, এপ্রিল শেষে অর্থবছরের ১০ মাসে সেবা খাত থেকে দেশের আয় হয়েছে ৭০৬ কোটি ডলার। একই সময়ে সেবা খাতে ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৩০ কোটি ডলার। আলোচিত সময়ে সেবা খাতে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩২৩ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩১১ কোটি ডলার। অর্থাৎ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় সেবা খাতে ঘাটতি বেড়েছে ১২ কোটি ডলার বা ৪ শতাংশ।

অন্যদিকে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকা মানে নিয়মিত লেনদেনে কোনো ঋণ করতে হয় না দেশকে। আর ঘাটতি থাকলে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। সে হিসাবে উন্নয়নশীল দেশের জন্য চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকা ভালো। তবে আমাদের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স এখন ঋণাত্মক। তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে চলতি হিসাবে ঘাটতি হয়েছে ৩৭৭ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল এক হাজার ৫৪৮ কোটি ডলার। সে হিসাবে ঘাটতি অনেকটা কমেছে। তবে আলোচিত সময়ে দেশ সামগ্রিক লেনদেনেও বড় ঘাটতিতে পড়েছে। এপ্রিল শেষে সামগ্রিক লেনদেনের (ঋণাত্মক) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৮০ কোটি ডলার। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে (ঋণাত্মক) ছিল ৫২৯ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক্ষেত্রে ঘাটতির পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে এক হাজার ৭৭২ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। আগের বছর পাঠিয়েছিলেন এক হাজার ৭৩১ কোটি ডলার। প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ। কিন্তু গত ১০ মাসে যত সংখ্যক কর্মী প্রবাসে গেছে; সে তুলনায় রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তবে চলতি অর্থবছরের এ সময়ে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই বেড়েছে। আলোচিত ১০ মাসে এফডিআই এসেছে ৪২০ কোটি ডলার, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ছিল ৩৯০ কোটি ডলার। সে হিসাবে গত অর্থবছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে প্রায় ৮ শতাংশ। 

তবে আলোচিত সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগ আগের বছরের চেয়ে ১২ শতাংশ কমে গেছে। বিভিন্ন খাতে সরাসরি মোট যে বিদেশি বিনিয়োগ আসে তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ নিয়ে যাওয়ার পর যেটা অবশিষ্ট থাকে সেটাকে নিট এফডিআই বলা হয়। এপ্রিল শেষে নিট এফডিআই দাঁড়িয়েছে ১৪৯ কোটি ডলারে। গত অর্থবছর একই সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ১৭০ কোটি ডলার। আলোচিত সময়ে দেশের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ (পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট) নেতিবাচক অবস্থা অব্যাহত আছে। অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ (নিট) যা এসেছিল তার চেয়ে তিন কোটি আট লাখ ডলার চলে গেছে। আগের অর্থবছরে এটি আরও নেতিবাচক ছিল। আলোচিত সময়ে শেয়ারবাজারে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ছিল (ঋণাত্মক) ১২ কোটি ডলার। সংকটের কারণে নানা পদক্ষেপের পরও ডলার বাজারের অস্থিরতা ঠেকানো যাচ্ছে না। আন্তঃব্যাংকের পাশাপাশি খোলাবাজারেও ছুটছে ডলারের দাম। সুযোগ বুঝে কারসাজির আশ্রয় নিচ্ছেন অনেকে। ক্রেতাদের কাছে বেশি দামে ডলার বিক্রি করে দেখানো হচ্ছে কম দাম। রাজধানীর বেশিরভাগ মানি এক্সচেঞ্জে ১১২ টাকা ২০ পয়সা থেকে ১১২ টাকা ৫০ পয়সায় ডলার বিক্রি হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পাঠানো তথ্যে তারা দেখাচ্ছে ১০৮ টাকা থেকে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। ডলারের বর্ধিত দামের কারণে বেড়ে যাচ্ছে আমদানি ব্যয়। যার প্রভাবে পণ্যমূল্যে বেড়ে মূল্যস্ফীতির পারদও চড়ছে।

ডলার বাজার স্থিতিশীল রাখতে এবিবি ও বাফেদা কয়েক দফা রেমিট্যান্স ও রপ্তানিতে ডলারের দাম বাড়িয়েছে। সবশেষ গত ৩১ মে আবারও দাম বাড়ানোর হয়, যা ১ জুন থেকে কার্যকর হয়েছে। ঘোষণা অনুযায়ী, এখন রপ্তানিকারকরা প্রতি ডলারের দাম পাচ্ছেন ১০৭ টাকা, আগে যা ছিল ১০৬ টাকা। আর প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম নির্ধারণ করা হয় ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা। আগে এ দাম ছিল ১০৮ টাকা। নতুন সিদ্ধান্তের ফলে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ডলারের দাম পড়বে সর্বোচ্চ ১০৮-১০৯ টাকা। সংকটের কথা বলে ডলারের নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি নেয়ার অভিযোগ করে আসছেন ব্যবসায়ীরা। এবার সেই অভিযোগে ঘি ঢেলেছেন ব্যবসায়ী ও শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। গত মঙ্গলবার ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘সরকারের বেঁধে দেয়া ডলারের বিনিময় হার কোনো কাজ করছে না। ব্যাংকগুলো লুটের মালের মতো করে ডলারের দাম নিচ্ছে। আমদানি বিল পরিশোধের সময় এক ডলারের বিপরীতে প্রায় ১১৫ টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। যার কাছ থেকে যা ইচ্ছা আদায় করছে ব্যাংকগুলো।’ 

তবে তার এমন বক্তব্যের সাথে একমত নন ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ লিমিটেডের (এবিবি) চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন। জানতে চাইলে আমার সংবাদকে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় ওনার কথাবার্তায় যদি কোনো সত্যতা থাকে তাহলে গভর্নরের সাথে আলাপ করুক। বলুক কোন ব্যাংক কাকে বেশি চার্জ করছে। এটা বলতে কি অসুবিধা?’ তিনি বলেন, এমন স্টেটমেন্ট না দিয়ে প্রমাণ দেখাক। উনি তো এগুলো ভালোই বোঝেন, আমার মনে হয় এ রকম মন্তব্য না করে সরাসরি প্রমাণ নিয়ে নিয়ন্ত্রকের কাছে যাওয়া উচিত।

Link copied!