Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪,

প্রাথমিকেই ঝরে পড়ে অর্ধেক শিক্ষার্থী

মো. নাঈমুল হক

জুলাই ১০, ২০২৩, ১২:২৪ এএম


প্রাথমিকেই ঝরে পড়ে অর্ধেক শিক্ষার্থী

ছয় বছরে বেড়েছে ৭ ভাগেরও বেশি, দায়সারা বক্তব্য মাউশি ও ডিপিইর

প্রাথমিক শিক্ষাকে একটি মেগা প্রজেক্টের মতো পরিবর্তন করা প্রয়োজন 

—ড. সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম সাবেক অধ্যাপক, ঢাবি

অভিজ্ঞতানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়ন হলে এ হার কমে আসবে 

—ড. তারিক আহসান, অধ্যাপক,  ঢাবি

সাল       প্রাথমিক শিক্ষার্থী     মাধ্যমিক শিক্ষার্থী     কমার হার (শতাংশ)

২০২২     ২০২২৭৮১৬               ১০১৩৩১৪৩                ৪৯.৯০৪ 

২০২১     ২০২৩৪৬৪৬              ১০১৯০০২২                   ৪৮.০১১ 

২০২০     ১৯৯৬৭১০১               ১০২৫২১২৬                  ৪৮.৬৫৪

২০১৯     ১৯৭১১০৬৩              ১০৩৪৯৩২৩               ৪৬.৮৮২ 

২০১৮     ১৯৪৭৩৫৩৫             ১০৪৭৫১০০                  ৪৫.৬৫১ 

২০১৭     ১৮৬০৯২৪৯             ১০৩৩০৬৯৫                ৪২.৫১১ 

                                          ___________________তথ্যসূত্র ব্যানবেইস

দেশে প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর তুলনায় মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় অর্ধেকের মতো কম। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এ হার ৪০ শতাংশের কিছু বেশি থাকলেও গত ছয় বছরে এ হার আরও ৭ শতাংশের বেশি বেড়েছে। সে হিসাবে বর্তমানে এ হার প্রায় ৫০ শতাংশ। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুারোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এ বিষয়ে মাউশি ও ডিপিই কর্মকর্তারা দায়সারা কথা বলছেন। এই বিস্তর পার্থক্যের কারণ হিসেবে শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাথমিকের পর অধিকাংশ শিক্ষার্থী ঝরে যায়। তারা পড়াশোনা করতে পারে না বা চায় না। ঝরে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড, আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা, বাল্যবিয়ে ও প্রাথমিকের চেয়ে মাধ্যমিকে তুলনামূলক কঠিন পড়াশোনার সাথে খাপ খাওয়াতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। ঝরে পড়া কমানোর ব্যাপারে শিক্ষাবিদরা বলছেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে মেগা প্রজেক্টের আলোকে সাজাতে হবে। অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের বৃত্তির আওতায় আনতে হবে। 

ব্যানবেইসের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২২ সালে প্রাথমিক পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থী ছিল দুই কোটি দুই লাখ ২৭ হাজার ৮১৬ জন। একই সময়ে ২০২২ সালে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী ছিল এক কোটি এক লাখ ৩৩ হাজার ১৪৩ জন। অর্থাৎ প্রাথমিকের চেয়ে মাধ্যমিকে এক কোটি ৯৪ হাজার ৬৭৩ শিক্ষার্থী কম আছে। যা মোট হিসাবের ৪৯ দশমিক ৯০৪ শতাংশ। কিন্তু ২০১৭ সালে এ হার ছিল ৪২ দশমিক ৫১১। অর্থাৎ গত ছয় বছরে এ হার বেড়েছে আরও ৭ দশমিক ৩৯৩ শতাংশ। ২০১৮ সালে প্রায় ৩ শতাংশের মতো বেড়ে হয়েছে ৪৫ দশমিক ৬৫১। ২০১৯ সালেও ১ শতাংশের বেশি বেড়ে হয়েছে ৪৬ দশমিক ৮২ শতাংশ। ২০২০ সালেও প্রায় ২ শতাংশ মতো বেড়ে হয়েছে ৪৮ দশমিক ৬৫৪ শতাংশ। তবে ২০২১ সালে এ হার কিছুটা কমে হয়েছে ৪৮ দশমিক ০১১।  

এ ব্যাপারে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) অতিরিক্ত মহাপরিচালক দিলিপ কুমার বণিক আমার সংবাদকে বলেন, ‘মাধ্যমিক পর্যায়ে কম থাকার বিষয়টি জানেন মাধ্যমিক কর্মকর্তারা। প্রাথমিকে তো আমাদের শিক্ষার্থী সংখ্যা বেশি আছে।’ প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে না বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা। তার মতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করেন। মাধ্যমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আব্দুন নুর মো. ফিরোজ (মাধ্যমিক-২) বলেন, প্রকৃত কারণটা জানার জন্য আপনারা মাউশি ডিজির কাছে জিজ্ঞেস করতে পারেন। তিনি সঠিক কারণ বলতে পারবেন।’ 

এ ব্যাপারে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালককে বারবার কল ও হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দেয়ার পরও তিনি কোনো জবাব দেননি। 

বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমাদের দেশে দারিদ্র্য একটি বাস্তবতা। এখনো আমাদের পরিবারগুলো সন্তানদের স্বল্পবয়সে আর্থিক উপার্জনে নিয়োজিত করে। আর্থিক কারণেই কম বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দেয়। প্রাথমিকের  শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কর্মমুখী না হওয়ায় প্রাথমিকের পর পড়াশোনা করানোর জন্য অভিভাবকরা আগ্রহ পান না। এই সময়ে অনেক অভিভাবক সন্তানদের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করেন। অনেক পরিবার সন্তানদের বিদেশ পাঠিয়ে দেন। বিদেশে গিয়ে তারা অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। ফলে যে পরিমাণ দক্ষতা থাকলে আমরা আরো বেশি রেমিট্যান্স আনতে পারতাম এটি তৈরির সুযোগ নেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা মুখস্থ নির্ভর। এর দ্বারা জীবিকার সঙ্গে কোনো মিল খুঁজে পান না অভিভাবকরা। আবার কিছু শিক্ষার্থীর কাছে প্রাথমিকের পর পড়াশোনা কঠিন মনে হয়। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পড়াশোনার সাথে তারা খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে পড়াশোনার অনীহার কারণে অভিভাবকরা সন্তানদের কাজে দিয়ে দেন।’

অভিজ্ঞতা ও দক্ষতানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে প্রাথমিকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার কমার কথা জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের অধ্যাপক ড. তারিক আহসান আমার সংবাদকে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম আমাদের শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার কমাবে। এখন অভিভাবকরা যে কারণে স্কুল থেকে শিশুদের নিয়ে যান, সেই কারণে তারা শিশুদের স্কুলে দেবেন। অর্থাৎ শিশুরা জীবনমুখী শিক্ষা অর্জন করতে পারবে।’ 

প্রাথমিক শিক্ষাকে মেগা প্রজেক্টের আলোকে পরিবর্তন করার কথা জানিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, আমাদের শিক্ষার সামগ্রিক দিকে সমস্যা রয়েছে। বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় সমস্যার শেষ নেই। এর পরিবর্তনের জন্য মেগাপ্রজেক্টের আলোকে কাজ করতে হবে। 

প্রথমত, আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা চলে আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। আমলারা কয়েক বছর পর অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়ে যান। শিক্ষাকে পরিবর্তনের জন্য দরকার শিক্ষা-বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের। তারা আর অন্য কোনো বিভাগে চাকরি করতে পারবেন না। আজীবন শিক্ষার সাথেই থাকবেন। তাহলে তারা সহজেই বুঝতে পারবেন কোথায় কী কী সমস্যা রয়েছে। পৃথিবীর সব দেশ এভাবেই চলছে। 

দ্বিতীয়ত, প্রাথমিক হওয়া উচিত অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। আমরা নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক সিস্টেম করে জগা খিচুড়ি পাকিয়ে রাখছি। সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে এলে শিক্ষার্থীরা কিছু হলেও বুঝতে পারে। 

তৃতীয়ত, প্রাথমিকেই আমাদের বিনিয়োগ হওয়া উচিত সবচেয়ে বেশি। ক্যাডেট কলেজগুলোতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হওয়ায় সেখানকার শিক্ষার্থীরা দেশসেরা হয়। একইভাবে প্রাথমিকে আমাদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এর সব শিক্ষক হবেন বিসিএস ক্যাডার। তারা শিশুদের সবচেয়ে যত্ন করে গড়ে তুলবেন। এরই ওপর ভিত্তি করে আমাদের শিক্ষার্থীরা সুন্দরভাবে গড়ে উঠতে পারবে। 

চতুর্থত, আমাদের আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থী ও পরিবারের তালিকা তৈরি করতে হবে। এই শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা করার জন্য মাসে মিনিমাম ৫০০ টাকা বৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে এই ক্রাইসিস থাকবে না।
 

Link copied!