জুলাই ১২, ২০২৩, ১১:৪০ পিএম
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা
- এক হাজার ৫১৯ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা নামমাত্র বেতন পান
- মানোন্নয়নে ঢাবির আইইআর বিভাগের ১১ দফা সুপারিশ
- পাঁচ বছরেও ৪৩১২টি প্রতিষ্ঠানের এমপিও বাস্তবায়ন হয়নি
এক মাস আগেই ইবতেদায়ি শিক্ষার অবস্থা ও সুপারিশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি
—প্রফেসর কায়সার আহমেদ, চেয়ারম্যান, মাদ্রাসা বোর্ড
সাধারণ শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায়কে বলে প্রাথমিক শিক্ষা। একইভাবে মাদ্রাসা শিক্ষায় এটিকে বলে ইবতেদায়ি শিক্ষা। শিক্ষাব্যবস্থার দুটি ধারার মধ্যে রয়েছে আকাশ-পাতাল তফাত। স্বীকৃতি পর থেকে ইবতেদায়ি শিক্ষা চরম অবহেলার শিকার হয়েছে। স্বীকৃতির চার দশকের মধ্যে বন্ধ হয়েছে পাঁচ ভাগের প্রায় চার ভাগ প্রতিষ্ঠান। এক হাজার ৫১৯ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা নামমাত্র বেতন পান। তবে শিক্ষক নেতাদের হিসেবে বেতন পাওয়া শিক্ষকের সংখ্যা ৬০০ জন। সম্প্রতি ইবতেদায়ি শিক্ষার মানোন্নয়নে ঢাবির আইইআর বিভাগ ১১ দফা সুপারিশ করেছে। ইবতেদায়ি শিক্ষক নেতারা বলছেন, ২০১৮ সালে সরকার চার হাজার ৩১২টি প্রতিষ্ঠানকে এমপিও উদ্যোগ নিলেও অদৃশ্য কারণে সেটি আজও বাস্তবায়ন হয়নি। এ ব্যাপারে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, এক মাস আগেই ইবতেদায়ি শিক্ষার অবস্থা ও সুপারিশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি।
জানা যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশে ধর্মশিক্ষার আশা থেকে পরিবারগুলো ইবতেদায়িতে পড়াশোনা করান। বাংলাদেশে দুই ধরনের ইবতেদায়ি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এমপিওভুক্ত মাদ্রাসার সংযুক্ত ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা। এমপিওভুক্ত মাদ্রাসার শিক্ষকরা বর্তমানে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী বেতন পান। কিন্তু স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকরা চরম বৈষম্য শিকার। ১৯৮৪ সালে তৎকালীন সরকার ইবতেদায়ি ১৮ হাজার ইবতেদায়ি প্রতিষ্ঠানকে স্বীকৃতি দেয়। এরপর ১৯৯১ সালে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকদের জন্য প্রতি মাসে ৫০০ টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৯৪ সালে এক হাজার ৫১৯টি মাদ্রাসার তিন হাজার ৩২ জন শিক্ষককে ওই টাকা দেয়ার মাধ্যমে সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন শুরু হয়। ২০১৩ সালে অনুদান ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। অথচ ২০১৩ সালে ২৬ হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়েছে। ২০১৭ সালে প্রধান শিক্ষকের ভাতা দুই হাজার ৫০০ টাকা এবং সহকারী ও ক্বারি শিক্ষকের ভাতা দুই হাজার ৩০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ইবতেদায়ি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা চার হাজার ৩০০ জন। এর মধ্যে শিক্ষক আছেন ১৩ হাজার ১১১ জন। শিক্ষার্থী সংখ্যা ছয় লাখ ৬৩ হাজার ৬৭০ জন। কিন্তু ইবতেদায়ি শিক্ষক নেতারা বলছেন, এ সংখ্যা আরো বেশি। সারা দেশে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা রয়েছে সাত হাজার ৫৩৯টি, শিক্ষককের সংখ্যা ৪০ হাজার। বর্তমানে অনুদানভুক্ত অনেক শিক্ষক মারা গেছেন, তাই তাদেরও অনুদান বন্ধ হয়ে গেছে। আর বর্তমান এক হাজার ৫১৯টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার ভেতর থেকে মাত্র ৬০০ শিক্ষক তিন মাস পর সামান্য কিছু অনুদান পান। আন্দোলনে বারবার প্রতিশ্রুতি মিললেও বেতন মেলেনি ওই শিক্ষকদের। সর্বশেষ বেতনবৈষম্য নিরসনসহ স্বতন্ত্র মাদ্রাসা সরকারিকরণ দাবিতে ২০১৮ সালে ১ থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আন্দোলন করেন কয়েক হাজার শিক্ষক। সরকার তাদের দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দিলে আন্দোলন স্থগিত করেন। এরপর স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার জন্য ‘এমপিও ও জনবল কাঠামো নীতিমালা-২০১৮’ জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু নীতিমালাটি আজও কার্যকর হয়নি। ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় বর্তমান সরকার ৪৩১২টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা এমপিওভুক্তির ঘোষণা করেছিল। এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিসহ কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব চার হাজার ৩১২টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা এমপিওভুক্তির প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেছিলেন। অথচ নির্বাচন চলে গিয়ে আজ পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে তবুও সেই এমপিওভুক্ত বাস্তবায়ন হয়নি।
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা জাতীয়করণ কমিটির সদস্য সচিব মো. আব্দুল কাদের বলেন, এ দেশে সরকারি প্রাইমারি স্কুল আর স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা একই সূত্রে গাঁথা সমমান একই প্রতিষ্ঠান। শেখ হাসিনা সরকার এ দেশের ওপর লেভেলের সব নন-এমপিও দাখিল আলিম ফাজিল কামিল মাদ্রাসাসমূহ সরকারিকরণ ও এমপিওভুক্ত করে দিয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে এসব মাদ্রাসার ভবন নির্মাণ করে দিচ্ছে। অথচ মাদ্রাসা শিক্ষার মূল ফাউন্ডেশন স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার প্রতি কোনো নজর নেই। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসাগুলোকে বেতন বঞ্চিত করে রেখেছেন ও সরকারি সব সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রেখেছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে এই টাকায় শিক্ষকরা কীভাবে চলতে পারেন? সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগ ‘স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসাগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি: একটি সমীক্ষা’ এ বিষয়ের ওপর গবেষণা শেষে ১১টি সুপারিশ করে উপস্থাপন করে।
সুপারিশগুলো হলো : ১. প্রকৃত পরিসংখ্যানে জন্য বার্ষিক ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শুমারি সম্পাদনে ব্যবস্থা গ্রহণ। ২. অতিসত্ত্বর অনুদান চালু করেন ও বেতন বৃদ্ধিতে নীতিমালা প্রণয়ন ও উদ্যোগ গ্রহণ। ৩. অবকাঠামো উন্নয়ন ও কোয়ালিটি বাড়ানোর জন্য ব্যাপক ভিত্তিক ইন্ডিপেনডেন্ট ইবতেদায়ি মাদ্রাসা ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম হাতে নেয়া। ৪. স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা স্থাপন স্বীকৃতি জনবল কাঠামো অনুদান সংক্রান্ত নীতিমালা ২০১৮ যথাযথ বাস্তবায়ন। ৫. বিদ্যমান মাদ্রাসাসমূহের শিক্ষকদের যোগ্যতা উন্নয়নে জরুরি ভিত্তিতে পেশাগত পেশাগত সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রশিক্ষণ মানের উদ্যোগ গ্রহণ। ৬. পর্যায়ক্রমে মাদ্রাসাসমূহকে জাতীয়করণের উদ্যোগ। ৭. শিক্ষকদের আইএলও-ইউনেস্কো শিক্ষক মর্যাদাবিষয়ক কনভেনশন ১৯৬৬ অনুযায়ী ন্যূনতম বেতন ভাতা প্রদান। ৮. অবসরকালীন সুবিধাদি বাস্তবায়ন করণে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ। ৯. উপজেলা পর্যায়ে পর্যন্ত মাদ্রাসার প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রবর্তন একাডেমিক সুপারভিশন নিশ্চিত করে গুণগত মানোন্নয়ন করা সম্ভব হয়। ১০. শিক্ষার্থীদের জন্য নিশ্চিত গল্পে কোনো বেতন না নেয়া এবং প্রাথমিকের অন্যান্য শিশুর মতো এ প্রতিষ্ঠানসমূহের স্কিন হিসেবে উপবৃত্তি ব্যবস্থা চালু করা। ১১. মানসম্মত অবকাঠামো নিশ্চিতকল্পে মাদ্রাসার জন্য বরাদ্দের ব্যবস্থা গ্রহণ।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর কায়সার আহমেদ আমার সংবাদকে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় আমাদের কাছ থেকে প্রকৃত অবস্থা জানতে চেয়েছে। তাই আমরা আইইআর বিভাগের সহায়তায় গবেষণা করেছি। এক মাস আগেই গবেষণার তথ্য ও সুপারিশ আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছি। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের সচিব ও মন্ত্রী ভালো বলতে পারেন। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবকে তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেয়া হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।