সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৩, ১১:৪৭ পিএম
খেলাপি ঋণের সঠিক তথ্য আড়াল করে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ভুল তথ্য দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। শ্রেণিকৃত ঋণের জুন প্রান্তিকের তথ্য দাখিলে কারসাজি করে ব্যাংকটি। গত তিন মাসে ব্যাংকটিতে বিপুল ঋণখেলাপি মানে শ্রেণিকরণ হওয়ায় প্রকৃত তথ্য গোপন করে ছলছাতুরির আশ্রয় নিয়েছেন জনতা ব্যাংক কর্মকর্তারা। এর আগে গত ডিসেম্বর প্রান্তিকে ৮১০ কোটি টাকা গোপন করেছিল ব্যাংকটি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে এটি ধরা পড়লে ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে সঠিক তথ্য উপস্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রের তথ্যমতে, জুন প্রান্তিকে জনতাসহ অন্তত পাঁচটি ব্যাংকের তথ্যে গরমিল পাওয়া গেছে। তাই আগামী ২০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ব্যাংকগুলোকে সঠিক তথ্য দাখিল করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, প্রকৃত তথ্য আড়াল করে ব্যাংকগুলো আর্থিক প্রতিবেদন ভালো দেখাতে চায়। এজন্য বিভিন্ন সুবিধা বা কৌশলে খেলাপির তথ্য কম দেখায়। এতে সঞ্চিতি কম রাখতে হয়। আবার ওই ঋণের বিপরীতে আদায় দেখানো যায়। এতে প্রকৃত তথ্য আড়ালে চলে যায় এবং মালিকপক্ষ লভ্যাংশ নেয়ার সুযোগ পায়। আবার কোনো কোনো সময় ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ তাদের পারফরম্যান্স ভালো দেখাতেও তথ্য গোপন করে থাকে।
সাধারণত কোনো প্রান্তিক শেষ হওয়ার দেড় মাসের মধ্যে শ্রেণিকৃত ঋণের তথ্য প্রস্তুত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বোচ্চ এক মাস ২০ দিনের মধ্যে ব্যাংকগুলোকে তথ্য দাখিল করতে হয়। কিন্তু আড়াই মাস পরও গত জুন প্রান্তিকের তথ্য প্রস্তুত করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। কয়েকটি ব্যাংকের তথ্য গোপনের কারণে নির্ধারিত সময়ের পরও প্রতিবেদন প্রস্তুত করা যাচ্ছে না। বারবার সময় দিয়েও তাদের কাছ থেকে খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য আদায় করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে আইএমএফের পক্ষ থেকে খেলাপি ঋণের সঠিক প্রতিবেদন প্রস্তুতের চাপ রয়েছে।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের সাবেক এক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমার সংবাদকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলো এখন ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। নিজেরাই ব্যাংকের মালিক হচ্ছেন; আবার অনেকে স্বার্থসংশ্লিষ্ট বাক্তিদের ঋণ দিয়ে রেখেছে। কেউ কারো কথা শুনছে না। ব্যাংক খাতে বর্তমানে যে নাজুক পরিস্থিতি চলছে, তা আড়াল করতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য আড়াল করার পন্থা বেছে নিয়েছে ব্যাংকগুলো।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি আমার সংবাদকে বলেন, ‘তথ্য লুকানো নয়, বরং তথ্য ভুল হয়েছে। এখন সংশোধনের জন্য বলা হয়েছে।’ ঋণ শ্রেণিকরণে কিছু পরিবর্তন আনার কারণে ব্যাংকগুলোর তথ্য সরবরাহে অসুবিধা হচ্ছে।’
কিন্তু মুখপাত্রের এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন বেসরকারি ব্যাংকের এমডিরা। অন্তত তিনজন এমডি আমার সংবাদকে জানিয়েছেন, তারা নির্ধারিত সময়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে তথ্য দাখিল করেছেন। তারা বলেন, ‘তথ্য প্রস্তুতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। যদি সমস্যা হতো, তাহলে আমাদের কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কোনো সময় আবেদনের জন্যও আমাদের কর্মকর্তারা অনুরোধ করেননি। নির্ধারিত সময়ে নিয়ম মেনেই তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে।’
মূলত জনতা ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো প্রকৃত তথ্য গোপন করেছে। গণমাধ্যমে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরে আসে। তখন অন্তত পাঁচটি ব্যাংকের তথ্যে গরমিল পাওয়া যায়। তাই আগামী ২০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সঠিক তথ্য দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
জনতা ব্যাংকের নিজস্ব নথিপত্র অনুযায়ী, গত তিন মাসে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এর ফলে ব্যাংক খাতের সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ এখন এই ব্যাংকটির। গত মার্চ শেষে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। জুনে তা বেড়ে হয়েছে ২৮ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা। তাতে ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ৩০ দশমিক ৪৩ শতাংশই এখন খেলাপি। মার্চেও এ হার ছিল ১৬ দশমিক ১৫ শতাংশ।
এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ফোন করা হলে তিনি সাড়া দেননি। ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে মন্তব্য চাওয়া হলে এমডির সহকারীরা সাক্ষাতের অনুমতি দেননি।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সম্প্রতি বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলারের যে ঋণ দিয়েছে, তার বিপরীতে শর্ত দেয়া হয় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। আইএমএফের ওই শর্তের পর বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেয় জনতাসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২১ সাল শেষে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১২ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা। গত জুনে যা বেড়ে হয়েছে ২৮ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা। তাতে দেড় বছরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ফলে ব্যাংকটি বড় অঙ্কের মূলধন সংকটে পড়েছে। গত জুনে মূলধন ঘাটতি বেড়ে হয় দুই হাজার ১৮৯ কোটি টাকা। ২০২২ সাল শেষে যা ছিল এক হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের বিপরীতে ২০২২ সাল শেষে ব্যাংকটির ১৩ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু সংরক্ষণ করতে পারে পাঁচ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা। বাকি আট হাজার ৫০৩ কোটি টাকা সংরক্ষণের জন্য ব্যাংকটিকে ২০৩১ সাল পর্যন্ত সময় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয় মুনাফা থেকে।
এর আগে গত ডিসেম্বর প্রান্তিকে ৩৩ ব্যাংক খেলাপির তথ্য গোপন করেছে ১৮ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংক চার হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা আর বেসরকারি ২৮ ব্যাংক ১৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা গোপন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রতিবেদন দাখিল করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হালনাগাদ বিবরণী অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে দেশে ব্যাংক খাতে ঋণ ছিল ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। ওই সময় খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় এক লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংক ঋণের আট দশমিক ৮০ শতাংশই তখন খেলাপি ছিল। এর আগে গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা বা আট দশমিক ১৬ শতাংশ।