Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪,

ঋণের ৫ কোটি ডলার ফেরত পেলো বাংলাদেশ

সব হিসাব পাল্টে দিলো শ্রীলঙ্কা

রেদওয়ানুল হক

আগস্ট ২১, ২০২৩, ১১:৫৪ পিএম


সব হিসাব পাল্টে দিলো শ্রীলঙ্কা
  •  কিস্তি দিতে না পারলেও নিয়মিত সুদ পরিশোধ করছিল দেশটি
  • কারেন্সি সোয়াপের ঋণ হওয়ায় বিশেষ পদ্ধতিতে ঋণ ফেরত

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পর বাংলাদেশের ঋণের কিস্তি দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর বার্তা শ্রীলঙ্কার
—আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই

ভিন্ন উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করে বাংলাদেশকে দেয়া হতে পারে, ঋণ ফেরত পেতে বাংলাদেশের জোর প্রচেষ্টাই এখানে মুখ্য
—ড. রেজা কিবরিয়া, ম্যাক্রো ইকোনমিক এক্সপার্ট

বৈদেশিক ঋণের নিয়মনীতির সব হিসাব পাল্টে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধ শুরু করেছে শ্রীলঙ্কা। এ ঘটনা দেশটির অর্থনীতির নাটকীয় পরিবর্তন নাকি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রচেষ্টার ফসল তা নিয়ে চলছে বিশ্লেষণ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনীতির অন্যতম সূচক মূল্যস্ফীতির যাদুকরী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার বর্তমান সরকার ঘুরে দাঁড়ানোর যে আশা দেখাচ্ছে তারই আরেক সংযোজন বাংলাদেশের ঋণ ফেরত দেয়া। তবে ঋণ ফেরতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের কূটনৈতিক সফলতাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন অনেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত (রিজার্ভ) থেকে শ্রীলঙ্কাকে ২০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল বাংলাদেশ। ওই ঋণের ৫ কোটি (৫০ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার পরিশোধ করেছে  শ্রীলঙ্কা। আমার সংবাদকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক। 

তিনি বলেন, শ্রীলঙ্কাকে দেয়া ২০ কোটি ডলার ঋণের মধ্যে পাঁচ কোটি ডলারের একটি কিস্তি আমরা পেয়েছি। বর্তমানে লাইবর রেট বেড়ে যাওয়ায় ঋণের স্থিতি বেড়েছে কিনা এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ে কিস্তি না দিলেও ঋণের যে সুদ আসত তা লাইবর রেটের সাথে হিসাব করে নিয়মিত পরিশোধ করে আসছিল শ্রীলঙ্কা। তাই ঋণের স্থিতি বাড়েনি। প্রথম কিস্তি পরিশোধের ফলে বর্তমানে ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৫০ মিলিয়ন বা ১৫ কোটি ডলার।’ তিন মাসের মধ্যে ফেরত দেয়ার শর্তে কারেন্সি সোয়াপ পদ্ধতির আওতায় ২০২১ সালে ঋণ নেয় শ্রীলঙ্কা। কিন্তু যথাসময়ে ওই ঋণ ফেরত দিতে পারেনি; কয়েক দফা সময় চায় তারা। উপায় না থাকায় বাংলাদেশও কয়েক দফা সময় দেয়। সবশেষ আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সময় অতিবাহিত হলে পুনরায় সময় বাড়ানো হবে বলে জানা গেছে। তবে নতুন করে কত মাস সময় বাড়ছে তা জানাতে পারেননি মুখপাত্র। তিনি বলেন, ‘সময় বাড়ানোর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত এখনই জানানো যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট বিভাগের মতামত নিয়ে এ বিষয়ে জানানো যাবে।’ 

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রথম দফায় ২০২১ সালের ১৯ আগস্ট পাঁচ কোটি ডলার ছাড় করে বাংলাদেশ ব্যাংক। দ্বিতীয় দফায় ১০ কোটি ডলার দেয়া হয় ওই বছরের ৩০ অক্টোবর। এরপর পাঁচ কোটি ডলার দেয়া হয় নভেম্বরে। বিদ্যমান চুক্তির আওতায় গত বছরের আগস্ট, অক্টোবর ও নভেম্বরের মধ্যে সুদসহ অর্থ ফেরত দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে ঋণ ফেরত দিতে ব্যর্থ হয় দেশটি। ঋণের বিপরীতে লন্ডন আন্তঃব্যাংক অফার রেট বা লাইবর রেটের সাথে ২ শতাংশ সুদ যোগ করে তা বাংলাদেশেকে নিয়মিত পরিশোধ করছে শ্রীলঙ্কা। ঋণ দেয়ার সময় (২০২১ সালে) লাইবর রেট ছিল শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ। বর্তমানে সুদ হার অনেক বেড়েছে। চলতি মাসের ১৮ তারিখে হিসাবকৃত লাইবর রেট ছিল ৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ। অর্থাৎ স্বল্প সময়ে ঋণ আদায় করতে পারলে শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দিয়ে সুদ বাবদ ভালোই লাভ করতে পেরেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। 

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের রিজার্ভের নিম্নমুখী অবস্থানের মধ্যে শ্রীলঙ্কার ঋণ ফেরত পাওয়া খুবই ভালো খবর। এক্ষেত্রে দেশটির বর্তমান সরকার অর্থনীতির পুনর্গঠনে যে উদ্যোগ নিয়েছে তার ইতিবাচক ফলাফল লক্ষ করা যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক দুজন কর্মকর্তার সাথে কথা হয়েছে আমার সংবাদের। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এটি একটি বিশেষ লোন। যা কারেন্সি সোয়াপ পদ্ধতিতে দেয়া হয়েছিল। তাই এটি সহজেই ফেরত পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঋণ ফেরত দেয়া বা পাওয়া উভয় দেশের জন্যই ইতিবাচক। এটা স্পষ্ট যে, শ্রীলঙ্কার বর্তমান সরকার অর্থনীতির নাটকীয় পরিবর্তন আনতে পেরেছে। অর্থনীতির অন্যতম সূচক মূল্যস্ফীতি সিঙ্গেল ডিজিটে আনতে পারা বড় অর্জন। দেশটি হয়তো তাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত ট্যুরিজমকে চাঙ্গা করতে পেরেছে। এছাড়া আইএমএফের লোন পেয়ে অনেকটা ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে।’ 

তবে বাংলাদেশকে ঋণ ফেরত দেয়ার মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির বড় পরিবর্তন দেখছেন না ম্যাক্রো ইকোনমিক বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ড. রেজা কিবরিয়া। ঋণ ফেরতের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রচেষ্টাকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন আইএমএফের সাবেক এ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক যে, শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে; যা প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল। কিন্তু দেশটির বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হয়নি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম দ্বিগুণ হওয়ায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বড় দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। দেশটির হাজারের বেশি ডাক্তার বিদেশে চলে যাওয়ায় হাসপাতালগুলো ডাক্তারশূন্য হয়ে পড়েছে। তবে তারা ধীরে ধীরে উন্নতি করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে দেশটির অর্থনৈতিক উন্নতির চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রচেষ্টাই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। বাংলাদেশ তাদের বুঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা খুব প্রয়োজন।’

তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক ঋণ স্ট্যান্ডার্ড এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী ঋণ ফেরত পাওয়ার সবচেয়ে বেশি দাবিদার আইএমএফ, এরপর বিশ্ব ব্যাংক, এডিবিসহ অন্যান্য প্রাইভেট সেক্টর। সে হিসাবে শ্রীলঙ্কার বর্তমানে যে বৈদেশিক দায় রয়েছে তাতে বাংলাদেশের ঋণ পেতে অনেক সময় লাগার কথা। কিন্তু জি টু জি (সরকার টু সরকার) ঋণের কিছু নিয়ম আছে। সে অনুযায়ী অন্য কোনো উৎস থেকে ঋণ নিয়ে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।’   

বর্তমানে দেশের রিজার্ভ ২৩.১৪ বিলিয়ন ডলার : সবশেষ ১৬ আগস্টের তথ্য অনুযায়ী, দেশের রিজার্ভ আছে দুই হাজার ৯৩৮ কোটি ডলার (২৯ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন) ডলার। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থার (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে হিসাব করতে গিয়ে ৬২৩ কোটি ৭৬ লাখ ডলার বাদ দেয়া হয়েছে। সে হিসাবে বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ নেমে দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলারে। প্রতি মাসে ছয় বিলিয়ন ডলার হিসাবে এ রিজার্ভ দিয়ে চার মাসের মতো আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে বাংলাদেশ।

সারা বিশ্বে প্রচলিত ও বহুল ব্যবহূত আইএমএফের ব্যালেন্স অব পেমেন্টস অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম ৬) অনুযায়ী, রিজার্ভ গণনায় বাংলাদেশ ব্যাংক গঠিত বিভিন্ন তহবিলের পাশাপাশি বিমানের জন্য প্রদত্ত ঋণ গ্যারান্টি, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে মুদ্রা বিনিময়, পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে দেয়া ঋণ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকে আমানত এবং নির্দিষ্ট গ্রেডের নিচে থাকা সিকিউরিটিতে বিনিয়োগ অন্তর্ভুক্ত নয়। এসব খাতে রিজার্ভ থেকে ৬৩৭ কোটি ডলার দেয়া আছে, যা বাদ দিয়ে হিসাব করা হয়েছে।
 

Link copied!