জুন ২১, ২০২৩, ১২:২০ এএম
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সীমা মানছে না এনআরবি ব্যাংক একক গ্রাহক ঋণসীমা লঙ্ঘন করে মূলধনের ১৮ শতাংশের বেশি ঋণ
‘অগ্রহণযোগ্য’ রিস্ক রেটিংয়েও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি
চলতি দায় মেটাতে রূপায়ণ হাউজিংয়ের নেই পর্যাপ্ত তারল্য
ঋণ বিতরণে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত সীমা মানছে না এনআরবি ব্যাংক। অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি ক্ষুদ্র গ্রাহকের প্রতি আগ্রহ নেই তাদের। আইন লঙ্ঘন করেও বড় গ্রাহককে ঋণ দিতে মরিয়া বেসরকারি এই ব্যাংকটি। সম্প্রতি রূপায়ণ হাউজিং এস্টেট লিমিটেডকে সীমা অতিক্রম করে ঋণ দেয়ার প্রমাণ পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া আইসিআরআর নীতিমালা অনুযায়ী গ্রাহকের রিস্ক রেটিং ‘অগ্রহণযোগ্য’ হলেও ঋণের মেয়াদ বাড়িয়ে বেআইনি সুবিধা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০২২ সাল শেষে এনআরবি ব্যাংকের মূলধন ছিল ৭৯৯ কোটি এক লাখ টাকা। এই মূলধনের বিপরীতে এনআরবি ব্যাংক কোনো নির্দিষ্ট গ্রাহক বা গ্রুপকে ১১৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকার বেশি ঋণ দিতে পারবে না। কারণ, ব্যাংকের একক গ্রাহক নীতিমালা অনুযায়ী একজন ব্যক্তি বা গ্রুপকে ব্যাংকের মূলধনের ১৫ শতাংশের বেশি ঋণ দেয়া যায় না। কিন্তু গ্রাহক রূপায়ণ হাউজিং এস্টেট লিমিটেড ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদ্যমান ফান্ডেড ঋণের স্থিতি ১৪৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা; যা ব্যাংকের মূলধনের ১৮ দশমিক ২৩ শতাংশ। এসব ঋণের মধ্যে ৩০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে করোনাকালীন সময়ে গঠিত বিশেষ তহবিল থেকে। চার মাস মেয়াদি এই ঋণের সময় শেষ হওয়ার আগেই আরও ১৮০ দিন মেয়াদ বাড়ানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আবেদন করেছে ব্যাংকটি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন না পেলে এনআরবি ব্যাংককে জরিমানাও গুনতে হতে পারে।
প্রসঙ্গত, দেশের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছার প্রেক্ষাপটে ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি ঋণের ঝুঁকি পরিমাপের নতুন নীতিমালা উদ্বোধন করেন গভর্নর ফজলে কবির। ইন্টারনাল ক্রেডিট রিস্ক রেটিং (আইসিআরআর) নামের এ নীতিমালায় ঋণের পরিমাণ ও গুণগত উভয় ধরনের সক্ষমতার মূল্যায়ন শর্ত রাখা হয়। মূল্যায়নের ভিত্তিতে গ্রাহককে চার শ্রেণিতে বিভাজন করবে ব্যাংকগুলো। কোনো গ্রাহক ‘এক্সিলেন্ট’ বা ‘গুড’ রেটিং পেলে ব্যাংক তাকে অর্থায়ন করতে পারবে। ‘মার্জিনাল’ রেটিংধারী গ্রাহককে পুরোনো ঋণ নবায়ন বা নতুন করে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তবে ‘আনএকসেপ্টেবল’ বা অগ্রহণযোগ্য রেটিংধারী গ্রাহককে কোনো পরিস্থিতিতেই নতুন ঋণ দিতে পারবে না ব্যাংক। যদি না আগের ঋণ শতভাগ নগদ পরিশোধ হয় অথবা জামানত দিয়ে ঋণটি আচ্ছাদন করা হয়।
২০২২ সালে জুনভিত্তিক আর্থিক বিবরণীর ভিত্তিতে প্রস্তুতকৃত আইসিআরআর অনুযায়ী গ্রাহক রূপায়ণ হাউজিং এস্টেট লিমিটেডের রিস্ক রেটিং আনএকসেপ্টেবল বা অগ্রহণযোগ্য। তারপরও পূর্বের ঋণের মেয়াদ বর্ধিত করা হয়েছে। ঝুঁকি প্রশমনে ব্যাংক কর্তৃক গ্রহণ করা হয়নি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। পরিচালনা পর্ষদে অনুমোদনের পর এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অপেক্ষায় এনআরবি ব্যাংক। গ্রাহকের আইসিআরআর রেটিং সূচকগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ছয়টি সূচকের মধ্যে পাঁচটি (লিভারেজ, প্রফিটেবিলিটি, কাভারেজ, অপারেশনাল ইফিসিয়েন্সি ও আর্নিং ইক্যুইটি) সূচকের মান আনএকসেপ্টেবল এবং একটি (লিকুইডিটি) সূচকের মান এক্সিলেন্ট। তবে লিকুইডি সূচকটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ক্যাশ রেশিওর মান ০.০৯ বা অগ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ, প্রতিষ্ঠানটির চলতি দায় মেটানোর জন্য হাতে পর্যাপ্ত তারল্য নেই।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ঋণ বিতরণে একক গ্রাহকসীমা অতিক্রমের বিষয়টি স্বীকার করে এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন মাহমুদ শাহ আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমরা কি সীমার বাইরে দিতে পারি না? এটা কি বেআইনি? বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত সীমার বাইরে গিয়ে একক গ্রাহককে ঋণ দিতে এনআরবি ব্যাংক এতটা আগ্রহী কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বেআইনি নয়, তাই দিচ্ছি।’
প্রসঙ্গত, করোনাসহ অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ধীরগতি চলছে রিয়েল স্টেট ব্যবসায়। কারণ, বর্তমানে বেড়ে গেছে সবগুলো নির্মাণসামগ্রীর দাম। এসবের দাম যদি না কমে, তাহলে ফ্ল্যাটের দাম কমানো সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে জমি রেজিস্ট্রেশনকালে উৎসে আয়কর বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এছাড়া সিমেন্ট, পাথর, টাইলস, লিফট, সিরামিক, গ্যাস, সুইচ-সকেট, ক্যাবল, কিচেনওয়্যারসহ কমপক্ষে ১০-১২টি পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্কারোপ করা হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় রিহ্যাব প্রেসিডেন্ট আলমগীর শামসুল আলামিন জানান, পণ্যের দাম বাড়ার ফলে ফ্ল্যাট তৈরির খরচও বাড়বে। তাই বেশি দাম গুনতে হবে ক্রেতাকে। এতে আবাসন ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এমন পরিস্থিতি আবাসন খাতে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ প্রদান ব্যাংককে ঝুঁকিতে ফেলবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলো এখন কোনো নিয়মনীতি মানার প্রয়োজন মনে করে না। আর যাদের এসব তত্ত্বাবধান করার কথা, অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক; তারা তা করছে না। বরং প্রভাবশালীদের সুবিধা হয়— এমন আইন প্রণয়ন করছে এবং নজরদারি কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে সার্বিক অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হচ্ছে। যেমন খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, দেশের রিজার্ভ কমে যাচ্ছে এবং পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে।’
নাম প্রকাশ না করে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, মূলত সুবিধা পাওয়ার কথা কৃষি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের। কারণ তারাই দেশের প্রধান চালিকাশক্তি। বিশেষ কোনো গ্রুপ বা প্রতিষ্ঠানের কাছে অনেক বেশি ঋণ পুঞ্জীভূত হয়ে গেলে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। তাই দেশ ও অর্থনীতির স্বার্থে ঋণগুলো ভিন্ন ভিন্ন খাতে ছড়িয়ে দেয়া জরুরি। কিন্তু প্রভাবশালীরা অতিরিক্ত ঋণ নিয়ে ব্যাংকে তারল্য সংকট তৈরি করায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ঋণ পান না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের আট দশমিক ৮০ শতাংশ। অর্থাৎ উচ্চ খেলাপির ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। কারণ, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ তিন শতাংশ সহনীয় বলে ধরা হয়।
আরএস