জুলাই ২৩, ২০২৩, ১২:১৪ এএম
- প্রতিদিন গড়ে দুটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে
- প্রাণহানির পরও ভ্রুক্ষেপ নেই সংশ্লিষ্টদের
- মুদি, চা-পান-সিগারেটের দোকানেও এলপিজি
- ৬০ লাখ গ্রাহক সিলিন্ডার ব্যবহার করেন
- বিস্ফোরক পরিদপ্তরে জনবল সংকটে গলদঘর্ম
- সিলিন্ডারের মান যাচাইয়ের কোনো সংস্থা নেই
বড় দুর্ঘটনা রুখতে ব্যক্তিসচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে
—মোহা. নায়েব আলী, প্রধান পরিদর্শক, বিস্ফোরক পরিদপ্তর
গ্রাহক-ব্যবসায়ীদের মধ্যে সতর্ক ও সচেতনতামূলক কাজ করা হচ্ছে
—ব্রিগেডিয়ার মো. মাইন উদ্দিন, মহাপরিচালক, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর
দেশের গ্যাস সরবরাহ এবং সংযোগ ব্যবস্থাপনা ভঙ্গুর ও ঝুঁকিপূর্ণ
—এম শামসুল আলম, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, ক্যাব
নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে সর্বত্র বিক্রি হচ্ছে এলপি গ্যাস সিলিন্ডার। জ্বালানি তেলও (ডিজেল, অক্টেন, পেট্রোল) পাওয়া যায় যত্রতত্র। অনুমোদন ছাড়া বিক্রির বিধান না থাকলেও এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের বোতল ও পেট্রোলসহ দাহ্য পদার্থ বিক্রি হচ্ছে অবাধে। চরম ঝুঁকির মধ্যেই হরদম ব্যবসা করে যাচ্ছেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। শহর, গ্রাম-গঞ্জ সর্বত্রই এমন চিত্রই দেখা মেলে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় খবর নিয়ে জানা যায়, মুদির দোকান, চায়ের দোকান, পান-সিগারেটের দোকান, সারের দোকান, আবাসিক ভবন, লাকড়ির দোকান, ওষুধের দোকানে অবাধে বিক্রি হচ্ছে এসব গ্যাস সিলিন্ডার। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশসহ জনবহুল এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ স্থানেও গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে। বেশির ভাগ দোকানে নেই অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র। কিছু দোকানে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র টাঙানো থাকলেও জানা নেই তার ব্যবহার। অনেকের যন্ত্রগুলো অকেজো ও মেয়াদোত্তীর্ণ।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রতিদিন গড়ে দুটি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। তবে এর বেশির ভাগই বাসা-বাড়িতে। তাই গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে আরও সতর্ক হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। দাহ্য পদার্থের এমন অসতর্কতা ব্যবহার, পরিবহন ও যত্রতত্র বেচাকেনার ফলে যেকোনো সময় ঘটছে বিস্ফোরণ। ঘটছে প্রাণহানির মতো ঘটনাও। সামপ্রতিক সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে বহু প্রাণহানি ঘটলেও সংশ্লিষ্ট কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। হাটবাজার ও খোলা দোকানপাটে বিক্রি হচ্ছে গ্যাস সিলিন্ডার। নিয়মানুযায়ী গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করতে হলে ফায়ার সার্ভিস লাইসেন্স, জ্বালানি অধিদপ্তরের লাইসেন্স, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও সিটি, পৌরসভা কিংবা ইউনিয়ন পরিষদের ট্রেড লাইসেন্স অবশ্যই থাকতে হয়। এমনকি গ্যাস সিলিন্ডার মজুতের স্থানটিও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের প্রয়োজন। কিন্তু কোনো নিয়মই কোথায়ও মানা হচ্ছে না। ফলে বাড়ছে জীবনঝুঁকি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, অগ্নিপ্রতিরোধ নির্বাপক আইন-২০০৩-এর ৪ ধারা অনুযায়ী সরকার ঘোষিত ফায়ার সার্ভিসের কোনো জ্বালানির ব্যবসা করলে তাকে মজুত প্রক্রিয়াকরণের জন্য লাইসেন্স নিতে হবে। অন্যথায় আইনের ১৭ ও ১৮ ধারা অনুযায়ী তিন বছরের কারাদণ্ড এবং দোকান বা স্থানে সংরক্ষণ করা মালপত্র বাজেয়াপ্ত করা হবে। বিস্ফোরক আইন ১৮৮৪-এর অধীনে ্ভ্রার বিধিমালা ২০০৪-এর ৬৯ ধারা অনুযায়ী লাইসেন্স ছাড়া অনধিক ১০টি গ্যাসপূর্ণ সিলেন্ডার মজুত করা যাবে। তবে বিধির ৭০ ধারা অনুযায়ী এসব সিলেন্ডার মজুত করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি এবং আগুন নিয়ন্ত্রক সরঞ্জাম মজুত রাখতে হবে। সিলিন্ডার গ্যাস স্থাপনা প্রাঙ্গণে দিয়াশলাই বা আগুন লাগতে পারে এমন কোনো বস্তু বা সরঞ্জাম রাখা যাবে না। মজুত করা স্থানের কাছাকাছি আলো বা তাপের উৎস থাকা যাবে না।
আইন থাকলেও মানা হচ্ছে না কোনো নিয়ম। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর যেন বেখবর। তাদের দায়িত্বহীনতায় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এমন আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। পেট্রোলিয়াম মজুত আইন ২০১৮-তে বলা হয়েছে, কোনো পেট্রোলিয়াম মজুতাগার, স্থাপনা, ফিলিং স্টেশন, ড্রাম, ট্যাংক, শোধনাগার ও পরিবহন যানে ‘ধূমপান বা আগুন নিষিদ্ধ’ সতর্কবাণী সংবলিত সাইনবোর্ড বা লেবেল লাগাতে হবে।
লাইসেন্সবিহীন গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে রাজধানীর শনির আখড়ার ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম আমার সংবাদকে জানান, ‘গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রির বিষয়ে কোনো প্রকারের লাইসেন্স প্রয়োজন পড়ে কি-না, তা জানা নেই। বাজারের অনেক দোকানেই তো গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হয়। একেবারে ফুটপাতে সিলিন্ডার সাজিয়ে রাখা হয়েছে, কেউ তো কিছু বলে না।’ জুরাইনের এলপিজি ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, ‘ব্যস্ততার কারণে লাইসেন্স নেয়া হচ্ছে না। তবে যাবতীয় নিয়ম মেনে গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করছেন।’ একাধিক দোকান মালিক জানান, কোম্পানির ডিলারদের কাছ থেকে গ্যাস সিলিন্ডার ক্রয় করেই তা দোকানে মজুত রেখে বিক্রি করা হচ্ছে। কোম্পানি তাদের নিজস্ব পরিবহনে গ্যাস সিলিন্ডার দোকানে সরবরাহ করে থাকে। তবে গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করতে লাইসেন্স নিতে হয় এবং অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রাখা বাধ্যতামূলক— সরকারি এ নিয়মাবলি তাদের জানা নেই।
ব্রাহ্মণবাড়ীর নবীনগরের এক ব্যবসায়ী নাম গোপন রাখার শর্তে আমার সংবাদকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে লাইসেন্স করে ব্যবসা পরিচালনা করছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় বতর্মানে পান দোকান, মুদি দোকান, ওষুধ দোকানসহ বিভিন্ন অনিরাপদ স্থানে গ্যাসের সিলিন্ডার ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের তদারকি না থাকায় লাইসেন্স ছাড়া নিয়মনীতিকে তোয়াক্কা না করে দেদার গ্যাসের সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে। তাই আগামী বছর থেকে আমার লাইসেন্সের নবায়ন করব না। নবায়ন করে কী লাভ, যদি লাইসেন্স ছাড়াই ব্যবসা করা যায়।’ নবীনগরের স্থানীয় প্রশাসন জানান, দাহ্য পদার্থ বিক্রির সুনির্দিষ্ট বিধিমালা আছে। যত্রতত্র বিক্রির কোনো সুযোগ নেই। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
লক্ষীপুরের রামগঞ্জের বাসিন্দা রেহানা বেগম বলেন, ‘হাতের কাছে পাই দূরে যেতে হয় না। তাই বাড়ির পাশের মুদি দোকান থেকেই সিলিন্ডার কিনি। সিলিন্ডারেরও মেয়াদ থাকে, এটি জানা ছিল না। এখন থেকে বড় দোকান বা ডিলারদের কাছে থেকেই কিনব।’ তিনি আরও বলেন, চাহিদা থাকায় এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী যেখানে-সেখানে সিলিন্ডারের বোতল ফেলে রেখে বিক্রি করছেন। ঝুঁকিপূর্ণ এ জ্বালানির যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই এসব দোকানে। গ্যাস সিলিন্ডার সংক্রান্ত দুর্ঘটনা রোধে সরকার ১৯৯১ সালে গ্যাস সিলিন্ডার বিধিমালা করেছে। এই বিধিমালা অনুযায়ী, বিস্ফোরক পরিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া স্থানীয়ভাবে কাঁটাছেড়া করা সিলিন্ডার ব্যবহার অবৈধ। গ্যাস সিলিন্ডার বিধিমালা প্রতিপালনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা হচ্ছে বিস্ফোরক পরিদপ্তর। তবে এ দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, মাঠপর্যায়ে গিয়ে তদারকির মতো জনবল তাদের নেই। বিভিন্ন ধরনের সিলিন্ডার ও রাসায়নিকের অনুমোদন (লাইসেন্সিং) দিতেই তারা গলদঘর্ম।
জানা যায়, ২০১০ সাল পাইপলাইনে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো নতুন সংযোগ বন্ধ করে দেয়। ফলে বেড়েছে এলপি নির্ভরতা। দেশে বর্তমানে ৬০ লাখের বেশি গ্রাহক এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার করেন। তবে এলপিজি গ্রাহকের একটি বড় অংশই গ্রামাঞ্চলের। এ মুহূর্তে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট ৩০টি কোম্পানির অন্তত দুই কোটি সিলিন্ডার বাজারে রয়েছে। বিস্ফোরক পরিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত এক বছরে এলপিজি সিলিন্ডার আমদানি করা হয়েছে ছয় লাখের বেশি। এলপিজি ছাড়া অন্যান্য সিলিন্ডার আমদানি করা হয়েছে তিন লাখের বেশি। পাশাপাশি দেশেও সিলিন্ডার নির্মাণের জন্য তিনটি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেয়া হয়েছে। অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান বাজারজাত করেছে দেশে নির্মিত সিলিন্ডার। কিন্তু এসব সিলিন্ডারের মান পরীক্ষার জন্য অনুমোদিত কোনো পরীক্ষা কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি।
যদিও গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে বাঁচতে সচেতনতার বিকল্প নেই কিন্তু এর অপর একটি সমাধান হতে পারে গ্যাস ডিটেক্টর যন্ত্র। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটু সচেতনতা আর গ্যাস ডিটেক্টর নামের যন্ত্রটি স্থাপন করে নিলেই রক্ষা পাওয়া যাবে এ রকম বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে। শুধু প্রচারের অভাবে গ্যাস ডিটেক্টর যন্ত্রের কার্যকারিতা বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, গত কয়েক বছরে দেশে এলপিজি ও গ্যাসলাইনের বড় বড় বিস্ফোরণ ঘটেছে। সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দগ্ধ বেশির ভাগ রোগীরই অবস্থা খুবই খারাপ থাকে। এদের এমনও হয় যে ৯৯ শতাংশও পুড়ে যায় শরীরের। তখন আর তাদের বাঁচানোর সুযোগ থাকে না বলে জানান চিকিৎসকরা।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, এসব দুর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, দেশের গ্যাস সরবরাহ ও সংযোগ কতটা ভঙ্গুর ও ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে ঘটছে দুর্ঘটনা-প্রাণহানি।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার মো. মাইন উদ্দিন আমার সংবাদকে বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস বিভিন্ন জায়গায় ব্যবসায়ীদেরকে লাইসেন্স নেয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। শহরে ও গ্রামে ইনস্ট্রাক্টররা এ বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন। আমরা ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্সটি একেবারেই ফ্রিতে দিয়ে দিচ্ছি। ফ্রিতে দেয়ার পরও কেন লাইসেন্স নিচ্ছে না ব্যবসায়ীরা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, আসলে অসচেতনতার জন্যই এটি হচ্ছে। তারপরও আমরা সব মহলে সচেতনা ও উৎসাহমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।’
তিনি আমার সংবাদকে আরো বলেন, ‘খুচরা দোকানদারা মূলত ডিলারশিপদের কাছ থেকে সিলিন্ডারগুলো নিয়ে থাকে। এ জন্য আমরা ডিলারদেরকে সচেতন ও সতর্ক করে যাচ্ছি। গ্রাহক, ব্যবসায়ী, সংরক্ষণকারী সবাইকেই সচেতন হতে হবে।’ এ বিষয়ে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক মোহা. নায়েব আলী বলেন, ‘যেকোনো বড় ঘটনার তদন্তে আমরা শতভাগ তৎপর। বাসা-বাড়িতে লিকেজ তো ব্যক্তি পর্যায়ে নজরদারি জরুরি। ব্যক্তির নিজের সচেতনতাও এমন বড় দুর্ঘটনা রুখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।’