জুলাই ১৭, ২০২৩, ১২:০৯ এএম
- কোথাও নেই বিইআরসি নির্ধারিত দাম
- কমানো দামে কোথাও নেই এলপিজি
- সিলিন্ডার গ্যাসের দাম কমেছে নামেই
- ৯৯৯ টাকার গ্যাস ১২৫০-১৩০০ টাকা
- ভোক্তা-ব্যবসায়ী বাজারে নিত্য বচসা
- ২৭ মাসে দাম বেড়ে হয়েছে ৫৪০ টাকা
নির্ধারিত দামে এলপিজি বিক্রি হচ্ছে কি-না তদারকি করা হবে
—নূরুল আমিন
চেয়ারম্যান, বিইআরসি
নির্ধারিত মূল্যহার কার্যকর করা বিইআরসির দায়িত্ব
—এম শামসুল আলম
জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, ক্যাব
ধারাবাহিকভাবে রান্না করার গ্যাসের দাম কমানোর ঘোষণা এলেও ভোক্তা পর্যায়ে মিলছে না সুফল। বাজারে নেই এর প্রভাব। দেশের কোথাও সরকার নির্ধারিত মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে না তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) বোতল। প্রতি মাসে এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসি। কোনো মাসে গ্যাসের দাম বাড়ে, কোনো মাসে কমে। সর্বশেষ গত ৩ জুলাই ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ৯৯৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু খুচরা পর্যায়ে ক্রেতাদেরকে কিনতে হচ্ছে এক হাজার ২৫০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকায়।
ভোক্তাদের অভিযোগ, বিইআরসি দাম ঘোষণা করে ক্ষান্ত। বাজারে দাম কার্যকরে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ফলে ব্যবসায়ী ও ভোক্তার মধ্যে নিত্য বচসা লেগেই আছে। এদিকে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা বিইআরসি নির্ধারিত দামে সিলিন্ডার কিনতেই পারেন না। বাজারে এখন দুপক্ষের বাদানুবাদ নিত্য ঘটনা।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের এলপিজি ব্যবসায়ী শরীফ আহমেদ আমার সংবাদকে জানান, সরকার নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করা সম্ভব নয়। ১২ কেজি সিলিন্ডার আমরা এক হাজার টাকার কমে ক্রয় করতে পারি না। অন্যান্য খরচসহ এক হাজার ১৫০ টাকার মতো খরচ পড়ে। এক হাজার ২০০ টাকার কমে বিক্রি করলে আমাদের লোকসান গুনতে হবে। যাত্রবাড়ী শহীদ ফারুক সড়কের হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী আল আমিন নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, ১২ কেজি বোতলের গ্যাসের দাম বিক্রি করি এক হাজার ২০০ থেকে ২৩০ টাকা পর্যন্ত। সরকার তো দাম কমিয়েছে, আগের দামের চেয়ে বেশি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১২শ টাকার নিচে বিক্রি করা সম্ভব না। তার দাবি, ১২ কেজি সিলিন্ডার কিনতে তার খরচ হয়েছে এক হাজার ১০০ টাকা উপরে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে কোথাও বিইআরসি নির্ধারিত দামে গ্যাস পাওয়া যায়নি।
এদিকে ক্রেতারা ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীদের প্রতি। তাদের অভিযোগ, সরকার নির্ধারিত এ মূল্যে কখনোই এলপিজি কিনতে পারেন না তারা। অন্যদিকে ডিলার ও আমদানি সংশ্লিষ্টদের দাবি, আমদানিতে খরচ বেশি। তাই আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। আজিমপুর এলাকার এক দোকানের মালিক বলেন, যে লাভ ধরে মূল্য নির্ধারণ হয়, তা বাস্তবে প্রয়োগ করলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যাবে না। দোকান বন্ধ করে চলে যেতে হবে।
এদিকে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দাম বেশির পাশাপাশি ওজনে কম দেয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা রহিমা বেগম আমার সংবাদকে জানান, মাসে আমার দেড়টা সিলিন্ডার লাগে। দাম বাড়ানোর ঘোষণা এলে সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশি দামে কিনতে হয়। কিন্তু কমানোর ঘোষণা এলে সেটি কার্যকর হয় না। তিনি জানান, তিনি কখনো সরকার নির্ধারিত মূল্যে সিলিন্ডার কিনতে পারেননি। রাজধানীতে নির্মিত নতুন বাসাবাড়িতে পাইপে গ্যাসের সংযোগ নেই। তাই সিলিন্ডারে রান্না সারতে হয় অধিকাংশ নতুন বাড়িতে। নির্ধারিত দাম কখনোই কার্যকর হয় না। মাসে মাসে দাম নির্ধারণ হয়, কিন্তু ব্যবসায়ীদের অজুহাতে সেই দামে কেনা যায় না। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এলপিজির দাম প্রতি মাসেই সমন্বয় করে থাকে বিইআরসি।
গত ১৪ মাসের দাম বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কোনো মাসে দাম বাড়ে আবার কোনো মাসে কমে। ২০২২ সালের জুন থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ছয় মাসে দাম বেড়েছে এবং আট মাসে কমেছে। বিইআরসির নতুন চেয়ারম্যান আসার পর থেকে প্রতি মাসেই এলপিজির দাম ধারাবাহিকভাবে কমছে। যদিও গত মে মাসে কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছরের জুন মাসে ১২ কেজি এলপিজির দাম ছিল এক হাজার ২৪২ টাকা। জুলাই মাসে এক হাজার ২৫৪ টাকা, আগস্টে এক হাজার ২১৯ টাকা, সেপ্টেম্বরে এক হাজার ২৩৫ টাকা, অক্টোবরে এক হাজার ২০০ টাকা, নভেম্বরে এক হাজার ২৫১ টাকা, ডিসেম্বরে এক হাজার ২৯৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়। চলতি বছর জানুয়ারিতে এক হাজার ২৩২ টাকা, ফেব্রুয়ারিতে দাম এক হাজার ৪৯৮ টাকা, মার্চ মাসে এক হাজার ৪২২ টাকা, এপ্রিল মাসে ১১৭৮ টাকা, মে মাসে এক হাজার ২৩৫ টাকা, জুন মাসে এক হাজার ৭৮ টাকা এবং সর্বশেষ চলতি মাসের শুরুতে ৯৯৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
বিইআরসি কর্মকর্তারা জানান, দাম কমানোর নির্দেশ দেয়ার পাশাপাশি প্রতিটি আউটলেটে নতুন মূল্যতালিকা টানানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নির্ধারিত দামের বেশি কোনো ব্যবসায়ী বিক্রি করছে এমন অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে সরকারি কর্মকর্তাদের এ ধরনের বক্তব্য যে প্রায়ই বাস্তবতার ধারেকাছেও থাকে না, সেটি আবার দেখা গেল। বিইআরসির প্রশাসন ও আইন-বিষয়ক সদস্য সচিব খলিলুর রহমান খান বলেন, বিশ্ববাজারের এলপিজি গ্যাসের কাঁচামালের দাম কমায় আমরা দেশে তার দাম কমিয়েছি। এখন প্রতিনিয়ত আমাদের কাছে অভিযোগ আসে যে নির্ধারিত মূল্যে গ্রাহকরা গ্যাস কিনতে পারছেন না।
বিক্রেতারা বলছেন তাদের কেনা বেশি পড়ছে। অথচ আমরা এলপিজি গ্যাসের অপারেটরদের সাথে আলোচনা করে মূল্যটা নির্ধারণ করে থাকি। তাদের বলা হয়েছে যেন সঠিক মূল্যে গ্যাস বিক্রয় করেন। তিনি বলেন, আমরা এরই মধ্য জেলা প্রশাসনের কাছে চিঠি পাঠিয়েছি। যেন সঠিক মূল্যে গ্যাস বিক্রয় নিশ্চিত করা হয়।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম আমার সংবাদকে বলেন, ‘এলপিজির দাম নির্ধারণের একক ইখতিয়ার রয়েছে বিইআরসির। আর এই নির্ধারিত মূলাহার বাস্তবায়ন করাও বিইআরসির কাজ। বিইআরসি সে দায়িত্ব কখনো পালন করেনি। গ্রাহকরা নির্ধারিত মূল্যে গ্যাস পাচ্ছে কি-না তা সঠিক বাস্তবায়নে বিইআরসি কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।’
এলপিজির দাম নিয়ে বাজারে সমন্বয়হীনতার বিষয়ে বিইআরসি চেয়ারম্যান নূরুল আমিন বলেন, ভোক্তা পর্যায়ে নির্ধারিত দামে এলপিজি বিক্রি হচ্ছে কি-না সে বিষয়ে তদারকি করা হবে। আমরা নিজেরাই এলপিজির বাজার মনিটর করতে মাঠে নামব। এর বাইরেও জেলা প্রশাসক এবং ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর আলাদা করে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে। দর নির্ধারণ করার সময় মালিকদের প্রতিনিধি থাকেন। তাদের দাম বেশি নেয়া কোনো সুযোগ নেই। অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ১২ এপ্রিল প্রথম এলপি গ্যাসের দর ঘোষণা করে বিইআরসি। তখন এলপিজি আমদানিকারক, ডিলার ও খুচরা বিক্রেতার জন্য ১২ কেজির সিলিন্ডারে মোট ৩৫৯ দশমিক ৪০ টাকা কমিশন নির্ধারণ করা হয়েছিল অর্থাৎ, ২৭ মাসে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম বেড়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচশত টাকা। দর ঘোষণার দিনেই কমিশনের পরিমাণ নিয়ে আপত্তি তোলেন লোয়াব (এলপিজি আমদানিকারকদের সংগঠন)। এরপর থেকে বিইআরসির সঙ্গে টানাপোড়েন শুরু হয় লোয়াবের।