জুলাই ৩, ২০২৩, ১২:৪৫ পিএম
- পর্যাপ্ত পশু আছে তবুও দাম বেশি
- নিত্যপণ্যের বাজারেও আগুন
- কোরবানি-সংশ্লিষ্ট পণ্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ
- চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে তৎপর প্রশাসন
পবিত্র ঈদুল আজহায় পশু কোরবানিতে বাড়তি খরচ হয় গৃহকর্তার। ইসলামে ওয়াজিব বিধান হওয়ায় প্রত্যাশিত এ খরচের জন্য আগে থেকেই পরিকল্পনা থাকে সবার। পাশাপাশি ঈদের কেনাকাটা তো থাকেই। কিন্তু ঈদ সামনে রেখে নিত্যপণ্য ও কোরবানি-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য জিনিসের বাড়তি দামে পাহাড় সমান চাপ অনুভব করছেন মধ্য ও নিম্ন-মধ্যবিত্তরা। বিশেষ করে পেঁয়াজ, চিনি, মসলা, মাছ, সবজি ও মুরগির দাম বেড়েই চলেছে। এমনকি দা-বঁটি ও কোরবানির কাজে ব্যবহূত গাছের গুঁড়ির দামও বাড়তি। এবার কোরবারির পশুও বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ঢাকায় চাহিদার তুলনায় কোরবানির পশুর সংখ্যা বেশি হলেও পশুর দাম শুনে হতাশ হচ্ছেন ক্রেতারা। পশুখাদ্যের উপকরণের দাম বেড়েছে। এ ছাড়া লালন-পালনের খরচ বৃদ্ধি, ওষুধ, বিদ্যুৎ, কর্মচারীদের বেতনসহ সার্বিক উৎপাদন ব্যয় বাড়ার কারণেই এবার দাম বাড়তি রাখতে হচ্ছে বলে জানান তারা। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এ বছর কোরবানির পশুর সম্ভাব্য চাহিদা এক কোটি তিন লাখ ৯৪ হাজার ৭৩৯টি। এর বিপরীতে কোরবানিযোগ্য পশু আছে এক কোটি ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩৩টি। সে হিসাবে ২১ লাখ ৪১ হাজার ৫৯৪টি পশু বেশি আছে। এর মধ্যে ৪৮ লাখ ৪৩ হাজার ৭৫২টি গরু-মহিষ, ৭৬ লাখ ৯০ হাজার ছাগল-ভেড়া ও দুই হাজার ৫৮১টি অন্যান্য গবাদিপশু। বাজার ঘুরে দেখা যায়, আমদানির খবরে কিছুটা কমলেও এখন ফের বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ। একটু বড় আকারের দেশি পেঁয়াজের কেজি ৮০ টাকা। আর আকারে একটু ছোট হলে দাম ৭০ টাকা। দেড় মাস আগেও পেঁয়াজের কেজি ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। অন্যদিকে, বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন কয়েক দিন আগে চিনির দাম বাড়ানোর জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। ঈদের আগে চিনির দাম না বাড়লেও এ ঘোষণার পরপরই বাজারে বেড়েছে পণ্যটির দাম। বর্তমানে দেশের বাজারে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত। আবার কোথাও কোথাও ১৬০ টাকা বিক্রির কথাও জানিয়েছেন ক্রেতারা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ঘোষণা না এলেও এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বাজারে চিনির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
বেড়েছে মাছের দাম : এক বছর আগেও রাজধানীর বাজারে আকারভেদে প্রতি কেজি তেলাপিয়া ১৪০ থেকে ১৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সেই তেলাপিয়ার কেজি এখন ২৩০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা। আর পাঙাশের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকা থেকে ২২০ টাকা। অন্যান্য মাছের মধ্যে চাষের কই ২২০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা, শিং ৪০০ থেকে ৫৫০ টাকা, ট্যাংরা ৫০০ থেকে ৭৫০ টাকা, পাবদা ৩৮০ থেকে ৫৫০ টাকা, রুই ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা, কাতলা ৩২০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা, চিংড়ি ৬০০ টাকা থেকে এক হাজার ২০০ টাকা, বোয়াল ৬০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এসব মাছ এক বছরের ব্যবধানে কেজিতে ৩০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ডিম-গোশত ও সবজি বাজারে আগুন : মাছের পাশাপাশি মুরগি, গরু ও খাসির মাংসের দামও বেড়েছে। রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকা, খাসির মাংস এক হাজার ৫০ থেকে এক হাজার ১০০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ১৯০ টাকা থেকে ২০০ টাকা ও দেশি মুরগি ৭০০ টাকা থেকে ৭৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে, যা গত বছর ছিল যথাক্রমে ৬৫০ টাকা থেকে ৬৮০ টাকা, ৮৫০ থেকে ৯৫০ টাকা, ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা ও ৫২০ থেকে ৫৫০ টাকা। সরকারের বিপনন সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদনেই এক বছরের ব্যবধানে দাম বাড়ার এ তথ্য জানিয়েছে। বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, পশুখাদ্যের দাম অনেক বেড়েছে। বিদ্যুৎ বিলসহ নানা খাতেও বাড়তি খরচ যোগ হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে মাংসের দামের ওপর।
দা-বঁটির দামও চড়া : গত ঈদ মৌসুমের তুলনায় এবার পশু জবেহসহ মাংস কাটাকুটির সরঞ্জামের দামও বেড়েছে। ব্যতিক্রম হলো, বিগত বছরগুলোতে বঁটি-চাপাতি বিক্রি হতো পিস হিসেবে। এবার তা কিনতে হচ্ছে ওজন দরে। তারপরও এসব সরঞ্জামের বেচাবিক্রি বেড়েছে কয়েক গুণ। রাজধানীর কামারের দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দাম বাড়লেও গত বছরের চেয়ে এবার তাদের বেচাবিক্রি বেশ ভালো। ঈদ সামনে রেখে তারা এক মাস ধরে ব্যস্ত সময় পার করছেন। বাড়িয়েছেন উৎপাদন। প্রত্যাশা করছেন, বরাবরের মতোই ঈদের আগের রাত পর্যন্ত এসব বেচাবিক্রি চলবে। কামাররা জানায়, কোরবানির ঈদ এলেই তাদের বেচাবিক্রি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েক গুণ বেড়ে যায়। বাড়তি চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখে তারাও ব্যস্ত সময় পার করছেন। দিন-রাত শ্রম দিয়ে তৈরি করছেন পশু কোরবানি-সংশ্লিষ্ট সরঞ্জামাদি। দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে বিক্রেতারা জানান, লোহা আর কয়লার দাম গত এক বছরে কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। গত বছর যে লোহার কেজি ছিল ২০০ টাকা এখন সেই লোহার কেজি ৫০০ টাকা। এছাড়া গত বছর এক বস্তা কয়লার দাম ছিল এক হাজার ২০০ টাকা, যা এখন কিনতে হচ্ছে এক হাজার ৬০০ টাকায়। তাই এবার চাপাতি বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা কেজি দরে। আর বঁটি বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকা কেজি। এছাড়া পশুর চামড়া ছাড়ানোর ছুরি ২০০-৩০০ টাকা বা তারও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। সাইজ অনুযায়ী এগুলোর দাম ঠিক হয়।
মসলার বাজারে উত্তাপ : ঈদুল আজহার কেনাকাটার তালিকার শেষটা রকমারি মসলা। কারণ এ ঈদে মসলার কোনো বিকল্প নেই। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রতিটি পরিবারের তালিকায় একটু বেশি পরিমাণ মসলার চাহিদা থাকে। গৃহিণীদের বায়না পূরণে কর্তারা ব্যস্ত মসলা কেনায়। তালিকা ধরে ধরে দোকান থেকে মসলা কিনতে হচ্ছে বাড়ির কর্তাদের। আর এ সুযোগে তেতে উঠেছে মসলার বাজার। প্রায় দিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন মসলা। ব্যবসায়ীদের দাবি, ডলার সংকটে এলসি বন্ধ থাকায় সরবারহ কম, তাই মসলার দামও এবার বাড়তি। তবে ব্যাংকগুলো বলছে ভিন্ন কথা। গত এক মাসে বিভিন্ন বন্দর দিয়ে রেকর্ড পরিমাণ মসলা আমদানি হয়েছে বলে দাবি তাদের। এরপরও সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতেও আগের চেয়ে অনেক বেশি দামে কিনতে হচ্ছে মসলা। তবে ক্রেতারা বলছেন, স্থানীয় প্রশাসন নিয়মিত মনিটরিং চালু করলে দাম হাতের নাগালেই থাকবে। জানা গেছে, কোরবানিকে সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন বন্দর দিয়ে রেকর্ড চার হাজার টন দারুচিনি, ১০২২ টন এলাচ, ৬৩৭ টন লবঙ্গ এবং ৮৬১ টন জিরা আমদানি হয়েছে। এ নিয়ে গত ছয় মাসে ৭১ হাজার টন মসলা আমদানি হলেও নানা অজুহাতে দাম কমছে না।
‘খাইটে’র চাহিদা বেড়েছে : পশুর মাংস প্রক্রিয়াকরণে বেশ কয়েকটি প্রয়োজনীয় উপকরণ লাগে, তার মধ্যে অন্যতম কাঠের পাটাতন ‘খাইট্টা’ বা ‘?খাইটে’, যা কাঠের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি। ঈদুল আজহাকে ঘিরে সারা দেশে কয়েক লাখ টুকরো খাইটে তৈরি হয়ে থাকে। কোরবানি করা পশুর পরিমাণ হিসেবে যার আর্থিক মূল্য কয়েক কোটি টাকা। এলাকাভেদে কোথাও এটাকে বলে খাইট্টা, কোথাও খটিয়া, খাইটে, গুঁড়ি, শপার, হাইজ্যা ইত্যাদি। তবে দেশজুড়ে ‘খাইট্টা’ বা ‘?খাইটে’ শব্দটিই বেশি ব্যবহূত।
সারা বছর কসাইখানায় এ খাইটের ব্যবহার অতি সাধারণ হলেও ঈদুল আজহায় গ্রাম থেকে শহর সর্বত্র এর চাহিদা তুঙ্গে। ঈদে জবাই করা বিপুল পশু প্রক্রিয়া করতে প্রচুর পরিমাণ কাঠের গুঁড়ি ব্যবহার হয়ে থাকে। সাধারণভাবে কোরবানির পশুর সঙ্গে এ গুঁড়িও সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। স মিলের মালিকরা জানান, তেঁতুল গাছের কাঠ দিয়েই খাইটে বানাতে হয়। কারণ মাংস কাটতে যে চাপাতি ব্যবহার হয় তা অত্যন্ত ধারালো। তেঁতুল কাঠে সহজে চাপাতির কোপ বসে না। তাই কাঠের গুঁড়াও উঠবে না। এতে মাংস নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কম। গত বছর প্রতিটি সাধারণ মানের গুঁড়ি বিক্রি হয়েছে ৪০০-৪৫০ টাকায়। এর সঙ্গে ১০০-১৫০ টাকার প্রসেসিং চার্জ। তবে এবার খাইটের দাম বেড়ে হয়েছে ৫৫০-৬৫০ টাকা পর্যন্ত। সঙ্গে প্রসেসিং চার্জ। একটি গুঁড়ির সাধারণ মূল্য ৫৫০-৬৫০ টাকা। ক্রেতা যেটি পছন্দ করবেন সেটিকে করাতে প্রসেস করে দেয়া হয়। বিক্রেতারা জানান, গুঁড়ির ওজন ও আকারের ওপর এ দাম নির্ভর করে। বড় আকারের গুঁড়ির দাম ১৫০০-২০০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। পেশাদার কসাইরা এগুলো দোকানে ব্যবহার করে থাকেন।
চামড়ার দাম কিছুটা বেড়েছে : ঈদ সামনে রেখে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার; ঢাকায় গরুর চামড়ার দাম গতবারের চেয়ে তিন টাকা এবং ঢাকার বাইরে চার টাকা বেড়েছে। ট্যানারি ব্যবসায়ীদের এবার ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া কিনতে হবে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়; গত বছর এই দাম ছিল ৪৭ থেকে ৫২ টাকা। ঢাকার বাইরে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম হবে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা, গত বছর যা ৪০ থেকে ৪৪ টাকা ছিল। এছাড়া সারা দেশে লবণযুক্ত খাসির চামড়া গত বছরের মতই প্রতি বর্গফুট ১৮ থেকে ২০ টাকা, আর বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত রোববার সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে চামড়ার মূল্য নির্ধারণ ও সুষ্ঠু ব্যাবস্থাপনা সংক্রান্ত সভায় এ মূল্য নির্ধারণ করা হয়। বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে চামড়ার এই দাম ঘোষণা করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। চামড়ার ভালো দাম পাওয়া না গেলে প্রয়োজনে কাঁচা চামড়া রপ্তানির অনুমোদন দেয়া হবে বলেও ঘোষণা দেন মন্ত্রী।