Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

সংঘাতে ফায়দা কার

আবদুর রহিম

জুলাই ১৯, ২০২৩, ১১:৫৫ পিএম


সংঘাতে ফায়দা কার
  • বিরোধীদের মামলা দিয়ে মাঠ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চায় সরকার বিরোধীরাও চায় বিশ্বের সহানুভূতি
  • গুলিবিদ্ধ প্রায় এক হাজার নেতাকর্মী আহত দুই সহস্রাধিক
  • কৃষক দল নেতা সজিবকে লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের ছাত্রলীগ সভাপতি মহসিন কবির সাগর ও সেবাব নেওয়াজ কুঁপিয়ে হত্যা করে —দাবি বিএনপির
  • পাঁচ সহস্রাধিক নেতাকর্মীর নামে মামলা

কর্মসূচি ঘিরে যে সংঘাত শুরু হয়েছে এটি রাজনীতির পুরোনো খেলা

বদিউল আলম মজুমদার

সুজন সম্পাদক

হামলা করে মামলা দিয়ে নেতাকর্মীদের সরকার

ঘর-বাড়ি ছাড়া করতে চায় 

রুহুল কবির রিজভী

সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, বিএনপি

সংঘাতময় হয়ে উঠল দেশের রাজনীতি। পালটাপালটি কর্মসূচি ঘিরে গত মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের শান্তির শোভাযাত্রা ও বিএনপির পদযাত্রায় একজন নিহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ প্রায় এক হাজার নেতাকর্মী। আহত  দুই সহস্রাধিক। ওই ঘটনায় গতকাল দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের মামলায় বিএনপির পাঁচ সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামে নৌকার প্রার্থীর ক্যাম্প ভাঙচুর ও নেতাকর্মীদের মারধর করার পর বিএনপি কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়েছে। এ সময় বিএনপি কার্যালয়ের বাইরে টাঙানো ব্যানার-ফেস্টুনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে হামলাকারীরা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সংঘাত আসলে আমাদের দেশে রাজনীতিবিদরা সৃষ্টি করেন। সংঘাত সৃষ্টির মাধ্যমে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করে রাজনৈতিক দলগুলো। ক্ষমতাসীন দল চায় বিরোধী দলকে মামলা দিয়ে গণগ্রেপ্তার করে আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে, মাঠ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে। আবার বিরোধীরাও চায় বিশ্বের কাছে সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আবারও রাজনীতির পুরনো খেলার অতীত দৃশ্যপট তৈরি হয়েছে বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন, সংঘাত তৈরি হলে ক্ষমতাসীন দল অভিযান পরিচালনা করবে, নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি হানা দেবে। আটক করবে, আতঙ্ক সৃষ্টি করবে। আর বিরোধীরা সরকারের কর্মকাণ্ড বিশ্বের কাছে তুলে ধরবে, গণতন্ত্র বিপর্যয়ের অভিযোগ তুলবে।  

সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার আমার সংবাদকে বলেন, ‘দুই দলের কর্মসূচি ঘিরে যে সংঘাত শুরু হয়েছে এটি আসলে রাজনীতির পুরনো খেলা। সংঘাত উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সৃষ্টি করা হয়। অতীতের মতোই মনে হচ্ছে এবারও সরকার সংঘাত সৃষ্টি করছে। যাতে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মামলা দেয়া যায়। মামলা দিয়ে তাদের বাড়ি-ঘরে অভিযান চালানো যায়। আটক করে বিরোধীদের সাজা দিয়ে আটক করে মাঠ নিজেদের দখলে রাখা যায়। সরকার যে উদ্দেশ্য নিয়ে সংঘাত তৈরি করছে তাতে কোনোভাবেই জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না।’

রাজনীতিতে চোখ রাখা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারি দল বিদেশিদের প্রবল চাপে থাকলেও স্বস্তিতে নেই বিএনপি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের কথা বলছে। কিন্তু কেউ একবারও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেনি। এ পরিস্থিতিতে বিএনপি সরকার পতন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের যে আন্দোলন করছে তা আদৌ সফল হবে কি-না, অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। যখন দলটি দেশের জনগণ ও দলীয় শক্তিকে কাজে লাগিয়ে মাঠে নামার কথা তখন তারা আগের ২০ দল ভেঙে দিয়ে ৩৬ দল গঠন করে আন্দোলনে নেমেছে। কখনো দিচ্ছে ১০ দফা, কখনো ২৭ দফা আবার কখনো ৩১ দফা। সর্বশেষে তারা সরকার পতনের আন্দোলনে এক দফার আলটিমেটাম দিয়ে মাঠে নেমেছে। অপর দিকে, ক্ষমতাসীন দল কোনোভাবেই কোনো চাপে নত হচ্ছে না। শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচনে অটল তারা। তারাও এক দফা দিয়ে রাজপথ দখলে রেখেছে। এমন পরিস্থিতিতে বিদেশিরা দেশের ওপর নেতিবাচক দৃষ্টি দিলে পুরো দেশের জনগণের ওপর তার দায় বহন করতে হবে বলেও অনেকে মনে করছেন। এমনি ভিসানীতির কারণে রাজনীতির টালমাটাল অবস্থা। আবার যদি নতুন কিছু আসে তাহলে আরো খারাপ অবস্থা তৈরি হতে পারে। মাঠে, মাঠে বাইরে, পর্দার সামনে এবং পর্দার আড়ালে দু’দল নানা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে মাঠের কর্মসূচি ঘিরে জনজীবন স্থবির হয়ে আছে। দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে মহা আতঙ্ক তৈরি হয়ে আছে।

বিএনপির সরকার পতনের পদযাত্রা সংঘাত দিয়ে শুরু হয়েছে। লক্ষ্মীপুরে পদযাত্রা চলাকালে কৃষক দল নেতা সজিব হোসেনকে পদযাত্রার পেছন থেকে চোরাগুপ্তাভাবে টেনে নিয়ে লক্ষ্মীপুর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি মহসিন কবির সাগর ও সেবাব নেওয়াজের নেতৃত্বে কুঁপিয়ে, গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি বিএনপির। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে প্রায় তিন শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয় বলেও জানা গেছে। গাবতলি থেকে বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচি চলাকালে সরকারি বাঙলা কলেজের ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ হামলার ঘটনায়  দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে। দুই মামলায় ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এতে ১২০ জনের নাম উল্লেখ করাসহ অজ্ঞাত আরো  ৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

ফেনীতে পদযাত্রা চলাকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে প্রায় দেড় শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছে।  দাগনভূঞা উপজেলার যুবদল নেতা আব্দুর রহিম মুমূর্ষু অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে, বলছে বিএনপি। পুলিশ-বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ত্রিমুখী সংঘর্ষে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের দুই হাজার ৮৮ নেতাকর্মীর নামে মামলা করা হয়েছে। শহর পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) হায়াত উল্লাহ বাদী হয়ে ৮৮ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও দুই হাজার জনের নামে মামলাটি করেন। খাগড়াছড়িতে বিএনপির পদযাত্রায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে প্রায় দুই শতাধিক নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধ হয়। পুলিশ এ সময় ৫০ জনের অধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে। জেলা বিএনপির কার্যালয়ে আওয়ামী লীগ হামলা চালিয়ে জিয়াউর রহমানের (বীর উত্তম) ম্যুরাল ভাঙচুর করে বলেও দাবি বিএনপির।

বগুড়ায় পদযাত্রা কর্মসূচি চলাকালে পুলিশ গুলি চালিয়ে প্রায় দেড় শতাধিক নেতাকর্মীকে আহত করে। এ সময় পুলিশের টিয়ারশেলে য়াকুবিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অসংখ্য শিক্ষার্থী গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন। সংঘর্ষের ঘটনায় পৃথক চারটি মামলায় জেলা বিএনপির সভাপতি রেজাউল করিম বাদশা, সাধারণ সম্পাদক আলী আজগর তালুকদারসহ দলটির ২১১ নেতাকর্মীর নামে মামলা হয়েছে। এ ছাড়া অনেক ব্যক্তিকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে বলেও জানা গেছে। কিশোরগঞ্জে পদযাত্রা কর্মসূচি পালনের সময় দুপুর ১২টায় কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের রথখোলা এলাকার ঈশাখাঁ রোডে পুলিশ গুলি চালায় বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর। এ সময় পুলিশের গুলিতে প্রায় দেড় শতাধিক নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধ হয়। এ ঘটনায় পুলিশ  ১৯ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ৬০-৭০ জনকে আসামি করে মামলা দিয়েছে। জয়পুরহাট জেলায় শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের হামলা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে বিএনপির অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধ হয়। জয়পুরহাট শহরের পাঁচুর মোড়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংঘর্ষের সময় ছয় পুলিশ সদস্য ও দুই গোয়েন্দা পুলিশ আহত হওয়ার ঘটনায় বিএনপি ও এর অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের ৮১ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ।

পিরোজপুর জেলায় বিএনপির এক দফা দাবি পদযাত্রা কর্মসূচিতে পুলিশ অতর্কিত হামলা ও গুলিবর্ষণ করে ২০ থেকে ২৫ নেতাকর্মীকে গুরুতর আহত করে বলে দাবি তোলা হয় বিএনপির পক্ষ থেকে। ওই ঘটনায় ৮০ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাত ২০০-৩০০ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেছে পুলিশ। নেত্রাকোনা জেলায় পদযাত্রা কর্মসূচি পালনের জন্য আসার পথে বারহাট্টা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মোস্তাক আহমেদ, বিএনপি নেতা রুহুল আমীন শাহীন ও আব্দুল জলিলকে আওয়ামী লীগ হামলা চালিয়ে গুরুতর আহত করে এ ছাড়া কর্মসূচি শেষে ফেরার পথে রৌহা ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক শিপন মিয়ার ওপর হামলাচালিয়ে  গুরুতর আহত করে বলে দাবি বিএনপির।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী আমার সংবাদকে বলেন, ‘আওয়ামী সন্ত্রাসী ও পুলিশের গুলিতে সারা দেশে বিএনপির দুই হাজার নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। লক্ষ্মীপুরে কৃষক দলের কর্মী সজিবকে কুপিয়ে হত্যা করেছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। পদযাত্রায় মঙ্গলবার গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এক হাজারেরও বেশি। এখন আমাদের প্রায় হাজার হাজার নেতাকর্মীর নামে মামলা দেয়া হচ্ছে। তাদেরকে ঘর-বাড়ি ছাড়া করতে চায় সরকার।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পরিকল্পিতভাবে তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে ক্ষমতাসীন দল ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। শেখ হাসিনার বীভৎস রূপ জাতি আজ দেখেছে। যা নজিরবিহীন ঘটনা। শেখ হাসিনার ঐতিহ্যে গণতন্ত্র না থাকা। তারা যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যে আন্দোলন চলছে যতই রক্ত ঝরাক, সরকারের পতন ঘটিয়ে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’

 

Link copied!