Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪,

কিশোর-কিশোরী ক্লাব প্রকল্পে হরিলুট

নুর মোহাম্মদ মিঠু

জুলাই ১০, ২০২৩, ১২:৩৪ এএম


কিশোর-কিশোরী ক্লাব প্রকল্পে হরিলুট

শীর্ষে হাজীগঞ্জের ১৩ ক্লাব

  •  মাঠপর্যায়ে সামাজিক নিরাপত্তা অডিট অধিদপ্তরের একাধিক আপত্তি 
  • একই বরাদ্দে দুই দফায় লুটপাট ফেরত দেন না প্রকল্পের অব্যয়িত টাকা 
  • লুটপাট হচ্ছে সিএমসি সভার টাকা বিভিন্ন দিবসের বরাদ্দ, চলছে ভুয়া ভাউচারে টাকা উত্তোলন  
  • টিএ-ডিএ পেলেও ক্লাব পরিদর্শনে যান না উপজেলা কর্মকর্তারা  

মহতী উদ্দেশ্য নিয়ে চালু হলেও মাঠপর্যায়ে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জর্জরিত কিশোর-কিশোরী ক্লাব স্থাপন প্রকল্প। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের অধীনে সারা দেশে প্রান্তিক কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে কাজ করতে এই প্রকল্পে ইতোমধ্যে চার হাজার ৮৮৩টি ক্লাবও গঠন করা হয়েছে। চলছে সার্বিক কার্যক্রমও। কিন্তু ক্লাবগুলোতে কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে কাজ করার চেয়েও প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের অর্থলিপ্সাই বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় এ প্রকল্পের আর্থিক নানা অনিয়মের তথ্যও বিভিন্ন মাধ্যমে উঠে এসেছে। এর মধ্যে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলা একটি। যেখানে খোদ উপজেলা মহিলা-বিষয়ক কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই বিভিন্নভাবে একাধিক খাতে প্রকল্পের অর্থ লোপাটসহ আরও অসংখ্য অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। 

হাজীগঞ্জের ১৩টি ক্লাবেই কিশোর-কিশোরীদের নাশতার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের বেশির ভাগই বিভিন্ন অজুহাতে তছরূপ করছেন তিনি। নিজের অনিয়ম ঢাকতে জেন্ডার প্রমোটরসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অন্যদেরও অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ করে দিচ্ছেন তিনি। এই সুযোগে এই প্রকল্পের একই বরাদ্দে অর্থ লোপাট চলছে দুই দফায়। এ ছাড়া সারা দেশেই ক্লাবগুলোতে নাশতার অর্থ তছরূপ ছাড়াও বিভিন্ন অনিয়মের তথ্য উঠে আসে সামাজিক নিরাপত্তা অডিট অধিদপ্তরের অডিটেও। মাঠপর্যায়ে প্রকল্পের এমন অনিয়মের বিষয়ে একাধিক আপত্তিও জানিয়েছে সংস্থাটি। এ নিয়ে কিশোর-কিশোরী ক্লাব প্রকল্পের পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) তরিকুল ইসলাম প্রমাণসহ সব আপত্তির জবাব চেয়ে সব জেলার উপপরিচালক ও উপজেলা মহিলা-বিষয়ক কর্মকর্তাদের চিঠিও ইস্যু করেন। এ ক্ষেত্রে তাদের সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয় ১০ কর্মদিবস।

এখন পর্যন্ত সে সবের জবাব দেয়ার বিষয়টি জানা না গেলেও হাজীগঞ্জের ১৩টি ক্লাবের ব্যয়ের হিসাব পর্যালোচনা করে জানা গেছে, ২০২১ সালের নভেম্বর মাস থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ১৭ মাসে কিশোর-কিশোরীদের নাশতার জন্য মোট বরাদ্দ দেয়া হয় ১৫ লাখ ২৬ হাজার ৮৫০ টাকা। এর থেকে ৯.৫ শতাংশ হারে এক লাখ ৪৫ হাজার ৫০ টাকা ভ্যাট কর্তনের পর নিট বরাদ্দ উঠানো হয় ১৩ লাখ ৭৪ হাজার ৫০০ টাকা। যার মধ্যে ১৭ মাসে নাশতার জন্য ব্যয় করা হয় আট লাখ ২৪ হাজার ২০০ টাকা। বাকি চার লাখ ৪৬ হাজার ৪০৭ টাকার (অব্যয়িত) পুরোটাই তছরূপ করেন তিনি। জানতে চাইলে যার ব্যাখায় তিনি বলেন, এ টাকার পুরোটাই আন-অফিসিয়াল অর্থাৎ হিডেন (গোপন) খরচ হয়েছে। এসব বিল উঠাতে গিয়ে এজি অফিসেও টাকা দিতে হয়েছে তাকে— এমনটিই বলছেন তিনি। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র ও ১৩টি ক্লাবের নাশতার ব্যয়ের হিসাব পর্যালোচনা করে আরও জানা যায়, অব্যয়িত অর্থ লোপাট ছাড়াও কিশোর-কিশোরীদের নাশতার জন্য মাথাপিছু ৩০ টাকা বরাদ্দের পুরোটাও দেয়া হয় না। বরাদ্দ অনুযায়ী নিজেদের কমিশন রেখেই তৈরি করা হয় নাশতার প্যাকেট। এর মধ্যে ৩০ টাকা বরাদ্দে দেয়া হয় ২০ টাকার নাশতা। একেকটি ক্লাবের ৩৫টি প্যাকেট থেকে ১০ টাকা হারে দৈনিক ৩৫০ টাকা করে ১৩টি ক্লাবের হিসাবে দৈনিক চার হাজার ৫৫০ টাকা এবং প্রতি মাসের আট কার্যদিবসে ৩৬ হাজার ৪০০ টাকা করে লোপাট করেছেন তিনি। গত ১৭ মাসের মধ্যে ৩০ টাকা করে বরাদ্দ পেয়েছেন ১২ মাস। সে হিসাবে ১২ মাসে নাশতার বরাদ্দ থেকে তিনি লোপাট করেছেন চার লাখ ৩৬ হাজার ৮০০ টাকা। ভ্যাটের ৯.৫ শতাংশ বাদ দিলেও তিন লাখ ৯৫ হাজার ৩০৪ টাকা হাতিয়েছেন তিনি। বাকি পাঁচ মাসের বরাদ্দ ছিল কমবেশি ১৫ টাকা। তখনো তিনি প্রতি প্যাকেট নাশতা থেকে পাঁচ টাকা করে নিয়েছেন। এ হিসাবেও তিনি লোপাট করেছেন ১৮ হাজার ২০০ টাকা। এ ক্ষেত্রেও ভ্যাট বাদে তিনি হাতিয়েছেন ১৬ হাজার ৬৫২ টাকা।  শুধু কি তাই, নাশতার টাকা থেকে এভাবে অর্থ হাতানোর বিষয়টি যাতে চাউর না হয় সে জন্য তিনি ১৩টি ক্লাব নিয়ে তার ওপর অর্পিত দায়িত্বও ঠিকঠাকভাবে পালন করছেন না। 

তদারকিহীনতার এই সুযোগে জেন্ডার প্রমোটররাও হাতিয়ে নিচ্ছেন অর্থ। তাদের অর্থ হাতানোর প্রক্রিয়ার বিষয়ে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ১৩টি ক্লাবের কোনোটিতেই ৩০ জন নিয়মিত কিশোর-কিশোরী থাকছে না। যে দু-চারজন কিশোর-কিশোরী আসছে তাদের দিয়েই নামে-বেনামে হাজিরা খাতায় নামের শূন্যস্থান পূরণ করানো হচ্ছে। কোনো ক্লাবে যদি পাঁচজন কিশোর-কিশোরী-উপস্থিত হয়, সে ক্লাব থেকে বাকি ২৫ জনের নাশতার টাকা পুরোটাই জেন্ডার প্রমোটররা হাতিয়ে নিচ্ছেন। নিজের অনিয়ম-দুর্নীতি ঢাকতেই ক্লাব পরিদর্শন তো দূরের কথা, চোখের সামনে জেন্ডার প্রমোটরদের কোনো অনিয়মের বিষয়েও কথা বলতে পারছেন না উপজেলা মহিলা-বিষয়ক কর্মকর্তা সানজিদা মজুমদার। অথচ এসব কার্যক্রম পরিদর্শনের জন্যও ৬০ হাজার টাকা ভাতা নিচ্ছেন তিনি।

একইভাবে তছরূপ করছেন ক্লাব ম্যানেজমেন্ট কমিটির (সিএমসি) সভার টাকাও। সূত্র জানায়, প্রতি বছর ক্লাবপ্রতি দুটি সভার জন্যও তিন হাজার ৬০০ টাকা করে সাত হাজার ২০০ টাকা বরাদ্দ দেয় হয়। হাজীগঞ্জের ১৩টি ক্লাবের জন্য মোট বরাদ্দ ৯৩ হাজার ৬০০ টাকা। এর থেকে ৯.৫ শতাংশ হারে আট হাজার ৮৯২ টাকা ভ্যাট বাদে ৮৪ হাজার ৭০৮ টাকা তছরূপ করেছেন তিনি। বিভিন্ন দিবস উদযাপনের জন্যও এক হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেয়া হয়। সূত্র জানায়, দুই বছরের জন্য ১৩টি ক্লাবে এ খাতে বরাদ্দ পান ২৬ হাজার টাকা। ৯.৫ শতাংশ ভ্যাট বাদে ২৩ হাজার ৫৩০ টাকা হাতিয়েছেন তিনি। একইভাবে মনিহারির জন্যও দুই বছরের বরাদ্দ পান ২৬ হাজার টাকা। ভ্যাট বাদে ২৩ হাজার ৫৩০ টাকা লোপাট করেছেন তিনি। 

সূত্র জানায়, যেকোনো কেনাকাটার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের পিপিআর কমিটি করে অনুমোদন নেয়ার বিধান রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তিনি তাও মানেননি। এ ছাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করেই যাবতীয় খরচাদি করার বিধান থাকলেও তিনি চলছেন নিজের মনগড়া নিয়মেই। কারো কোনো সিদ্ধান্তের পরোয়াই করেন না। কিশোর-কিশোরীদের নাশতায় কী আইটেম দেয়া হচ্ছে তাও ইউএনওকে অবহিত করার কথা থাকলেও তিনি তা করছেন না। আশপাশের আরও একাধিক উপজেলায় চলছে এমন অনিয়ম। 

হাজীগঞ্জে কিশোর-কিশোরী ক্লাব প্রকল্পের অর্থ লোপাটের হোতা সানজিদা মজুমদারের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেই ২০০৮ সালে মহিলা ও শিশুবিষয়ক অধিদপ্তরের অধীনে ডে-কেয়ার ইনচার্জ হিসেবে (তৃতীয় শ্রেণি) চাকরিতে যোগ দেন তিনি। ২০১৭ সালে প্রমোশন পেয়ে বনে যান উপজেলা মহিলা-বিষয়ক কর্মকর্তা। যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও কেবল স্বামীর আশীর্বাদপুষ্টতায় ডে-কেয়ার ইনচার্জ থেকে উপজেলা মহিলা-বিষয়ক কর্মকর্তা বনে যান তিনি। যে কারণে তার দায়িত্বাধীন সেক্টরের প্রতিটি ধাপেই গড়ে উঠেছে অনিয়ম-দুর্নীতির পাহাড়। 

অন্যদিকে অযোগ্যতার কারণে নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্বও ঠিকভাবে পালন করতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন উপজেলা মহিলা-বিষয়ক কার্যালয়ের সংশ্লিষ্টরাও। অধিদপ্তরেরও অনেকেই প্রমোশনকালে তার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৭ সালে শুধু সানজিদাকে পদোন্নতি দেয়ার জন্য যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও ১৪ জন তৃতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাকে উপজেলা মহিলা-বিষয়ক কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়। এতে একই পদে দীর্ঘ প্রায় ২০-৩০ ধরে পদোন্নতি বঞ্চিতরা হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অথচ অযোগ্যকেই প্রমোশন দিয়ে উপজেলার দায়িত্ব দিয়ে হাজীগঞ্জে পাঠায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক অধিদপ্তর। এরপর থেকেই মূলত সরকারি বিভিন্ন কাজের অর্থ লোপাটকেই যেন বৈধ মনে করছেন তিনি। এমন মানসিকতার ধারবাহিকতায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা খাত, অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ ব্যয়, কম্পিউটার সামগ্রী অন্যান্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদিসহ আইজি প্রকল্পের বরাদ্দ ছাড়াও অন্যান্য কর্মসূচি যেমন বিভিন্ন দিবসের বরাদ্দকৃত অর্থ ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে উত্তোলন করেন তিনি। 

সূত্র জানায়, তার এসব অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় অফিস সহকারী-কাম কম্পিউটার অপারেটর আব্দুল হান্নানকে মিথ্যা অভিযোগে হাজীগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জে বদলি করান তিনি। একই কর্মস্থলে দীর্ঘ পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে রয়েছেন তিনি। এ সময়ে তিনি অফিসের কর্মচারীদের সঙ্গেও অফিস বহির্ভূত আচরণ করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। সেবাপ্রত্যাশীরাও যথাযথ সেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সূত্র জানায়, বর্তমান সময়েও তার নিজ নামে সোনালী ব্যাংকের চাঁদপুর আলীগঞ্জ শাখা ও ঢাকায় জনতা ব্যাংকের মগবাজার শাখার দুটি অ্যাকাউন্ট অনুসন্ধান করলে মোটা অঙ্কের লেনদেনের তথ্য পাওয়া যাবে। অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে ভাইবোনদেরও বিভিন্ন ব্যবসায় পুঁজির জোগান দিচ্ছেন তিনি। রাজধানীর উত্তরায় পলওয়েল সুপার মার্কেটে মজুমদার ফ্যাশন নামে তার ভাইদের একটি দোকান রয়েছে। যার অর্থ জোগান দেন তিনি। স্বামীর তদবিরের আশীর্বাদে নিজে উপজেলা-বিষয়ক কর্মকর্তা হওয়ার পর নিজেই তদবির করে ডে-কেয়ার শাখায় চাকরি পাইয়ে দেন ছোট বোনকেও।
 

Link copied!