Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

বিদ্যুৎ বিলে তেলেসমাতি কাণ্ড

মহিউদ্দিন রাব্বানি

সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৩, ১১:৪২ পিএম


বিদ্যুৎ বিলে তেলেসমাতি কাণ্ড
  • মিটার না দেখেই মনগড়া বিল প্রস্তুতের অভিযোগ, অনিয়ন্ত্রিত বিলে অস্বস্তিতে গ্রাহক
  • অস্বাভাবিক বিল এলে স্থানীয় অফিসে যোগাযোগের অনুরোধ পিডিবির, অভিযোগ দিয়েও তেমন সুরাহা মিলছে না ভুক্তভোগীদের

বেশি বেশি বিল করে সিস্টেম লস কমানোর চেষ্টা
করা হচ্ছে  
—এম শামসুল আলম, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ

কারিগরি ত্রুটি ও কর্মিসংকটে বিল প্রস্তুত করতে ছোটখাটো ভুল হয়
—মিজানুর রহমান, নির্বাহী প্রকৌশলী, ওজোপাডিকো

বিদ্যুৎ বিল নিয়ে তুগলকি কাণ্ড চলছে দেশজুড়ে। ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলেছে বিদ্যুতের বিল। স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বিল বেশি আসার অভিযোগ করেছেন অনেকেই। প্রতিকার চেয়ে বিদ্যুৎ অফিসের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন হাজারো ভুক্তভোগী। নিত্যপণ্যে অস্বাভাবিক দাম বাড়ার পর বিদ্যুতের এমন তেলেসমাতি কাণ্ড দেখে দিশাহারা গ্রাহকরা। বিদ্যুৎ খাতের ছয়টি বিতরণ কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ রয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (বিআরইবি) গ্রাহকদের। চাঁদপুর জেলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর গ্রাহক দেলোয়ার হোসেন অতিরিক্ত বিলের অভিযোগ করেন। তিনি জানান, জুন মাসে তার বিল আসে ৮৪ টাকা। কিন্তু জুলাই মাসে তা ২০ গুণ বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৭৩৮ টাকা। এমন ভুতুড়ে বিদ্যুৎ বিল দেখে তার মাথায় হাত।    

শুধু পল্লী বিদ্যুৎ নয়, রাজধানীসহ দেশের অন্য অঞ্চলের বিতরণ কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধেও বাড়তি বিল করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, গ্রামগঞ্জে এমনিতেও ঠিকমতো বিদ্যুৎ থাকে না। তার ওপর বাড়তি বিলের বোঝা চাপিয়ে দেয়া অন্যায়। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, সিস্টেম লস কমাতে গিয়ে বাড়তি বিদ্যুৎ ব্যবহারের বোঝা গ্রাহকের বিলে যোগ করা হয়। মে, জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে এ বিষয়টি বেশি ঘটে। বিদ্যুতের এমন ভুতুড়ে কাণ্ড নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আক্ষেপ করে পোস্ট করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ইয়ামিন রহমান। তিনি লেখেন, আমি বাসায় না থেকেও অস্বাভাবিক বিল এসেছে। মুঠোফোনে আইন বিভাগের এই শিক্ষক আমার সংবাদকে বলেন, কয়েক মাস ধরেই বিদ্যুৎ বিল বেড়েই চলেছে। মে-জুনে বিল এলো চার হাজার করে। জুলাই-আগস্টে তা বেড়ে দাঁড়াল ছয় হাজার টাকারও বেশি। তিনি বলেন, আমি গত মাসে ১৬ দিন বাসায় ছিলাম না। তারপরও এত বিল আসার কোনো কারণ দেখছি না। বিস্মিত হয়ে তিনি বলেন, আমি বাসায় না থাকায় বিদ্যুৎ খরচ করল কী ভূতে!

ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ওজোপাডিকো) একাধিক গ্রাহক সোশ্যাল মিডিয়াতে বিদ্যুৎ বিলের অসংগতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অতিরিক্ত বিল নিয়ে তাওফিক আনাম নামে একজন বলেন, যে মাসে দিনে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা লোডশেডিং ছিল। সে মাসে বিল দিয়েছিলাম চার হাজার ৪০০ টাকা। তার মধ্যে আবার সাত দিন বাড়ি ছিল না কেউ। 

নাফিদা নওরীন বলেন, আমি পুরা এক মাস বাসায় ছিলাম না, তবুও ৬০০ টাকা বিল এলো। হামজা ইবনে মুজিব বলেন, গত মাসে পুরো মাস বাসায় থেকে ১০ হাজার টাকা বিল আসছিল। আর এই মাসে ১৭ দিন বাসায় না থেকেও ১২ হাজার বিল এসেছে। তিনি বলেন, বিশাল গড়বড় আছে এই সিস্টেমে। 

রাজধানীর রায়েরবাগের বাসিন্দা ডিপিডিসির গ্রাহক বেলাল হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, কয়েক মাস ধরেই বিদ্যুতের বিল বেড়েই চলেছে। তিনি বলেন, প্রি-পেইড মিটারে এক হাজার টাকা রিচার্জ করি। এতে এজেন্ট চার্জ ১০ টাকা, পাঁচ শতাংশ ভ্যাট হিসেবে ৪৭ টাকা, রিবেট এক শতাংশ হিসেবে সাত টাকা, ছয় মাসের মিটার চার্জ ২৪৬ টাকা এবং ডিমান্ড চার্জ  ৪২০ টাকা কেটে নেয়। ‘বিভিন্ন চার্জে অতিষ্ঠ গ্রহকরা’ যুক্ত করেন তিনি। 

রাজধানীর অন্য এক গ্রাহক অভিযোগ করেন, মে মাসে পুরো এসি চালিয়েও বিল এসেছে সাড়ে তিন হাজার টাকা। জুন মাসে তা বেড়ে হয় সাড়ে চার হাজার টাকা। জুলাইয়ে এসি খুব কম চালানোর পরও বিল এসেছে ছয় হাজার ৮০০ টাকা। তিনি ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) গ্রাহক। ভুতুড়ে বিলের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বিরুদ্ধে। কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রামের গ্রাহকদের বিল বেশি করলেও সে বিষয়ে তারা তেমন অভিযোগ করেন না। 

নরসিংদীর বাসিন্দা তারিক মুহাম্মদ নাসরুল্লাহ আমার সংবাদকে জানান, চলতি বছরের মার্চ মাসে বিদ্যুৎ বিল আসে ১০ হাজার ৯৮৬ টাকা। এপ্রিল ও মে একত্রে সে বিল ২১ হাজার ৮৬০ টাকা দাঁড়ায়। জুনে ১১ হাজার ৬৬৭ টাকা। এদিকে জুলাই ও আগস্ট মাসে তুলনামূলক কম ব্যবহার করেও বিল বেশি এসেছে। এ দুই মাসে আমার বিদ্যুৎ বিল দাঁড়ায় ২৩ হাজার ৩৩ টাকা। আগের তুলনায় কম ব্যবহার করেও অতিরিক্ত বিল গুনতে হচ্ছে— অভিযোগ করেন তিনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বিতরণ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বিদ্যুতের ব্যবহার যেমন বেড়েছে, তেমনি চুরিও হচ্ছে। নানা কারণে সিস্টেম লস হচ্ছে। অনেক লাইনম্যান গ্রাহকদের হয়রানি করতে এবং বেশি বেশি আদায় দেখাতে বিল বাড়িয়ে দেখায়। 

তিনি বলেন, অভিযোগ পেলে এগুলোর সমাধান করা হবে। তবে ডিপিডিসি ও সেককোর ব্যবস্থাপকদ্বয়কে ফোন করলে  সংযোগ পাওয়া যায়নি।এদিকে সারা দেশে নানা অভিযোগের ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। 

সম্প্রতি ফেনী জেলা প্রশাসক শাহীনা আক্তার বলেছেন, মিটার রিডিং না দেখে বিদ্যুৎ বিল তৈরি করা হচ্ছে। আগের মাসের বিলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রাক্কলিত বিল দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। 

তিনি বলেন, সরেজমিনে মিটার রিডিং দেখে বিদ্যুৎ বিল তৈরি করতে হবে। এদিকে মাদারীপুরে মিটার না দেখেই বিদ্যুৎ বিল দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। মাদারীপুর শহরে বিদ্যুৎ বিল নিয়ে গ্রাহকরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। শহরের অধিকাংশ বাসাবাড়িতে বিদ্যুতের মিটারে ইউনিটের সঙ্গে বিলের অঙ্কের হিসাব মেলে না। 

গ্রাহকদের অভিযোগ, মাদারীপুরের ওজোপাডিকো কর্মীরা বাসাবাড়িতে গিয়ে মিটার না দেখেই অফিসে বসে মনগড়া বিদুুৎ বিল প্রস্তুত করে গ্রাহকের কাছে সরবরাহ করেন। এ বিষয়ে বিদুৎ অফিসে অভিযোগ করেও কোনো সুরাহা পান না বলে গ্রাহকরা অভিযোগ করছেন। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, কারিগরি ও কর্মী সংকটের কারণে অনেক সময় বিল প্রস্তুতে সমস্যা হচ্ছে। অভিযোগ পেলে সমাধানও তারা করে দিচ্ছেন। 

মাদারীপুর শহরের চরমুগরিয়া এলাকার এক বাসিন্দা অভিযোগ করে বলেন, আমার বাসার বিদ্যুতের মিটারে ২৫০ টাকা বিল এসেছে। কিন্তু ওজোপাডিকো কর্মীরা আমার বাসায় ৪০০ টাকার বিল দিয়েছেন। পরে আমি বিদ?্যুৎ অফিসে এসে অভিযোগ করলে তারা আমার বিল পরের মাস থেকে সমন্বয় করার প্রতিশ্রুতি  দেন। তার প্রশ্ন, মিটার না দেখেই কেন মনগড়া বিল তৈরি করে আমাদের হয়রানি করা হচ্ছে।

পিডিবি সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুতের অস্বাভাবিক বিলের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বিদ্যুতের দামও কিছুটা বেড়েছে; কিন্তু বিদ্যুৎ ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা সেভাবে তৈরি হয়নি। বিদ্যুৎ ব্যবহার যত বেশি হবে, সেই মার্জিনে দাম তত বেশি আসবে। তারপরও যেটা অস্বাভাবিক বিল বলে মনে হবে, সে ধরনের অভিযোগ নিয়ে গ্রাহক স্থানীয় বিদ্যুৎ অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদারীপুর ওজোপাডিকোর নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান অস্বাভাবিক বিল প্রস্তুতের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, যেসব গ্রাহক বিদুৎ বিল নিয়ে অভিযোগ করেছেন, আমরা তাদের সমস্যাগুলো সমাধান করে দিই। কারিগরি ত্রুটি ও কিছু কর্মী সংকটের কারণে অনেক সময় বিল প্রস্তুত করতে ছোটখাটো ভুল হয়ে থাকে। 

বিদ্যুতের এমন ভুতুড়ে বিলের বিষয়ে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ বিল নিয়ে নানা অভিযোগই পাওয়া যাচ্ছে। নতুন নতুন অভিযোগ আরও আসবে। বিদ্যুৎ বিভাগ বিতরণ কোম্পানিগুলোকে সিস্টেম লস কমাতে নিয়মিত লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে দেয়। কিন্তু বিতরণ ব্যবস্থাপনার তো সেভাবে উন্নতি হয়নি। ফলে সিস্টেম লস তেমন কমে না। কিন্তু বছর শেষে সাফল্য দেখাতে বেশি বেশি বিল করে সিস্টেম লস কমিয়ে দেখানো হয়। এত সাধারণ গ্রাহক অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে সচেতন হওয়া উচিত।
 

Link copied!