আগস্ট ৭, ২০২৩, ১২:১৪ এএম
২০৩০ সাল নাগাদ জ্বালানি আমদানি ব্যয়
- জ্বালানি জোগান নিয়ে শঙ্কিত ব্যবসায়ীরা
- জরুরি ভিত্তিতে দরকার ৩৭৬ কোটি ডলার
- ডলার না পেলে লোডশেডিং থেকে মুক্তি নেই
আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় জ্বালানিতে গুরুত্ব দিতে হবে। এতে ডলারের চাপও কমবে
—ড. বদরূল ইমাম, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ
আমদানিনির্ভর জ্বালানিতে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়লে জ্বালানি নিরাপত্তা থাকবে না
—মো. জসিম উদ্দিন, সভাপতি, এফবিসিসিআই
ডলার সংকটে প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমাদানি করতে পারছে না সরকার। কয়লা সংকট ও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এ পর্যন্ত সাত মাসে ছয়বার বন্ধ হয়েছে রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। গত মাসে বন্ধ হয়ে যায় পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রও। পাশাপাশি ফার্নেস অয়েল আমদানিতেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। এতে ৩৪টি ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্র আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ। ফলে সক্ষমতা থাকলেও জ্বালানির অভাবে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। চলতি বছরের ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) জরুরি ভিত্তিতে যে পরিমাণ জ্বালানি জোগান দিতে হবে তার খরচ হবে ৩৭৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া ২০৩০ সাল নাগাদ জ্বালানি আমাদানি করতে সরকারের ব্যয় করতে হবে ২৪-৩০ বিলিয়ন ডলার।
আর কয়লা, তেল, গ্যাসের পর্যাপ্ত আমাদানি না হলে বড় ঝুঁকির মধ্যে পড়বে শিল্পকারখানা। জ্বালানি জোগান শঙ্কা নিয়ে উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা। জ্বালানি সংকটে বিদ্যুতের উৎপাদন এখনই কম। ফলে লোডশেডিং করতে হচ্ছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে। যার ফলে বর্ষার মধ্যেও লোডশেডিং করতে হচ্ছে। আর লোডশেডিংয়ের প্রভাবে শিল্পোৎপাদন অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। সামনে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা আরও কঠিন হবে বলে মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা। লোডশেডিং থেকে মুক্তি পেতে ছয় মাসে জরুরি ভিত্তিতে দরকার ৩৭৬ কোটি ডলার। তা না হলে আপাতত লোডশেডিং থেকে মুক্তি নেই বলে মনে করছেন পিডিবি কর্মকর্তারা। পাশাপাশি ছয় মাসে ৩১ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকিও দিতে হবে।
পিডিবির তথ্যমতে, কয়লা ও ফার্নেস অয়েল আমদানি এবং ভারতের বিদ্যুতের বিল পরিশোধে ২০২২ সালের জুলাই মাসে দরকার হয়েছিল ৪২৩ মিলিয়ন ডলার, আগস্টে ৩৭৯ মিলিয়ন, সেপ্টেম্বরে ৩৮০ মিলিয়ন, অক্টোবরে ২৯৯ মিলিয়ন, নভেম্বরে ২৪৪ মিলিয়ন ও ডিসেম্বরে ২০৫ মিলিয়ন ডলার। তবে চলতি অর্থবছর একই খাতে জুলাইয়ে দরকার হবে ৪৯৪ মিলিয়ন ডলার, আগস্টে ৫১৩ মিলিয়ন, সেপ্টেম্বরে ৫০১ মিলিয়ন, অক্টোবরে ৪৯৩ মিলিয়ন, নভেম্বরে ৩৭৮ মিলিয়ন ও ডিসেম্বরে ৪০১ মিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া গত অর্থবছরের বিল বকেয়া রয়েছে ৯৭৭ মিলিয়ন ডলার। বিদ্যুৎ, শিল্পসহ অন্যান্য খাতের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে আমদানি করা হচ্ছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), কয়লা ও জ্বালানি তেল। এসব খাতে প্রতি বছর ক্রমবর্ধমান হারে দেশে জ্বালানি চাহিদা বাড়ছে। সরকারের জ্বালানি ব্যয়ের প্রাক্কলন ধরে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ২০৩০ সাল নাগাদ দেশে জ্বালানি আমদানিতে ব্যয় হবে ২৪ থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলার। ব্যবসায়ীরা বলেন, সরকার ২০৪১ সাল নাগাদ দেশে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা করতে বিপুল জ্বালানি আমদানি করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে গিয়ে বিপাকে পড়ার জোর আশঙ্কা রয়েছে।
আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে স্থানীয় গ্যাসের অনুসন্ধানে জোর দেয়া হলে এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। পাশাপাশি নিজস্ব কয়লা উত্তোলনেও দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। জ্বালানি পর্যাপ্ত মজুত ও জোগান নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা। আমদানির পাশাপাশি স্থানীয় গ্যাসের অনুসন্ধান, কয়লা উত্তোলন করা গেলে ডলার সাশ্রয়ী হবে বলেও জানান তারা। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সূত্র জানায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছর নাগাদ দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা দাঁড়াবে দৈনিক পাঁচ হাজার ৭৯ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বর্তমান চাহিদার চেয়ে প্রায় ৬ শতাংশ বেশি। দেশে গ্যাসের মজুত কমে যাওয়ায় এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। তবে বর্তমানে চাহিদা পূরণে কেবল আমদানিনির্ভরতা থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ শুধু জ্বালানি আমদানিতেই ব্যয় হবে ২৪ থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলার।
অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৩ অনুযায়ী, দেশে ২০২৫-২৬ অর্থবছর নাগাদ গ্যাসের চাহিদা দাঁড়াবে সাড়ে পাঁচ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি। বিদ্যমান গ্যাসের সরবরাহ সক্ষমতা রয়েছে তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের কিছু বেশি (এলএনজিসহ)। স্থানীয় গ্যাসের সরবরাহ একই পরিমাণ থাকলে দৈনিক আরো প্রায় আড়াই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি তৈরি হবে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘জ্বালানির দাম বাড়ায় বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় পিছিয়ে পড়ছে স্থানীয় উদ্যোক্তারা। এ পরিস্থিতিতে জ্বালানিতে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে স্থানীয় গ্যাস, কয়লা ও খনিজসম্পদ উত্তোলনে সরকারের জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।’ তিনি আরও বলেন, আমদানিনির্ভর জ্বালানি ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে গেলে আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তা থাকবে না। এসব আমদানিতে অনেক সময় ডলার সংকট হতে পারে, আবার টাকা দিয়েও অনেক সময় জিনিস পাওয়া যায় না। এ জন্য আমরা মনে করি, আমাদের আমদানির পাশাপাশি স্থানীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।’
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ ড. বদরূল ইমাম বলেন, ‘আমাদের এলএনজি আমদানিতে নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় জ্বালানি অনুসন্ধানে জোর দিতে হবে। এতে আমাদের ডলারের উপরও চাপ কিছুটা কমবে। দেশের দুই-তৃতীয়াংশ অঞ্চল এখনো অনুসন্ধান কার্যক্রমের বাইরে রয়েছে। বিশাল সমুদ্রের কোনো সম্পদই আমরা এখনো আহরণ করতে পারিনি। আমাদের এখন পর্যন্ত যত গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে, সবগুলোই খুব সহজে পাওয়া যায় এমন গ্যাসক্ষেত্র। যেসব গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে আমাদের অনেক বেশি শ্রম দিতে হবে, সেগুলোতে এখনো আমরা হাত দেইনি।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘গ্যাস ছাড়াও আমাদের কয়লা, খনিজ বালি, লোহার খনিসহ অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, সেগুলোয়ও মনোনিবেশ করতে হবে। এদিকে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় সরকার স্থানীয় গ্যাসের অনুসন্ধানের পাশাপাশি আমদানির উৎস, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, আসন্ন নতুন জ্বালানি এবং এ খাতের আধুনিকায়নের কাজ চলছে। আগামী দুই বছর যদি আমরা ৫০টি কূপ ড্রিল করি তাহলে ৬০০-৬৫০ এমএমসিএফ গ্যাস পাব। কিন্তু ৬৫০ এমএমসিএফ গ্যাস কমেও যাবে। এটিও কিন্তু মাথায় রাখতে হবে।’
উল্লেখ্য, দেশে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের বড় অংশই ব্যয় হয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি আমদানিতে। এক প্রক্ষেপণে দেখা যায়, ২০২৭ সাল নাগাদ দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা হবে গ্যাসভিত্তিক ১৬ হাজার ৬৫০ মেগাওয়াট, ফার্নেস অয়েলভিত্তিক ছয় হাজার ৪৯৭ মেগাওয়াট ও কয়লাভিত্তিক সাত হাজার ৯১ মেগাওয়াট। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা হবে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি হবে ৫৯১ মেগাওয়াট। আমদানি করা হবে দুই হাজার ৭৬০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ। আর এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি চাহিদা ও বিদ্যমান বাজার দর হিসাব করলে জ্বালানি আমদানিতে ব্যয় বাড়বে ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি।’