Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪,

নামে আছে কাজে নেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জেনারেটর

লোডশেডিংয়ে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত

বেলাল হোসেন ও মেহেদী হাসান মাসুদ

বেলাল হোসেন ও মেহেদী হাসান মাসুদ

জুন ২৫, ২০২৩, ১১:৩১ পিএম


লোডশেডিংয়ে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত

বর্তমানে জ্বালানি সরবরাহ সাশ্রয়ের জন্য সরকারের প্রজ্ঞাপন আছে। আমাদের গাড়ির জন্য যে তেল বরাদ্দ তা কমিয়ে দিয়েছি। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জেনারেটর এক ঘণ্টা চালু রাখলে অনেক জ্বালানি খরচ হয়
— ডা. মো. রেজওয়ানুর রহমান
লাইন ডাইরেক্টর
উপজেলা হেলথ কেয়ার বিভাগ

  • সারা দেশে ৫০৯ জেনারেটরের মধ্যে সচল ২৫৩টি
  • জেনারেটর না চললেও প্রতি মাসে যাচ্ছে তেল খরচ
  • ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও মেলে না সমাধান
  • দ্রুত শতভাগ সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থা চালুর দাবি

সরকার শতভাগ বিদ্যুতের কথা বললেও ডলার ও জ্বালানি সংকটে গত কয়েক মাসে বিদ্যুৎ সরবরাহে বড় ধরনের ঘাটতিতে পড়ে গোটা দেশ। ফলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আট থেকে ৯ ঘণ্টা লোডশেডিং নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বর্তমানে লোডশেডিং একটু কম হলেও তৃণমূল পার্যায়ে এটি নিত্য নিয়মিত ব্যাপার হয়ে গেছে। বাসাবাড়াতি একটু কষ্ট করে মানুষ জীবন-যাপন করলেও সরকারি হাসপাতালগুলোতে অসহনীয় গরমে রোগীদের করুণ অবস্থা। দেখার যেন কেউ নেই। 

অপরদিকে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন সরকারের জ্বালানি সাশ্রয়ের কথা। দীর্ঘদিন ধরে চালু নেই রাজবাড়ী সদর হাসপাতালের জেনারেটর। চারটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মধ্যে একটিতে জেনারেটর নেই। বাকি তিনটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জেনারেটর থাকলেও অর্থ বরাদ্দ না থাকায় রাতে চালানো হয় না। ফলে লোডশেডিং হলে হাসপাতালগুলোতে সৃষ্টি হয় ভুতুড়ে পরিবেশের। প্রচণ্ড গরমে আরো অসুস্থ হচ্ছেন রোগীরা। শুধু রাজবাড়ীতেই নয় এমন অবস্থা দেশের অধিকাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের। এ কারণে ভর্তি রোগীরা চমর ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। তবে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও সিভিল সার্জনরা আশ্বস্ত করেছেন— দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপজেলা হেলথ কেয়ার (ইউএইচসি) লাইন ডাইরেক্টরের কার্যালয় সূত্র পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ৪৩১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে। এসব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মোট ৫০৯টি জেনারেটর রয়েছে। এর মধ্যে সচল দেখানো হয়েছে ২৫৩টি জেনাটের। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৫৩টি জেনাটের চালু দেখালেও অধিকাংশ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জেনারেটরই অচল। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া জেনারেটর চালু করা হয় না। তবে স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের দাবি পর্যাপ্ত তেলের বরাদ্দ না থাকায় জেনারেটর থাকলেও সেটি চালু রাখা সম্ভব নয়। ফলে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করা সম্ভব হয় না। ভর্তি থাকা রোগীদের পড়তে হচ্ছে চরম ভোগান্তির মধ্যে। চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হতে এসে তীব্র গরমে উল্টো অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেক রোগী।
রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে জেনাটের না থাকায় লোডশেডিং হলে হাসপাতালে ভুতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বিদ্যুৎ চলে গেলে হাসপাতালটিতে লাইট জ্বালানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই রোগীর স্বজনদের মোবাইলের আলোতে চলাফেরা করতে হয় হাসপাতালে। বর্তমানে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা। শ্বাসকষ্ট আর হূদরোগের রোগীরা প্রচণ্ড গরমে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। বিদ্যুৎ না থাকলে বৃদ্ধি পায় মশার উপদ্রব। আর গরমে রাতে ঘুমাতে পারেন না রোগীরা। কালুখালি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অবস্থা আরো করুণ। হাসপাতালটির অনেক ফ্যানই নষ্ট। ফলে ভর্তি রোগীদের বাড়ি থেকে ফ্যান নিয়ে আসতে হয়। তবে হাসপাতালে কোনো জেনারেটরের ব্যবস্থা নেই। পাংশা, বালিয়াকান্দি ও গোয়ালন্দ এই তিনটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জেনারেটর রয়েছে। তবে এসব জেনারেটর চালানোর জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ নেই। তাই দিনের বেলা বিশেষ প্রয়োজনে চালানো হলেও রাতের লোডশেডিংয়ে বন্ধ থাকে জেনারেটর। 
সচল জেনারেটর তালিকায় রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও বিদ্যুৎ চলে গেলে সচরাচর জেনারেটর চালানো হয় না। ৫০ শয্যাবিশিষ্ট এই হাসপাতালটিতে ৫০ কেভি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর থাকলেও তেল খরচ বাবদ ন্যূনতম বরাদ্দ নেই। 

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, এক ঘণ্টা জেনারেটর চালু রাখতে হলে ১১শ টাকা খরচ হয়। অপারেশন ও অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া জেনারেটর চালু করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে তৃণমূলের ভরসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। বর্তমান লোডশেডিং ভর্তি রোগীদের খুব সমস্যা হচ্ছে। বিদ্যুৎ না থাকায় হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ রাখতে হয়। বর্তমানে ঘণ্টা পর ঘণ্টা লোডশেডিং থাকে প্রায়ই। এতে ভর্তি হওয়া রোগীদের চরম কষ্টে পার করতে হচ্ছে। চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা ভ্যাপসা গরমে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। জনসাধারণের সেবা নিশ্চিত করতে হলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার কোনো বিকল্প নেই। সেবা নিশ্চিত করতে হলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থা দরকার।

দেশের অন্তত চারটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘুরে দেখা গেছে এ ভোগান্তির চিত্র। সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারায় স্বাস্থ্যসেবা দিতে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে চিকিৎসকদেরও। বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের সময় অপারেশন থিয়েটারের কার্যক্রম এড়িয়ে অন্যান্য সেবা দেয়া হয়। এরপরও অপারেশন থিয়েটারে সার্জারি চলাকালে বিদ্যুৎ চলে গেলে আইপিএস বা তাৎক্ষণিক মোবাইল-টর্চের আলোতে কাজ শেষ করতে হচ্ছে। এতে বড় ধরনের ঝুঁকির আশঙ্কা থাকে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। সচল জেনারেটর রয়েছে মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। বিদ্যুতের বিকল্প হিসেবে জেনারেটর থাকলেও সেটি অপারেশন ছাড়া চালু করা হয় না। 

তবে হাসপাতালটিতে সৌরচালিত ছোট ছোট ফ্যান রয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা রত্নদ্বীপ বিশ্বাস। তিনি বলেন, তেলের তেমন বরাদ্দ না থাকায় অপারশেন ছাড়া সচরাচর জেনারেটর চালু করা সম্ভব নয়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে থাকা জেনারেটরের জন্য নেই পর্যাপ্ত বরাদ্দ। ফলে অপারেশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছাড়া জেনারেটর চালু করা হয় না। জেলার সিভিল সার্জন জানান, ১৯৯১ সালে লালপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে লোডশেডিংয়ের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে জেনারেটর দেয়া হয়। ১৯৯৫ সালে জেনারেটরটি বিকল হয়ে যায়। ২০১২ সালে মেরামত করে কিছু দিন চললেও ২০১৪ আবারও সেটি অচল হয়ে পড়ে। এখন পর্যন্ত জেনারেটরটি সচল করা হয়নি। লোডশেডিংয়ে রাতের বেলায় চার্জার লাইট ব্যবহার করলেও ফ্যান চালানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। ভর্তি রোগীদের দুর্বিষহ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। আর দীর্ঘদিন ধরে জেনারেটর বন্ধ থাকার কারণে নষ্ট হচ্ছে ব্যাটারিসহ মূল্যবান যন্ত্রাংশ। জেনারেটর মেরামতের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিকবার চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এ কে এম শাহাব উদ্দীন। 

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. আলমগীর হোসেন বলেন, হাসপাতালটির জেনারেটর ২০২১ সাল থেকে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। একাধিকবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি সেটি সচল করার জন্য। বগুড়া জেলার দুপচাঁচিয়া উপজেলার দায়িত্বরত মেডিকেল অফিসার ডা. লামিয়া আমার সংবাদকে বলেন, আমাদের জেনারেটর অনেক দিন হলো নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। বিদ্যুৎ না থাকলে রোগীদের কষ্ট তো হয় জানিয়ে তিনি বলেন, এখানে মেজর অপারেশন হয়। তিনি বলেন, গত মাসের তুলনায় এখন একটু লোডশেডিং কম। এর মধ্যে থেকে আমরা রোগীদের উত্তম সেবা দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপজেলা হেলথ কেয়ার বিভাগের লাইন ডাইরেক্টর ডা. মো. রেজওয়ানুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, এই সব জেনারেটরের তেলসহ বেশ কিছু খরচ পরিচালন বাজেট থেকে আসে। জেনারেটর পারপাসে তেল বরাদ্দের তেমন ব্যবস্থা না থাকলেও আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে তেল দিচ্ছি। বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জেনারেটর থাকলেও তা নষ্ট, আবার তেলের অতিরিক্ত খরচ হওয়ায় অনেক জেনারেটর বন্ধ থাকায় জরুরি চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. রেজওয়ানুর বলেন, আমরা অনেক উপজেলায় জরুরি অবস্থা মোকাবিলার জন্য আইপিএস দিয়েছি। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে জ্বালানি সরবরাহ সাশ্রয় করার জন্য সরকারের প্রজ্ঞাপন আছে। এ জন্য আমাদের গাড়ির জন্য যে তেল বরাদ্দ তা কমিয়ে দিয়েছি। এরপরও এগুলোর মধ্য থেকেও যতদূর সম্ভব আমরা জ্বালানির ব্যবস্থা করে যাচ্ছি। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জেনারেটর এক ঘণ্টা চালু রাখলে অনেক জ্বালানি খরচ হয়। 

উপজেলা হেলথ কেয়ার বিভাগের এ লাইন ডাইরেক্টর বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্যসেবায় যাতে সমস্যা না হয়, যেকোনো ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা দরকার আমরা তা দেবো। তৃণমূলের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে জানার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমকে বেশ কয়েকবার মোবাইলে কল করলেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে মেসেজ দিলেও এর উত্তর মিলেনি। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের জ্বালানি সাশ্রয়ের কথা বলে তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবায় যে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে এর উত্তর খুঁজবে কে! এমনটিই প্রশ্ন সাধারণ জনগণের? তারা বলছেন, ডাক্তারসহ সরকারের উচ্চপদস্থরা তো বিদ্যুৎ চলে গেলে পার্সোনাল চার্জার ফ্যান, আইপিএস, জেনারেটরে ভালো থাকেন। আমরা গরিব রোগীরা আরো বেশি অসহনীয় অবস্থায় দিন যাপন করছি।
 

Link copied!